১৬৭. ভীষ্মের বিশ্রামকালে বিদুরের যুধিষ্ঠিরোপদেশ

১৬৭তম অধ্যায়

ভীষ্মের বিশ্রামকালে বিদুরের যুধিষ্ঠিরোপদেশ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পিতামহ ভীষ্ম এইকথা বলিয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলে ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির বাসস্থানে গমনপূৰ্ব্বক চারি ভ্রাতা ও বিদুরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হে ধৰ্ম্মজ্ঞগণ! ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কাম এই তিনের প্রভাবেই লোকযাত্রা নির্ব্বাহ হইতেছে। এক্ষণে এই তিনটির মধ্যে কোটি প্রধান, কোটি মধ্যম ও কোটি অপকৃষ্ট এবং কাম, ক্রোধ ও লোভ এই ত্রিবর্গ-বিজয়ের নিমিত্তই বা কোটিকে অবলম্বন করিতে হইবে, তৎসমুদয় যথার্থরূপে কীৰ্ত্তন কর।”

ধর্ম্মাত্মা ধৰ্ম্মরাজ এই কথা কহিলে সৰ্ব্বপ্রথমে প্রতিভাসম্পন্ন যথার্থ তত্ত্বজ্ঞ বিদুর ধর্ম্মশাস্ত্রানুসারে কহিলেন, ‘ধৰ্ম্মনন্দন! অধিকতর অধ্যয়ন, তপানুষ্ঠান, দান, শ্রদ্ধা, যজ্ঞানুষ্ঠান, ক্ষমা, সরলতা, দয়া, সত্য ও সংযম এই সমুদয় ধৰ্ম্মের সম্পত্তি। অতএব আপনি অবিচলিতচিত্তে ধৰ্ম্মই অবলম্বন করুন। ধৰ্ম্ম সর্ব্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট পদার্থ। ধর্ম্মপ্রভাবে ঋষিগণ সংসারসাগর হইতে উত্তীর্ণ হইয়াছেন। সমুদয় লোক ধর্ম্মে প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। দেবগণ ধৰ্ম্মবলসহকারে উন্নতিলাভ করিয়াছেন এবং অর্থ ধৰ্ম্মেরই অনুগত। অতএব ধর্ম্মই সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর। পণ্ডিতগণ ধৰ্ম্মকে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ, অর্থকে মধ্যম ও কামকে নিকৃষ্ট বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া গিয়াছেন। অতএব সংযতচিত্তে সতত ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করা অবশ্য কর্ত্তব্য।”

কৰ্ম্মরণে অর্জুনের যুধিষ্ঠিরানুরোধ

মহাত্মা বিদুর এই কথা কহিলে ধর্ম্মার্থতত্ত্বজ্ঞ অর্থশাস্ত্রবিশারদ মহামতি অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘রাজন্‌! এই কৰ্ম্মভূমিতে কৰ্ম্মই সৰ্ব্বাপেক্ষা প্রশংসনীয়। অর্থ আবার কৃষি, বাণিজ্য, পশুপালন ও শিল্প প্রভৃতি সমুদয় কর্ম্মের মূল কারণ। অর্থ ভিন্ন ধর্ম্ম ও কাম লাভ হইবার সম্ভাবনা নাই। অর্থবান ব্যক্তি অনায়াসে অতি উৎকৃষ্ট ধৰ্ম্ম আচরণ ও দুর্ল্লভ অভিলষণীয় দ্রব্য লাভ করিতে সমর্থ হয়েন। ধর্ম্ম ও কাম অর্থের অঙ্গস্বরূপ। অর্থসিদ্ধি হইলেই ঐ উভয় সুসম্পন্ন হয়। সৎকুলসম্ভূত ব্যক্তিরাও সতত ব্রহ্মার ন্যায় অর্থবান ব্যক্তির উপাসনা করিয়া থাকেন। ব্রহ্মচারীরাও মস্তকমুণ্ডন ও জটাজিন ধারণপূর্ব্বক দান্ত, ভস্মদিগ্ধাঙ্গ [ভস্মলিপ্ত দেহ] ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া অর্থের নিমিত্ত স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র অবস্থান করেন। বিদ্বান ও শান্তগুণাবলম্বী ব্যক্তিরা সমুদয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক কায়বস্ত্রধারী ও শ্মশ্রুল [শ্মশ্রুধারী—দাড়ি রাখিয়া] হইয়াও অর্থের অন্বেষণ করিয়া থাকেন। অর্থলাভের আকাঙ্ক্ষাতেই লোকে আস্তিক, নাস্তিক ও সংযমী এবং কুলক্রমাগত ধর্ম্মের অনুষ্ঠানে যত্নবান হয়। যিনি ভূতগণকে ভোগপ্রদান ও দণ্ডদ্বারা শত্রুগণকে পরাজয় করেন, তিনি যথার্থ অর্থবান। ফলতঃ আমার মতে অর্থ সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। হে মহারাজ! আমার যাহা অভিপ্রায়, তাহা ব্যক্ত করিলাম, এক্ষণে নকুল ও সহদেব অভিপ্রায় ব্যক্ত করিবার নিমিত্ত উৎসুক হইয়া রহিয়াছে; অতএব উহাদিগের বাক্য শ্রবণ করুন।”

ভীম নকুল সহদেবাদির ধর্ম্মাচরণে অনুরোধ

মহাত্মা অৰ্জ্জুন এই বলিয়া নিরস্ত হইলে ধর্ম্মার্থবেত্তা মাদ্ৰীতনয় নকুল ও সহদেব যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘ধৰ্ম্মরাজ! মনুষ্য শয়ন, উপবেশন বা বিচরণ করুক, সকল অবস্থাতেই নানাপ্রকার উপায় অবলম্বনপূৰ্ব্বক অর্থসংস্থান চেষ্টা করিবে। অর্থ পরম প্রিয় ও নিতান্ত দুর্ল্লভ। উহা অধিকৃত হইলে এই জীবলোকে সকল অভিলাষই সফল হইয়া থাকে। ধৰ্ম্মসংযুক্ত অর্থ এবং অর্থসংযুক্ত ধৰ্ম্ম অমৃতমিশ্রিত মধুর ন্যায় পরমরমণীয়। যে ব্যক্তি অর্থহীন, তাহার কোন বাসনাই পরিপূর্ণ হয় না এবং যিনি ধর্ম্মপরায়ণ নহেন, তাঁহার অর্থসদ্ভাব [অর্থের স্বচ্ছলতা] হওয়া নিতান্ত দুর্ল্লভ। যে ব্যক্তি ধর্ম্ম ও অর্থশূন্য তাহা হইতে সমুদয় লোক ভীত হইয়া থাকে; অতএব ধর্ম্মকে প্রধান আশ্রয় করিয়া অর্থসাধনে যত্নবান হওয়া অতীব কর্ত্তব্য। যাহারা আমাদিগের এই বাক্যে বিশ্বাস করে, তাহাদিগের কিছুই দুর্ল্লভ হয় না। ফলতঃ লোকে অগ্রে ধর্ম্মের অনুষ্ঠান, পরে ধর্ম্মের অবিরোধে অর্থোপার্জ্জন এবং তৎপরে, কামপ্রবৃত্তির চরিতার্থতা সম্পাদন করিবে।”

নকুল ও সহদেব এই কথা বলিয়া বিরত হইলে ভীমসেন কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! যে ব্যক্তি কামনাশূন্য, সে কখনই ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কামের বাসনা করে না; অতএব কামই ত্রিবর্গের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ফলমূলাশী [ফলমূলাহারী], বায়ুভক্ষ, ইন্দ্রিয়নিগ্রহশীল, বেদবেদান্তপারগ, স্বাধ্যায়নিরত মহর্ষিগণ কামপ্রভাবে শ্রদ্ধা, যজ্ঞ, দান, প্রতিগ্রহ ও তপস্যায় নিত্য নিরত রহিয়াছেন। বণিক্‌, কৃষক, শিল্পী ও দেবশিল্পীগণ কামপ্রভাবেই স্ব স্ব কার্য্যে নিযুক্ত হইতেছে। অনেকে কামপ্রভাবে সাগরমধ্যে প্রবেশ করিতেছে। কাম নানাপ্রকার। কামদ্বারাই সমুদয় ব্যাপ্ত রহিয়াছে। কামশূন্য জীব কখনই জন্মে নাই, জন্মিবে না এবং এখনও বর্ত্তমান নাই; অতএব কামই সার পদার্থ। ধর্ম্ম ও অর্থ ইহাতেই নিহিত রহিয়াছে। যেমন দধি অপেক্ষা নবনীত, তিল অপেক্ষা তৈল, তক্ৰ অপেক্ষা ঘৃত, কাষ্ঠ অপেক্ষা পুষ্প ও ফল উৎকৃষ্ট, তদ্রূপ ধৰ্ম্ম ও অর্থ অপেক্ষা কামই শ্রেয়ঃ। পুষ্প হইতে যেমন মধু উৎপন্ন হয়, তদ্রূপ কাম হইতে সুখসঞ্চার হইয়া থাকে; কাম ধৰ্ম্মার্থের উৎপত্তিস্থান ও আত্মার স্বরূপ। কাম না থাকিলে কেহই উপাদেয় মিষ্টান্ন ভক্ষণ বা ব্রাহ্মণগণকে ধন দান করিত না। ফলতঃ কামের প্রভাবেই লোকে নানাপ্রকার কার্য্যে লিপ্ত রহিয়াছে। অতএব ধর্ম্মার্থ অপেক্ষা কামই উৎকৃষ্ট। হে মহারাজ! আপনি কামপ্রভাবে বিবিধ অলঙ্কারে অলঙ্কৃত মদমত্ত প্রিয়দর্শন প্রমদাগণের সহিত বিহার করুন। কামই আমাদিগের উক্ত সম্পাদন করিয়া থাকে। আমি ধর্ম্মার্থকামের মৰ্ম্ম অবগত হইয়া এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়াছি। আপনি ইহাতে আর অণুমাত্রও সংশয় করিবেন না। সাধুলোকেরা আমার এই উৎকৃষ্ট সারবাক্য অবশ্যই সমাদর করিবেন। ফলতঃ ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গকেই তুল্যরূপে সেবা করা অবশ্য কর্ত্তব্য। যে মনুষ্য উহাদের মধ্যে একটির প্রতি সবিশেষ পক্ষপাত প্রদর্শন করে, সে অতি জঘন্য, যে ব্যক্তি তুল্যরূপে দুইটির সেবা করে, সে মধ্যম আর যে ব্যক্তি সমভাবে ত্রিবর্গেরই অনুষ্ঠান করিয়া থাকে, সে সর্ব্বোৎকৃষ্ট।”

চন্দনচর্চ্চিতকলেবর বিচিত্রমাল্যধারী মহাবীর ভীমসেন এইরূপে কামের সবিশেষ প্রশংসা করিয়া বিরত হইলেন।”

যুধিষ্ঠিরের নিষ্কামধৰ্ম্ম-প্রশংসা

অনন্তর পরম সুপণ্ডিত ধর্ম্মপরায়ণ রাজা যুধিষ্ঠির তাঁহাদের পাঁচজনের বাক্য শ্রবণ ও তাহা সম্যক পর্য্যালোচনা করিয়া সমুদয় অসার বোধ হওয়াতে তাঁহাদিগকে কহিলেন, ‘হে ধৰ্ম্মজ্ঞগণ! তোমরা সকলেই ধৰ্ম্মশাস্ত্রের মর্ম্ম অবগত হইয়াছ। তোমরা আমাকে যেসমস্ত কথা কহিলে, তৎসমুদয়ই শ্রবণ করিলাম। এক্ষণে আমি যাহা কহিতেছি, তোমরা তাহা অনন্যমনা হইয়া শ্রবণ কর। যে মহাত্মা পাপানুষ্ঠান বা পুণ্যাচরণ করেন না, ত্রিবর্গের কিছুমাত্র অপেক্ষা রাখেন না, লোষ্ট্র ও কাঞ্চনকে তুল্যরূপে দর্শন করেন এবং কোন দোষেই লিপ্ত হয়েন না, তিনি সুখদুঃখ ও অর্থসিদ্ধি হইতে বিমুক্ত হইতে পারেন। এই জীবলোকে সমুদয় জীবই জন্মমৃত্যুশৃঙ্খলে সংযুত এবং জরা বিকারের আয়ত্ত। ইহারা ঐ সমস্ত দুরতিক্ৰমণীয় ব্যাপারে বারংবার নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া মোক্ষকে সবিশেষ প্রশংসা করিয়া থাকে। এক্ষণে সেই মোক্ষ যে কি পদার্থ, তাহা আমরা কিছুমাত্র অবগত নহি। ভগবান্ ব্রহ্মা কহিয়াছেন, যাহারা সংসারস্নেহে সংযত থাকে, তাহাদিগের কখনই মুক্তিলাভ হয় না; আর যাঁহারা সাংসারিক সুখদুঃখে কদাপি অভিভূত না হয়েন, তাঁহারাই মুক্তিলাভে সমর্থ হইয়া থাকেন। অতএব কোন বস্তুকেই প্রিয় বা অপ্রিয় বিবেচনা করা কর্ত্তব্য নহে। আমি যাহা কহিলাম, ইহাই সার। যাহা হউক, এই ভূমণ্ডলে কেহ আপনার ইচ্ছানুসারে কৰ্ম্ম করিতে পারে না। বিধাতা আমাকে যে কার্য্যে নিযুক্ত করিয়াছেন, আমি তাহাই করিতেছি। ভগবান্ বিধাতা সমুদয় প্রাণীকেই স্ব স্ব কার্য্যে নিযুক্ত করিতেছেন, সুতরাং তিনিই বলবান্। ফলতঃ মনুষ্য যখন ত্রিবর্গবিহীন হইলেও মোক্ষলাভে সমর্থ হয়, তখন মোক্ষই আমার মতে সর্ব্বাপেক্ষা হিতকর, সন্দেহ নাই।”

ধৰ্ম্মনন্দন এই কথা কহিলে অৰ্জ্জুন প্রভৃতি বীরগণ তাঁহার হেতুগর্ভ মনোগত বাক্যশ্রবণে যারপরনাই সন্তুষ্ট হইলেন এবং কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাকে প্রণাম করিলেন। অন্যান্য পার্থিবগণও ধৰ্ম্মরাজের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া উহার সবিশেষ প্রশংসা করিতে লাগিলেন। তখন ধর্ম্মরাজ তাঁহাদিগের প্রীতিদর্শনে হৃষ্টচিত্তে তাঁহাদিগের প্রশংসা করিয়া পুনরায় বিজ্ঞবরাগ্রগণ্য জাহ্নবীতনয় ভীষ্মের নিকট গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে পরম ধৰ্ম্ম জিজ্ঞাসা করিলেন।