৮৮তম অধ্যায়
হস্তিনানগর-প্রবিষ্ট কৃষ্ণের অভ্যর্থনা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নরনাথ! এ দিকে ভগবান দেবকীনন্দন প্রভাতসময়ে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক আহ্নিককার্য্যসকল সমাপন করিয়া ব্রাহ্মণগণের অনুমতি গ্রহণপূর্ব্বক নগরাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন; বৃকস্থলনিবাসী ব্যক্তিগণ সেই মহাবাহুর চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিয়া গমন করিতে লাগিল। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ প্রভৃতি মহাত্মাগণ ও দুৰ্য্যোধন ব্যতীত ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ৰসকল তাহার প্রত্যুদগমন নিমিত্ত গমন করিলেন, পুরবাসিগণ কৃষ্ণদৰ্শনমানসে কেহ কেহ বহুবিধ যানে আরোহণ করিয়া ও কেহ কেহ বা পদব্রজে গমন করিতে লাগিল।
অনন্তর মহাত্মা বাসুদেব অক্লিষ্টকর্মী ভীষ্ম, দ্রোণ ও ধৃতরাষ্ট্ৰনন্দনগণে পরিবৃত হইয়া নগরমধ্যে প্রবেশ করিলেন। কৃষ্ণের সম্মান নিমিত্ত নগর অলঙ্কৃত ও রাজমার্গ [রাজপথ-রাজা ও রাজপুরুষেরা সাধারণতঃ যে পথে যাতায়াত করেন-বড় বড় রাস্তা] বহুবিধ রত্বে সমাচিত [সাজান] হইয়াছিল; আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই কৃষ্ণদৰ্শনমানসে গৃহ হইতে বহির্গত হইয়াছিল। কৃষ্ণ নগরে প্রবেশ করিবামাত্র তত্ৰস্থ সমুদয় লোকেই রাজমার্গে দণ্ডায়মান হইয়া তাঁহার স্তুতিপাঠ করিতে লাগিল। সেই সময় বরস্ত্রীগণসমধিষ্ঠিত [উত্তম স্ত্রীজনাধ্যুষিত-প্রধান প্রধান নারীরা যে স্থানে থাকেন] লতাগৃহসকল প্ৰচলিতের [কম্পিতের ন্যায়] ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। বাসুদেবের অশ্বসমুদয় বায়ুবেগগামী; কিন্তু রাজমাৰ্গ জনতায় আবৃত হওয়াতে তাদের গতি নষ্টপ্ৰায় হইয়া উঠিল।
কৃষ্ণের কৌরবসম্ভাষণ-সভাপ্রবেশ-সৎকার
অনন্তর কিয়ৎক্ষণ পরে মহাত্মা বাসুদেব বহুপ্রাসাদশোভিত পাণ্ডুরবর্ণ ধৃতরাষ্ট্রভবনে প্রবেশ করিলেন; ক্ৰমে ক্ৰমে তিন কক্ষা [প্রকোষ্ঠ-মহাল] অতিক্রম করিয়া পরিশেষে ধৃতরাষ্ট্রের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। মহাযশাঃ প্রজ্ঞাচক্ষু [অন্ধ বলিয়া দেখিতে না পাইলেও জ্ঞানচক্ষে কৃষ্ণগমন প্রত্যক্ষ হইয়াছিল] ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, সোমদত্ত ও মহারাজ বাহ্লীক, ইহারা সকলে তৎক্ষণাৎ আসন হইতে গাত্ৰোত্থান করিয়া কৃষ্ণকে পূজা করিতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা কৃষ্ণ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ও ভীষ্মকে বিনীতবাক্যে পূজা করিয়া বয়ঃক্রমানুসারে ক্রমে ক্রমে সমুদয় ভূপতিগণের সহিত মিলিত হইলেন; পরে বাহ্লীক, অশ্বত্থামা, কৃপ ও সোমদত্তের সহিত একত্র সমাসীন যশস্বী দ্রোণাচাৰ্য্যের সমীপে গমন করিলেন। ঐ স্থানে অতি মহৎ পরিশুদ্ধ কাঞ্চনময় আসন পতিত ছিল; মহাত্মা অচ্যুত ধৃতরাষ্ট্রের নির্দ্দেশানুসারে তাহাতে উপবেশন করিলেন। তখন ধৃতরাষ্ট্রের পুরোহিতগণ ন্যায়ানুসারে কৃষ্ণকে গো, মধুপর্ক ও উদক প্রদান করিলেন। মহাত্মা গোবিন্দ আতিথ্য গ্রহণ করিয়া কুরুবংশীয়গণের সহিত সম্বন্ধোচিত পরিহাস ও কথোপকথনাদি করিতে লাগিলেন।
এইরূপে মহাত্মা মধুসূদন ধৃতরাষ্ট্রকর্ত্তৃক বিধানানুসারে পূজিত হইয়া তাঁহার গৃহ হইতে বহির্গত হইলে, পরে কুরুসভায় উপস্থিত ও যথানিয়মে কৌরবগণের সহিত সমবেত হইয়া বিদূরীভবনে গমন করিলেন। মাহাত্মা বিদুর অতিথি-সৎকারোপযোগী দ্রব্যজাতদ্বারা কৃষ্ণকে অর্চ্চনা করিয়া কহিলেন, “হে পুণ্ডরীকাক্ষ! তোমার দর্শনে আমি যেরূপ প্রীত হইয়াছি, তাহা তোমাকে আর কি বলিব। তুমি সর্ব্বজীবের অন্তরাত্মা, তোমার কিছুই অবিদিত নাই।” মহাপ্রাজ্ঞ বিদুর এইরূপে মহাত্মা মধুসূদনের আতিথ্য করিয়া তাঁহাকে পাণ্ডবগণের কুশলবার্ত্তা জিজ্ঞাসা করিলেন। বৃষ্ণিবংশাবতংস মধুসূদন পরমসুহৃৎ, ধর্ম্মার্থতৎপর, ক্ৰোধবিবর্জিত, হৃষ্টচিত্ত, ধীমান বিদুরের নিকট পাণ্ডবগণের সমুদয় বৃত্তান্ত সবিশেষ বর্ণন করিলেন।