১৮০. প্রজ্ঞার প্রশংসা—ইন্দ্র-কাশ্যপসংবাদ

১৮০তম অধ্যায়

প্রজ্ঞার প্রশংসা—ইন্দ্র-কাশ্যপসংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, ‘পিতামহ। বান্ধব, কৰ্ম্ম, ধন ও প্রজ্ঞা এই সমুদয়ের মধ্যে মনুষ্য কাহাকে আশ্রয় করিলে সুখী হইতে পারে, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! প্রজ্ঞাই প্রাণীগণের পরমোৎকৃষ্ট আশ্রয়। প্রজ্ঞালাভের তুল্য, পরমলাভ আর কিছুই নাই। প্রজ্ঞাই মোক্ষ ও স্বর্গলাভের একমাত্র উপায়। মহাত্মা বলি, প্রহ্লাদ, নমুচি ও মঙ্কি স্বীয় ঐশ্বৰ্য্য বিনষ্ট হইলে পর একমাত্র প্রজ্ঞাপ্রভাবেই শ্ৰেয়োলাভ করিয়াছিলেন। ফলতঃ প্রজ্ঞার তুল্য পরমপদার্থ আর কিছুই নাই। আমি এই উপলক্ষে ইন্দ্র-কাশ্যপসংবাদ নামক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

“একদা এক ধনবান্ বৈশ্য গর্ব্বিত হইয়া এক কশ্যপকুলসম্ভূত তপোধনকে রথচক্রাঘাতে নিপীড়িত করিয়াছিল। ঋষিকুমার সেই আঘাতে নিতান্ত ব্যথিত ও অধৈৰ্য্য হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন এবং মনোমধ্যে যারপরনাই নিৰ্ব্বেদ উপস্থিত হওয়াতে প্রাণত্যাগে কৃতনিশ্চয় হইয়া কহিলেন, ইহলোকে নিৰ্দ্ধন ব্যক্তির জীবিত থাকা বিড়ম্বনা মাত্র; অতএব আমি নিশ্চয়ই প্রাণ পরিত্যাগ করিব।

বৈশ্যবঞ্চিত বিপ্র ও শৃগালরূপী ইন্দ্ৰবৃত্তান্ত

“তপোধন মনে মনে ক্ষুব্ধচিত্ত হইয়া আত্মত্যাগে কৃতসংকল্প হইলে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহার দুঃখদর্শনে দয়ার্দ্র হইয়া শৃগালরূপ ধারণপূৰ্ব্বক তাঁহার নিকট আগমন করিয়া কহিলেন, ‘তপোধন! সমুদয় প্রাণীই মনুষ্যযোনিপ্রাপ্ত হইতে অভিলাষ করে। মনুষ্যের মধ্যে আবার ব্রাহ্মণজাতিপ্রাপ্ত হওয়া সকলেরই প্রার্থনীয়। তুমি মনুষ্য, ব্রাহ্মণ, বিশেষতঃ শ্ৰোত্ৰিয়; অতএব কি নিমিত্ত সুদুর্ল্লভ জন্ম লাভ করিয়া মূঢ়তাবশতঃ মৃত্যু কামনা করিতেছ? ধনলাভ কেবল অহঙ্কারের হেতু। তুমি ধনলোভনিবন্ধন কি নিমিত্ত স্বীয় মনুষ্যদেহ বিনষ্ট করিতে অভিলাষী হইতেছ? ইহলোকে যাঁহাদিগের হস্ত আছে, তাঁহারাই কৃতার্থ বলিয়া পরিগণিত হয়েন। তোমার যেমন ধনলাভে নিতান্ত বাসনা হইয়াছে, আমরাও তদ্রূপ হস্তলাভের নিমিত্ত নিয়ত অভিলাষ করিয়া থাকি। হস্তলাভের তুল্য উৎকৃষ্ট লাভ আর কিছুই নাই। আমরা পাণিবিহীন হইয়াছি বলিয়াই কণ্টক উদ্ধার ও দংশমশকাদি দংশনপরায়ণ প্রাণীগণকে বিনাশ করিতে পারি না, কিন্তু যাঁহাদিগের ঈশ্বরপ্রদত্ত দশাঙ্গুলিসমন্বিত হস্তদ্বয় বিদ্যমান আছে, তাঁহারা অনায়াসেই অঙ্গ হইতে কৃমিগণকে উদ্ধার, কণ্ডুয়নদ্বারা দংশননিরত প্রাণীগণকে বিনাশ, বর্ষা, হিম ও রৌদ্র হইতে আত্মরক্ষা এবং উৎকৃষ্ট বস্ত্র, ভোজ্য, শয্যা ও বাসস্থান লাভ করিতে সমর্থ হয়েন। ইহলোকে মানবগণ হস্তসম্পন্ন হইয়াছে বলিয়াই গো প্রভৃতি পশুগণদ্বারা ভারবহন করাইয়া লয় এবং আত্মসুখভোগের নিমিত্ত বিবিধ উপায়দ্বারা উহাদিগকে বশীভূত করিয়া রাখে। ফলতঃ যাহারা অজিহ্ব, অল্পবল ও হস্তবিহীন, তাহাদিগকে প্রতিনিয়ত অশেষ দুঃখ ভোগ করিতে হয়।

‘তুমি আপনার সৌভাগ্যবলে উৎকৃষ্ট ব্রাহ্মণকুলে উৎপন্ন হইয়াছ এবং শৃগাল, কৃমি, মূষিক, সর্প বা মণ্ডুককুলে অথবা অন্য কোন পাপযোনিতে জন্মগ্রহণ কর নাই। এই লাভেই তোমার সন্তুষ্ট থাকা আবশ্যক। এই দেখ, কৃমিগণ আমাকে নিরন্তর দংশন করিতেছে, কিন্তু আমি হস্তাভাবনিবন্ধন উহাদিগকে গাত্র হইতে উদ্ধার করিতে পারিতেছি না। এক্ষণে যদি আমি এই যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হইয়া প্রাণ পরিত্যাগ করি, তাহা হইলে আমাকে ইহা অপেক্ষাও অপকৃষ্ট যোনিতে জন্মগ্রহণ করিতে হইবে। এই ভয়ে আমি প্রাণত্যাগ করিতেছি না। আমি যে পাপযোনিতে জন্মগ্রহণ করিয়াছি, ইহা মধ্যবিধ। ইহা অপেক্ষাও বহুতর অপকৃষ্ট যোনি বিদ্যমান রহিয়াছে। হস্তপদাদির সদ্ভাব ও অসদ্ভাবনিবন্ধন একজাতীয় প্রাণীগণকে অন্যজাতীয় প্রাণীগণ অপেক্ষা সুখী লক্ষিত হয় বটে, কিন্তু কি দেবতা, কি মনুষ্য, কি পশুপক্ষী প্রভৃতি কাহাকেও সম্পূর্ণ সুখী দেখিতে পাওয়া যায় না।

আশাবৃদ্ধিতে আসক্তিবৃদ্ধি—প্রজ্ঞায় আসক্তিনাশ

‘মনুষ্যগণ প্রথমতঃ আঢ্যতা [স্বপ্ন কল্পিত স্বপ্নে দুইটি মস্তক, তিনখানা হস্তদর্শন, তৎসঙ্গে একটি মস্তক ও একখানা হাত কৰ্ত্তনদর্শন। দ্বিতীয় মস্তক ও তৃতীয় হস্ত যেমন মিথ্যা নিষ্ফল, হর্ষ-শোকও তদ্রূপ অলীক অকিঞ্চিৎকর] লাভ করিয়া রাজ্য, রাজ্যলাভানন্তর দেবত্ব ও দেবত্বলাভের পর ইন্দ্ৰত্বলাভ করিতে বাঞ্ছা করিয়া থাকে। যদিও তুমি ধনবান্ হও, তথাপি ব্ৰহ্মণত্ব প্রযুক্ত রাজ্যলাভে অসমর্থ হইবে। যদি কথঞ্চিৎ রাজ্যলাভ করিতে পার, তাহা হইলে দেবত্বলাভে অভিলাষ করিবে এবং দেবত্বলাভ করিলে ইন্দ্ৰত্বপ্রাপ্ত হইতে অভিলাষী হইবে। কিন্তু তুমি ধনাঢ্যই হও কিংবা রাজত্ব, দেবত্ব বা ইন্দ্রত্ব লাভ কর, কোন অবস্থাতেই পরিতুষ্ট হইতে পারিবে না। প্রিয়লাভদ্বারা মানবগণের কখনই তৃপ্তিলাভ হয় না। বিষয়লাভ হইলে তাহাদিগের বিষয়তৃষ্ণা শান্ত না হইয়া সমিধসম্পন্ন [কাষ্ঠপ্রাপ্ত] হুতাশনের ন্যায় উত্তরোত্তর পরিবর্দ্ধিত হইয়া থাকে। আর দেখ, তোমাতেই তোমার শোক, হর্ষ ও সুখদুঃখসমুদয় বিদ্যমান রহিয়াছে; অতএব এক্ষণে এরূপ বিলাপ না করিয়া হর্ষদ্বারা শোক মাৰ্জ্জন করাই তোমার কর্ত্তব্য। যে ব্যক্তি বাসনা ও কাৰ্য্যসমুদয়ের মূলস্বরূপ বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়গ্রামকে পিঞ্জর বদ্ধ পক্ষিগণের ন্যায় শরীরমধ্যে রুদ্ধ করিতে পারেন এবং যিনি কল্পিত দ্বিতীয় মস্তক ও তৃতীয় বাহুচ্ছেদজনিত দুঃখচিন্তার ন্যায় দ্বৈতভাব পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হয়েন, তাঁহাকে কদাপি ভীত হইতে হয় না। স্পর্শন, দর্শন ও শ্রবণ প্রভৃতি কাৰ্য্য হইতেই কামের উদ্ভব হইয়া থাকে। অতএব যে ব্যক্তি বুদ্ধিপ্রভাবে রসজ্ঞানবিহীন হইতে পারে, কাম তাঁহাকে কখনই আক্রমণ করিতে পারে না। এই পৃথিবীর ভক্ষ্যদ্রব্যসমুদয়ের মধ্যে তুমি যে যে দ্রব্য কখন ভোজন কর নাই, তাহার কিরূপ আস্বাদ, তাহা কখনই তোমার হৃদয়ঙ্গম হয় না। দেখ, মদ্য ও লড্বক [লড্বকনামক পক্ষী—নড়াক পাখী] পক্ষীর মাংস এই উভয়ের তুল্য সুখজনক ভক্ষ্য আর কিছুই নাই; কিন্তু ঐ উভয়ের যে কিরূপ আস্বাদ, তাহা তুমি কখনই বুঝিতে পারিবে না; অতএব অপ্রাশন [অভোজন—না খাওয়া], অসংস্পর্শ ও অদর্শনরূপ ব্রত অবলম্বন করাই পুরুষের শ্রেয়স্কর, সন্দেহ নাই।

আর দেখ, হস্তসমন্বিত বলবান ও ধনবান্ মনুষ্যেরাও অন্য মনুষ্যের নিকট দাসত্ব স্বীকার করিয়া বারংবার বন্ধনভয়ে ভীত হইয়াও হাস্যকৌতুক ও বিহারাদিদ্বারা কাল হরণ করিতেছে। অনেক বাহুবলসম্পন্ন কৃতবিদ্য ব্যক্তি সৎকার্য্য অনুষ্ঠানে যত্নবান হইয়াও ভবিতব্যতার অখণ্ডনীয়ত্ব [অমোঘত্ব –অবশ্যম্ভাবনীয়তা] প্রভাবে অতি ঘৃণিত নীচবৃত্তি অনুশীলন করিয়া থাকেন। চণ্ডালও মায়াপ্রভাবে সন্তুষ্ট থাকিয়া আপনাকে নীচ জ্ঞান বা আত্মপরিত্যাগের ইচ্ছা করে না। এই ভূমণ্ডলে অসংখ্য মনুষ্য বিকলহস্ত, পক্ষহত ও বিবিধ রোগাক্রান্ত হইয়া অবস্থান করিতেছে। তুমি তাহাদিগকে দেখিয়া আপনাকে অপেক্ষাকৃত সুখী বলিয়া বিবেচনা কর। যদি তোমার দেহ ভয়শূন্য ও রোগবিহীন এবং অঙ্গসমুদয় অবিকল হয় তাহা হইলে তুমি কখনই জনসমাজে ধিকৃত বা জাতিভ্রংশকর অপবাদে আক্রান্ত হইবে না; অতএব এক্ষণে তুমি আত্মপরিত্যাগের বাসনা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ধৰ্ম্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হও। যদি তুমি শ্রদ্ধান্বিত হইয়া আমার এই সমুদয় বাক্য হৃদয়ঙ্গম কর, তাহা হইলে অবশ্যই বেদোক্ত ধৰ্ম্মের ফললাভে সমর্থ হইবে। এক্ষণে তুমি অপ্রমত্ত হইয়া বেদাধ্যয়ন, অগ্নিসংস্কার, সত্যানুষ্ঠান, দান ও দমগুণ আশ্রয় কর। কাহারও সহিত স্পর্দ্ধা করিও না। যাঁহারা স্বাধ্যায়নিরত হইয়া যজন ও যাজনকার্য্যে অধিকারী হইয়াছেন, তাঁহারা কখন শোক অথবা অশুভ চিন্তা করেন না। যাঁহারা শুভ নক্ষত্র, শুভ মুহূৰ্ত্ত ও শুভ তিথিতে জন্মগ্রহণ করেন, তাঁহারা সাধ্যানুসারে যজ্ঞ, দান ও পুত্রোৎপাদনে যত্নবান্ হইয়া যারপরনাই সুখসম্ভোগ করিয়া থাকেন। আর যাহারা আসুর [উগ্রনক্ষত্ৰজাত ব্যক্তি উগ্ৰপ্রকৃতি হয়] নক্ষত্রে, কুতিথিতে ও অশুভক্ষণে জন্মগ্রহণ করে, তাহাদিগকে নিশ্চয়ই যজ্ঞফলবিহীন হইয়া পরিশেষে আসুরযোনিতে উৎপন্ন হইতে হয়।

শৃগালরূপী ইন্দ্রের উপদেশে কাশ্যপের মোহনাশ

‘আমি পূৰ্ব্বজন্মে বেদনিন্দক, পুরুষার্থশূন্য আম্বীক্ষিকী [তর্ক] বিদ্যায় অনুরক্ত কুতর্কপরায়ণ, নাস্তিক ও পাণ্ডিত্যাভিমানী মূর্খ ছিলাম। বিচারস্থলে কূটবাক্যপ্রয়োগ ও উচ্চৈঃস্বরে বক্তৃতা করিতাম। সেই নিমিত্ত এক্ষণে আমাকে শৃগালত্ব প্রাপ্ত হইয়া স্বীয় কৰ্ম্মানুরূপ ফলভোগ করিতে হইতেছে। অতঃপর যদি শত শত দিবারাত্রি অবসানেও আমার পুনরায় মনুষ্যযোনি লাভ হয়, তাহা হইলে আমি সতত সন্তুষ্ট, অপ্রমত্ত, যজ্ঞদাননিরত ও তপস্যায় একান্ত আসক্ত হইয়া জ্ঞাতব্য বিষয়ে জ্ঞানলাভ ও পরিত্যাজ্য বিষয় পরিত্যাগ করিব।’

“শৃগালরূপী ইন্দ্র এই কথা কহিলে কাশ্যপ সহসা গাত্রোত্থানপূৰ্ব্বক বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে শৃগালকে কুশলী ও বুদ্ধিমান বলিয়া প্রশংসা করিবামাত্র দিব্যজ্ঞান লাভ করিয়া তাহাকে দেবরাজ ইন্দ্র বলিয়া বুঝিতে পারিলেন। তখন তিনি যারপরনাই আহ্লাদিত হইয়া সুররাজের যথাবিধি পূজা করিয়া তাঁহার অনুজ্ঞা গ্রহণপূর্ব্বক স্বীয় আবাসে প্রস্থান করিলেন।”