১৭৫. ভববন্ধনচ্ছেদনের উপায়—পিতাপুত্রসংবাদ

১৭৫তম অধ্যায়

ভববন্ধনচ্ছেদনের উপায়—পিতাপুত্রসংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! এই সৰ্ব্বভূতক্ষয়কর কাল অতি সত্বর অতিক্রান্ত হইতেছে, সুতরাং মনুষ্য কিরূপে শ্রেয়োলাভ করিবে, আপনি তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! আমি এই স্থলে পিতাপুত্রসংবাদ নামে এক প্রাচীন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূৰ্ব্বকালে কোন স্বাধ্যায়নিরত ব্রাহ্মণের মেধাবীনামে এক মেধাবী পুত্র ছিলেন। একদা সেই মোক্ষধর্ম্মার্থকুশল [মুক্তিধৰ্ম্মে নিরত] লোকতত্ত্ববিশারদ [জীবলোকতত্ত্বজ্ঞ] মেধাবী পিতাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, পিতঃ! মনুষ্যের পরমায়ু অতি সত্বর ক্ষয় হইতেছে, ধীরস্বভাবসম্পন্ন ব্যক্তি ইহা সম্যক অবগত হইয়া কি কি কার্য্যের অনুষ্ঠান করিবেন, আপনি তাহা যথার্থরূপে আনুপূর্ব্বিক কীৰ্ত্তন করুন। আপনার উপদেশানুসারে ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিব।

“পিতা কহিলেন, বৎস! মনুষ্য সর্ব্বাগ্রে ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন পূৰ্ব্বক বেদাধ্যয়ন ও তৎপরে পিতৃগণের উদ্ধারসাধনের নিমিত্ত পুত্রোৎপাদনের ইচ্ছা করিবে এবং পরিশেষে বিধিপূৰ্ব্বক অগ্ন্যাধান [অগ্নিস্থাপন] ও যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া বানপ্রস্থ অবলম্বনপূৰ্ব্বক মুনি হইবে।

“পুত্র কহিলেন, তাত! এই জীবলোক নিরন্তর অভিভূত ও আক্রান্ত হইতেছে এবং ইহাতে অমোঘ বিষয়সমুদয় নিরন্তর গতায়াত করিতেছে, সুতরাং আপনি কিরূপে আমাকে ঐ প্রকার উপদেশ প্রদানপূর্ব্বক স্বয়ং কার্য্যানুষ্ঠান না করিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া রহিলেন?

“পিতা কহিলেন, ‘বৎস! তুমি আমাকে কি নিমিত্ত এইরূপ বিভীষিকা প্রদর্শন করিলে? জীবলোক কোন্ বস্তুদ্বারা অভিভূত ও কোন্ বস্তুদ্বারা আক্রান্ত হইতেছে এবং ইহাতে কিরূপ অমোঘ বিষয়সকলই বা নিরন্তর গতায়াত করিতেছে?’

“পুত্র কহিলেন, ‘তাত! এই জীবলোক সততই জরাদ্বারা অভিভূত ও মৃত্যুদ্বারা আক্রান্ত হইতেছে এবং ইহাতে আয়ুঃক্ষয়কর রাত্রিসমুদয় পৰ্য্যায়ক্রমে গমনাগমন করিতেছে। আপনি কি নিমিত্ত ইহা অবগত হইতেছেন না? আমি যখন বিশেষরূপে অবগত হইয়াছি যে, রাত্রি সকল প্রতিনিয়ত জগতে সঞ্চরণ করিয়া লোকের আয়ুক্ষয় করিতেছে এবং ক্রমে ক্রমে অগ্রসর হইতেছে, তখন কিরূপে অজ্ঞানান্ধকারে আচ্ছন্ন হইয়া কালাতিপাত করিব? যখন প্রত্যেক রাত্রি লোকের আয়ুঃক্ষয় করিতেছে, তখন মনুষ্যের জীবিতকাল নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। যখন মৃত্যু আসিয়া উপস্থিত হয়, তখন অল্প সলিলস্থ মৎস্যের ন্যায় কোন ব্যক্তিই সুখলাভে সমর্থ হয় না। মনুষ্যের অভিলাষ সুখসম্পন্ন না হইতে হইতেই মৃত্যু তাহাকে আক্রমণ করে এবং ব্যাঘ্ৰী যেমন মেষকে লইয়া যায়, সেইরূপ সে বিষয়াসক্তচিত্ত কাম্যকর্ম্মের ফলভোগপ্রবৃত্ত মনুষ্যকে গ্রহণপূৰ্ব্বক গমন করিয়া থাকে। অতএব যাহা আপনার শ্রেয়স্কর, তাহা অদ্যই অনুষ্ঠান করা কৰ্ত্তব্য। তদ্বিষয়ে কালপ্রতীক্ষা করা নিতান্ত অনুচিত। মনুষ্যের কাৰ্য্য অনুষ্ঠিত না হইতে হইতেই মৃত্যু তাহাকে আকর্ষণ করিয়া থাকে; সুতরাং যাহা পরদিনের কাৰ্য্য, তাহা অদ্যই অনুষ্ঠান করা কৰ্ত্তব্য এবং যাহা অপরাহ্ণে অনুষ্ঠান করিতে হইবে, তাহা পূর্ব্বাহ্ণেই সম্পন্ন করা শ্রেয়স্কর। মনুষ্যের কার্য্য সমাধা হউক বা না হউক, মৃত্যু তাহার প্রতীক্ষা করে না এবং কোন্ দিন যে মৃত্যু হইবে, তাহাও কেহ অবধারণ করিতে পারে না। মনুষ্যের জীবন অনিত্য, অতএব যৌবনাবস্থাতেই ধৰ্ম্মানুশীলন করা আবশ্যক। ধৰ্ম্ম অনুষ্ঠিত হইলে ইহলোকে কীৰ্ত্তি ও পরলোকে সুখলাভ হইয়া থাকে। মনুষ্য মোহপ্রভাবে পুত্ৰকলাদির কাৰ্য্যসাধনে উদ্যত হইয়া কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্যের প্রতি দৃষ্টিপাত না করিয়াই যে-কোন প্রকারে হউক, উহাদিগকে ভরণপোষণ করে, কিন্তু ব্যাঘ্র যেমন নিদ্রিত মৃগকে লইয়া যায়, তদ্রূপ মৃত্যু সেই বিষয়সম্ভোগে অপরিতৃপ্ত পুত্রাদি-পরিবৃত মনুষ্যকে অনায়াসে হরণ করিয়া থাকে। লোকে এই কাৰ্য্য সম্পূর্ণ হইয়াছে, এই কাৰ্য্য অৰ্দ্ধ অনুষ্ঠিত হইয়াছে এবং এই কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিতে হইবে, এইরূপ চিন্তা করিতে করিতেই কৃতান্তের বশীভূত হয়। মনুষ্য কিছুমাত্র কর্ম্মের ফল উপভোগ করিতে না করিতেই এবং ক্ষেত্র, গৃহ ও বিপণিকার্য্যে সংসক্ত থাকিতে থাকিতেই মৃত্যু তাহাকে আত্মসাৎ করে। কি দুর্ব্বল, কি বলবান্‌, কি শূর, কি ভীরু, কি মূর্খ, কি পণ্ডিত, মৃত্যু কাহাকে পরিত্যাগ করে না।

‘হে তাত! যখন মৃত্যু, জরা, ব্যাধি ও বিবিধ নিমিত্তসমুৎপন্ন দুঃখসমুদয় দেহকে আশ্রয় করিয়া রহিয়াছে, তখন আপনি কি প্রকারে সুস্থের ন্যায় অবস্থান করিতেছেন? জীব জন্মগ্রহণ করিবামাত্র জরা ও মৃত্যু তাহার বিনাশসাধনের নিমিত্ত তাহাকে আক্রমণ করিয়া থাকে। এই জরা ও মৃত্যুদ্বারা স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় পদার্থই আক্রান্ত ও অভিভূত রহিয়াছে। গ্রামে বাস মৃত্যুমুখে অবস্থানের তুল্য; অরণ্য দেবতার স্থান বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে; অতএব তথায় বাস করিয়া তপস্যা করাই শ্রেয়। স্ত্রীপুত্ৰাদির প্রতি আসক্তিই সংসারবন্ধনের রঞ্জু। পুণ্যবান্ লোক সেই রজ্জু ছেদন করিয়া মুক্তিলাভ করেন; আর যে ব্যক্তি পাপাত্মা, সে কখনই সেই রঞ্জু ছেদন করিতে সমর্থ হয় না। যে ব্যক্তি কায়মনোবাক্যে কদাপি কাহারও হিংসা না করে, হিংস্র ও তস্করগণ তাহার কোন অপকার করিতে প্রবৃত্ত হয় না। জরা ও ব্যাধি মৃত্যুর সেনাস্বরূপ। কোন ব্যক্তি উহাদিগকে আগমন করিতে দেখিয়া নিবারণ করিতে পারে না।

‘সত্য পরিত্যাগ করা কদাপি কর্ত্তব্য নহে। সত্যেই অমৃত প্রতিষ্ঠিত আছে। অতএব সত্যব্রত, সত্যযোগ ও সত্য আগমপরায়ণ হইয়া সত্যদ্বারাই মৃত্যুকে পরাজিত করিবে। মৃত্যু ও অমৃত এই দুইটিই দেহমধ্যে সঞ্চরণ করিতেছে; তন্মধ্যে মনুষ্য মোহপ্রভাবে মৃত্যু এবং সত্যপ্রভাবে অমৃত লাভ করিয়া থাকে। অতএব আমি এক্ষণে ভগবান ব্রহ্মার ন্যায় কাম, ক্রোধ ও হিংসাশূন্য, সত্যপরায়ণ, ক্ষমাবান এবং সমদুঃখসুখ হইয়া মৃত্যুভয় পরিত্যাগ করিব। উত্তরায়ণ[মাঘ মাস—মাঘ হইতে আষাঢ় পৰ্য্যন্ত ছয় মাস সূর্য্যের ক্রমশঃ উত্তর দিকে গতি বলিয়া এই কালের নাম পবিত্র উত্তরায়ণ] উপস্থিত হইলে আমি শান্তিযজ্ঞ, ব্ৰহ্মযজ্ঞ, বাগ্‌যজ্ঞ, মনোযজ্ঞ ও কৰ্ম্মযজ্ঞে প্রবৃত্ত হইব। মাদৃশ ব্যক্তিদিগের কখনই হিংসামূলক পশুযজ্ঞ বা অনিষ্টফলপধায়ক ক্ষাত্রযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতে প্রবৃত্তি জন্মে না। যাঁহারা বাক্য, মন, তপস্যা, ত্যাগ ও সত্যব্রহ্মনিষ্ঠ, তিনি নিশ্চয়ই পরগতি লাভ করিয়া থাকেন। বিদ্যার তুল্য চক্ষু, সত্যের তুল্য তপস্যা, আসক্তির তুল্য দুঃখ ও বিরক্তির তুল্য সুখ আর কিছুই নাই। আমি ব্ৰহ্মরূপে ব্রহ্ম হইতে উৎপন্ন হইয়াছি। আমি ব্রহ্মনিষ্ঠ। অতএব আমি কখনই জায়ার [পত্নীর গর্ভে আত্মা পুত্ররূপে উৎপন্ন হয়; “আত্মা বৈ জায়তে পুত্র” (শ্রুতি)] গর্ভে পুত্ররূপে উৎপন্ন হইব না। পুত্র আমার উদ্ধারসাধনে সমর্থ নহে। আমি ব্রহ্মেই উৎপন্ন হইব। একাকিত্ব, সমতা, সত্য, সচ্চরিত্রতা, অহিংসা, সরলতা, তপস্যা ও যজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপ হইতে নিবৃত্তিই ব্রাহ্মণের পরমধর্ম্ম। বিনশ্বর ঐশ্বৰ্য্য, বন্ধুবান্ধব ও পুত্র-কলত্রে প্রয়োজন কি? আপনার পিতা ও পিতামহ কোথায় গমন করিয়াছেন, তাহার কিছুই নির্ণয় নাই, অতএব বুদ্ধিমধ্যে প্রবিষ্ট ব্ৰহ্মকেই অনুসন্ধান করুন।

“হে যুধিষ্ঠির! ব্রাহ্মণ পুত্রের এইরূপ হিতকর বাক্য শ্রবণ করিয়া যেরূপ অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, তুমিও ধর্ম্মপরায়ণ হইয়া সেইরূপ অনুষ্ঠান কর।”