৮৯তম অধ্যায়
কৃষ্ণদৰ্শনে কুন্তীর পুত্রদিগের দুঃখস্মৃতি
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মহাত্মা জনাৰ্দন বিদুরকে সম্ভাষণ করিয়া অপরাহ্নে পিতৃষ্কসা [পিতার ভগিনী-পিসি] কুন্তীর নিকট গমন করিলেন। পুত্ৰবৎসলা পৃথা [কুন্তী] বহুদিনের পর স্বীয় তনয়গণের সহায় যদুকলতিলক বাসুদেবকে নয়নগোচর করিয়া তাঁহার কণ্ঠধারণপূর্ব্বক স্বীয় পুত্ৰগণের নাম পৃথক পৃথক উল্লেখ করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। পরে তিনি কৃষ্ণের যথাবিধি আতিথ্য সমাপন করিয়া বাষ্পগদগদ-বচনে ম্লানবিদনে কহিতে লাগিলেন, “হে কেশব! যাহারা বাল্যাবধি গুরুশুশ্রূষায় একান্ত নিরত, যাহাদের পরস্পর সৌহার্দ কদাপি বিনষ্ট হয় না, যাহাদিগের চিত্তবৃত্তি বিভিন্ন নহে, যাহারা শত্ৰুগণের শঠতায় রাজ্যভ্ৰষ্ট হইয়া নির্জ্জনে গমন করিয়াছিল, ক্রোধ ও হর্ষ যাহাদের বশীভূত, আমি রোদন করিলেও যাহারা আমাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক অরণ্যে গমন করিয়া আমার হৃদয় সাতিশয় উৎকণ্ঠিত করিয়াছিল, সেই দেবপরায়ণ সত্যবাদী পাণ্ডবগণ কিরূপ সিংহব্যাঘ্র সমাকুল মহারণ্যে বাস করিয়াছিল? আহা! তাহারা বাল্যকালেই পিতৃবিহীন হইয়াছে; কেবল আমিই তাহাদিগকে লালন-পালন করিয়াছি; তাহারা পিতামাতা উভয়কে অবলোকন না করিয়া কিরূপে মহাবনে বাস করিয়াছিল? তাহারা বাল্যাবধি শঙ্খ, দুন্দুভি [ঢাক্কা-ঢাকা], মৃদঙ্গ ও বেণুর [বাঁশীর] নিনাদ, করিবৃংহিত [গজের গর্জ্জন] অশ্বহ্রেষিত [অশ্বের শব্দ-হ্ৰেষারব] এবং রথনেমিনির্ঘোষে [রথচক্র শব্দে] প্রতিবোধিত হইত। ব্রাহ্মণগণ শঙ্খ, ভেরী [ঢাক], বেণু ও বীণার নিনাদের সহিত পুণ্যাহাঘোষ [পবিত্র মাঙ্গ লিক শব্দ] মিশ্ৰিত করিয়া তাহাদিগের স্তব করিতেন। তাহারা বিবিধ বস্ত্ৰ, অলঙ্কার ও রত্নদ্বারা ব্ৰাহ্মণগণের অর্চ্চনা করিত। হা বিধাতঃ! যাহারা পূর্ব্বে প্রাসাদে রাঙ্কব-অজিনে [মৃগাচর্মে] শয়ন করিয়া নিদ্রিত ও মহাত্মা ব্ৰাহ্মণগণের স্তুতি-গীতি-শ্রবণে জাগরিত হইত, তাহারা বনমধ্যে ক্রুর শ্বাপদ [হিংস্ৰ জন্তু] গণের অতি ভীষণ শব্দশ্রবণে কদাচ নিদ্রিত হইতে পারিত না। হে কৃষ্ণ! যাহারা পূর্ব্বে ভেরী, মৃদঙ্গ, বীণা ও শঙ্খধ্বনি, বিলাসিনীগণের মধুর গীতি এবং বন্দি[স্তুতিপাঠক]গণের স্তবশ্রবণে প্রতিবোধিত হইয়াছে, সেই মহাত্মারা মহারণ্যমধ্যে হিংস্র ও শ্বাপদগণের চীৎকার-শ্রবণে কিরূপে জাগরিত হইত?
“যে মহাত্মা একান্ত সত্যপরায়ণ, লজ্জাশীল, দয়াপার, কাম ও দ্বেষ যাহার বশীভুত, যে ধর্ম্মাত্মা সতত সাধুলোকের পদবীতেই পদার্পণ করিয়া থাকেন এবং অম্বরীষ, মান্ধাতা, যযাতি, নহুষ, ভরত, দিলীপ ও শিভি প্রভৃতি পূর্ব্বতন ভূপতিগণের ভারগ্রহণ ও বহন করিয়া আসিতেছে, যে ধর্ম্মজ্ঞ শাস্ত্র প্রভাবে সমুদয় কৌরব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও ত্ৰৈলোক্যের আধিপত্যলাভের উপযুক্ত পাত্ৰ, সেই বিশুদ্ধ কাঞ্চনবর্ণ দীর্ঘবাহু অজাতশত্রু যুধিষ্ঠির এক্ষণে কেমন আছেন? যে বীর অযুত-মাতঙ্গ-তুল্য বলশালী, যে ব্যক্তি সতত ভ্রাতার প্রিয়ানুষ্ঠান করিয়া থাকে, যে বীর মহাবাহু কীচক, উপকীচকগণ, বক ও হিড়িম্বকে নিধন করিয়াছে, যাহার পরাক্রম ইন্দ্রের তুল্য, বল বায়ুর তুল্য ও ক্ৰোধ মহেশ্বরের তুল্য, যে অরতিনিপাতন ক্ৰোধনস্বভাব হইয়াও ক্ৰোধ ও বল সংবরণপূর্ব্বক জ্যেষ্ঠভ্রাতার শাসনানুবর্ত্তী হইয়া থাকে, সেই মহাবলপরাক্রান্ত মহাবাহু তেজোরাশি ভীমদৰ্শন ভীমসেন এখন কেমন আছে? যে বীর দ্বিবাহু হইয়াও সহস্ৰবাহু অর্জ্জুনের প্রতি স্পৰ্দ্ধা করিয়া থাকে, যে বীর একবারে পঞ্চশত বাণ নিক্ষেপ করিতে পারে, যে মহাবাহু অস্ত্রশস্ত্রে কর্ত্তবীৰ্য্যের সদৃশ, তেজে আদিত্যসদৃশ, দমে [ইন্দ্ৰিয়সংযমে] মহর্ষিসদৃশ, ক্ষমায় পৃথিবীসদৃশ ও বিক্রমে মহেন্দ্রসদৃশ, যে বীর সমুদয় ভূপতিগণের উপর কৌরবদিগের আধিপত্য সংস্থাপন করিয়াছে, পাণ্ডবগণ যাহার বাহুবল অবলম্বন করিয়া কালাতিপাত করিতেছে, যাহার সহিত সংগ্রাম করিয়া কেহই জীবিতাবস্থায় প্রত্যাবৃত্ত হইতে পারে না, যে বীর সর্ব্বভূতের জেতা ও পাণ্ডবগণের আশ্রয়, সেই সৰ্বরধীশ্রেষ্ঠ, তোমার প্রিয়সখা ও ভ্রাতা ধনঞ্জয় এখন এমন আছে? যে সুকুমারাঙ্গ [সুন্দর দেহ-প্রিয়দর্শন] যুবা সর্ব্বভূতে দয়াবান, লজ্জাশীল, অস্ত্রকোবিদ, ধাৰ্মিক, সভ্য, ভ্রাতৃগণের শুশ্রূষু [সেবাপরায়ণ] ও আমার একান্তপ্রিয় অন্যান্য পাণ্ডবগণ সতত যাহার চরিত্রের প্রশংসা করিয়া থাকে, যে যুবা সতত জ্যেষ্ঠভ্রাতার অনুসরণ করে, সেই মাদ্রীনন্দন সহদেব এখন কেমন আছে? যে প্রিয়দর্শন যুবা ভ্রাতৃগণের বহিশ্চর [ছায়ার মত অনুগামী], প্রাণস্বরূপ ও চিত্ৰযুদ্ধে [নানা প্রকার বৈচিত্ৰ্যময় যুদ্ধ] সাতিশয় নিপুণ, আমি যাহাকে বাল্যাবধি সুখে বর্দ্ধিত করিয়াছি, সেই সুকুমার কলেবর নকুলের ত’ কুশল? হায়! আর কি তাহাকে দেখিব? কি আশ্চৰ্য্য! যে নকুলকে পলকপতনকাল [চক্ষুর পাতা পড়িতে যতটুকু সময় লাগে, ততটুকু সময়] না দেখিয়া অধৈৰ্য্য হইতাম, বহুদিন হইল, তাহাকে না দেখিয়াও জীবিত রহিয়াছি।
“হে জনাৰ্দন! কুলীনা, অসামান্যরূপসম্পন্না দ্রুপদনন্দিনী আমার পুত্ৰগণ অপেক্ষা প্রিয়তর। সে পুত্রসহবাস অপেক্ষা পতিসহবাস শ্লাব্য জ্ঞান করে; তিন্নিমিত্তই সে প্রিয়তর পুত্ৰগণকে পরিত্যাগ করিয়া পতিগণসমভিব্যাহারে অরণ্যে গমন করিয়াছিল। সেই মহাবংশপ্রসূতা কল্যাণী দ্রুপদনন্দিনী এখন কেমন আছে? হায়! সেই পতিপরায়ণা দ্রুপদতনয় অনলতুল্য প্রতাপশালী পঞ্চপতিসমভিব্যাহারে থাকিয়াও দুঃখ ভোগ করিতেছে। আমি সেই পুত্ৰশোকপরিক্লিষ্টা সত্যবাদিনীকে চতুৰ্দশ বৎসর অবলোকন করি নাই। যখন তাদৃশী পুণ্যশীলা দ্রুপদনন্দিনী চিরসুখসম্ভোগে বঞ্চিত হইয়াছেন, তখন স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, মনুষ্য পুণ্যকর্ম্মানুষ্ঠানদ্বারা সুখভোগ করিতে সমর্থ হয় না।
“হে কৃষ্ণ! যে দিন দ্ৰৌপদীকে সভামধ্যে সমাগত দেখিয়াছি, সেই দিন অবধি কি তুমি, কি অর্জ্জুন, কি যুধিষ্ঠির, কি ভীম, কি নকুল, কি সহদেব, কাহাকেও প্রিয় [দ্ৰৌপদীর দুঃখনিবারণে অক্ষমতার অশ্রদ্ধেয়] বলিয়া বোধ হয় না। স্ত্রীধর্মিণী [ঋতুমতী রজঃস্বলা] দ্রৌপদীকে ক্ৰোধলোভপরতন্ত্র দুষ্টগণকর্ত্তৃক সভামধ্যে শ্বশুর গণ-সমীপে সমানীত অবলোকন করিয়া যেরূপ দুঃখিত হইয়াছি, পূর্ব্বে আর কখন সেরূপ দুঃখভোগ করি নাই। সেই সভামধ্যে ধৃতরাষ্ট্র, মহারাজ বাহ্লীক, কৃপ, সোমদত্ত ও সমুদয় কৌরবগণ নির্ব্বিঘ্নচিত্তে [বিষণ্নমনে] একবস্ত্রা দ্ৰৌপদীকে অবলোকন করিতে লাগিলেন; আমার মতে সেই সভাস্থ সমুদয় লোকের মধ্যে বিদুরই পূজ্যতম। লোকে সৎস্বভাবীদ্বারা যেরূপ মান্য হইতে পারে, ধন বা বিদ্যাদ্ধারা তদ্রূপ হইতে পারে না। সেই অগাধবুদ্ধিসম্পন্ন অতিগম্ভীর মাহাত্মা বিদুরের স্বভাব সমুদয় লোককে অতিক্রম করিয়া রহিয়াছে।”
এইরূপে কুন্তী কৃষ্ণসন্দর্শনে শোক ও হর্ষে যুগপৎ [এককালে] অভিভূত হইয়া নানাবিধ দুঃখ প্রকাশপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে অরাতিনিপাতন [শক্রসংহারকারিন] জনাৰ্দন! যে সমুদয় পূর্ব্বতন নিন্দনীয় নৃপতিগণ অক্ষক্রীড়া ও মৃগাবধ করিয়াছেন, তাঁহাদের কি তন্নিবন্ধন সুখভোগ হইয়াছিল? সভামধ্যে কুরুগণ সমক্ষে কৃষ্ণা অবমানিত হওয়াতে আমার হৃদয় যেরূপ দগ্ধ হইতেছে, বোধহয়, মৃত্যুতেও সেইরূপ হয় না। আমি পুত্ৰগণের নির্ব্বাসন, প্ৰব্ৰজ্য [সন্ন্যাসিভাবে গৃহত্যাগ] অজ্ঞাতবাস ও রাজ্যাপহরণ প্রভৃতি নানাবিধ দুঃখে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছি। দুৰ্য্যোধন আমাকে ও আমার পুত্ৰগণকে এই চতুর্দশ বৎসর অপমান করিতেছে, ইহা সহা অপেক্ষা দুঃখের বিষয় আর কি আছে
কিন্তু ইহা কথিত আছে যে দুঃখভোগ করিলে পাপ
ক্ষয় হয়, পরে পুণ্যফলে সুখসম্ভোগ হইয়া থাকে; অতএব আমরা এক্ষণে দুঃখভোগ করিয়া পাপক্ষয় করিতেছি, পশ্চাৎ সুখসম্ভোগ করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই। আমি ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণকে কদাপি স্বীয় পুত্ৰগণ হইতে বিভিন্ন জ্ঞান করি নাই, সেই পুণ্যফলে তোমাকে পাণ্ডবগণসমভিব্যাহারে সমুদয় শত্ৰুগণকে বিনাশ করিয়া সংগ্ৰাম হইতে বিমুক্ত হইতে দেখিব; শত্ৰুগণ কখনই তোমাদিগকে পরাজয় করিতে পরিবে না।
“এক্ষণে আপনাকে বা দুৰ্য্যোধনকে নিন্দা না করিয়া পিতাকেই নিন্দা করা উচিত; কেন না, যেমন বদান্য ব্যক্তিগণ অনায়াসে ধন প্রদান করেন, তদ্রূপ তিনি অক্লেশেই আমাকে কুন্তিভোজের হস্তে সমর্পণ করিয়াছেন। আমি যখন বাল্যাবস্থায় কন্দুক [ক্রীড়নক-পুতুল] লইয়া ক্রীড়া করিতাম, সেই সময় পিতা আমাকে কুন্তিভোজের হস্তে প্রদান করেন। আমার কি দূরদৃষ্ট! আমি তৎকালে জনককর্ত্তৃক ও এক্ষণে শ্বশুরকর্ত্তৃক অবমানিত হইয়া জীবনধারণ করিতেছি। আমার জীবনে কিছুমাত্ৰই ফল নাই। হে জনাৰ্দন! অর্জ্জুনের জন্মদিনে রজনীযোগে আমি এই দৈববাণী শ্রবণ করিয়াছিলাম যে, “তোমার এই পুত্রটি সমুদয় পৃথিবী জয় করিবে, ইহার যশ আকাশ স্পর্শ করিবে এবং এই মহাত্মা মহাযুদ্ধে কৌরবগণকে পরাজয়পূর্ব্বক রাজ্যলাভ করিয়া ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে তিনটি অশ্বমেধের অনুষ্ঠান করিবে।” আমি দেববাণীর নিন্দা করিতেছি না। বিশ্বকতাঁ ধর্ম্ম ও মহাত্মা কৃষ্ণকে নমস্কার; ধর্ম্ম লোকসকল ধারণ করিতেছেন। হে বৃষ্ণিবংশাবতংস! যদি ধর্ম্ম থাকেন, যদি দৈববাণী যথার্থ হয় এবং যদি তুমি সত্য হও, তাহা হইলে তুমি অবশ্যই আমার সমুদয় অভিলাষ সম্পাদন করবে। “
যুদ্ধকরণে কুন্তীর ইঙ্গিত
“হে মাধব! আমি পুত্ৰগণের অদর্শনে যেরূপ শোকাবিষ্ট হইয়াছি, বৈধব্য, অর্থনাশ ও জ্ঞাতিগণের সহিত শক্রতায় তাদৃশ শোকাকুল হই নাই। আজি চতুর্দশ বৎসর হইল, আমি ধর্ম্মপরায়ণ যুধিষ্ঠির, সমস্ত অস্ত্রবিদগণের অগ্রগণ্য অর্জ্জুন, মহাবীর বৃকোদর ও মাদ্রীতনয়দ্বয়কে অবলোকন করি নাই; আমার শান্তি কোথায়? মানবগণ মৃত হইয়াছে বলিয়া অনুর্দ্দিষ্ট [বার বৎসর যাহার সংবাদ পাওয়া না যায়] ব্যক্তিগণের শ্রাদ্ধ করিয়া থাকে, তদনুসারে পাণ্ডবগণ আমার পক্ষে ও আমি পাণ্ডবগণের পক্ষে মৃতই হইয়াছি। যাহা হউক, এক্ষণে তুমি যুধিষ্ঠিরকে কহিবে যে, সে যেন তাহার বাক্য মিথ্যা না করে, কারণ, তাহা হইলে তাহার ধর্ম্মনাশ হইবে। যে নারী পরাধীন হইয়া জীবন ধারণ করে, তাহাকে ধিক! দীনতা অবলম্বনপূর্ব্বক জীবিকা নির্ব্বাহ করিলে মহতী অপ্রতিষ্ঠা লাভ করিতে হয়। হে কেশব! তুমি বৃকোদর ও ধনঞ্জয়কে কহিবে যে, ক্ষত্ৰিয়কন্যা যে নিমিত্ত গৰ্ভ ধারণ করে, তাহার সময় সমুপস্থিত হইয়াছে, অতএব যদি তোমরা এই সময়ে তাহার বিপরীতচরণ কর, তাহা হইলে অতি ঘৃণাকর কর্মের অনুষ্ঠান করা হইবে। তাহারা নৃশংসের ন্যায় কাৰ্য্য করিলে আমি তাহাদিগকে চিরকালের নিমিত্ত পরিত্যাগ করিব। সময়ক্রমে প্ৰাণ পৰ্য্যন্ত পরিত্যাগ করিতে হয়। হে কৃষ্ণ! তুমি ক্ষত্ৰিয়ধর্ম্মনিরত মাদ্রীতনয়দ্বয়কে কহিবে যে, তোমরা বিক্ৰমার্জিত সম্পত্তি প্ৰাণ অপেক্ষা প্রিয় বলিয়া জ্ঞান কর। বিক্রমাধিগত অর্থই ক্ষত্রধর্ম্মাবলম্বী ব্যক্তির প্রীতি সম্পাদনা করিয়া থাকে।
“হে বাসুদেব! তুমি অর্জ্জুনকে দ্রৌপদীর মতানুসারে কাৰ্য্য করিতে বিশেষ অনুরোধ করিবে। তুমি বিলক্ষণ অবগত আছ যে, অন্তক[যমতুল্য] সদৃশ ভীমসেন ও অর্জ্জন ক্রুদ্ধ হইলে দেবগণকেও সংহার করিতে পারে। দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন যে সভামধ্যে দ্ৰৌপদীকে আনয়ন করিয়াছিল এবং দুঃশাসন ও কর্ণ যে পরুষ[কৰ্কশ]বাক্য প্রয়োগ করিয়াছিল, তাহা ভীমার্জ্জুনের পক্ষে নিতান্ত অপমানের বিষয় হইয়াছে। দুৰ্য্যোধন কৌরবমুখ্য [কৌরবপ্রধান] ব্যক্তিগণসমক্ষে মনস্বী ভীমসেনকে যে উপহাস করিয়াছিল, অচিরাৎ তাহার ফলপ্ৰাপ্ত হইবে। ভীমসেনের অন্তঃকরণে বৈরানিল একবার প্রজ্বলিত হইলে কখনই প্রশান্তভাব অবলম্বন করে না; ফলতঃ ভীমসেন যাবৎ শত্ৰুগণকে সংহার করিতে না পারে, তাবৎ তাহার ক্ৰোধ-হুতাশন নির্ব্বাণপ্ৰাপ্ত হয় না।
“হে বাসুদেব! ক্ষত্রধর্ম্মনিরতা দ্রুপদনন্দিনী সনাথা হইয়াও অনাথার ন্যায় রজঃস্বলাবস্থায় সভামধ্যে আনীত হইয়া বিবিধ পরুষবাক্য শ্রবণ করিয়াছেন বলিয়া আমি যদৃশ দুঃখিত হইয়াছি, দূতপরাজয়, রাজ্যহরণ ও পুত্ৰগণের নির্ব্বাসনের নিমিত্ত তাদৃশ দুঃখিত হই নাই। আমি পুত্ৰবতী; তুমি, বলদেব ও মহারথ প্ৰদ্যুন্ন আমার সহায়; ভীমার্জ্জুনও অদ্যাপি জীবিত রহিয়াছে; হায়! তথাপি আমাকে এতাদৃশ দুঃসহ দুঃখভোগ করিতে হইল!”
কৃষ্ণের বাক্যে কুন্তীর আশ্বস্তি
তখন অর্জ্জুনসখা কৃষ্ণ পুত্ৰশোকপরিক্লিষ্টা পিতৃষ্বসাকে আশ্বাসপ্রদানপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে পিতৃষ্বসা! আপনার তুল্য মহিলা লোকমধ্যে আর কে আছে? আপনি শূরসেনরাজার দুহিতা, এক্ষণে আজমীঢ়কুলে প্রদত্ত হইয়াছেন; আপনার ভতাঁ সতত আপনার সম্মান করিতেন। আপনি বীরমাতা, বীরপত্নী ও সর্ব্বগুণসম্পন্না; আবশ্যক [দৈবাৎ সঙঘটিত] হইলে আপনার সদৃশ কামিনীগণকে সুখ ও দুঃখ উভয়ই ভোগ করিতে হয়। পাণ্ডবগণ নিদ্রা, তন্দ্ৰা, ক্ৰোধ, হৰ্ষ, ক্ষুধা, পিপাসা, হিম ও রৌদ্র পরাজয় করিয়া বীরোচিত সুখে নিহত রহিয়াছেন। তাঁহারা ইন্দ্ৰিয়সুখ পরিত্যাগ করিয়া বীরোচিত সুখসম্ভোগে সন্তুষ্ট আছেন; সেই মহাবল পরাক্রান্ত মহোৎসাহসম্পন্ন বীরগণ কদাচ অল্পে সন্তুষ্ট হয়েন না, বীর ব্যক্তিরা হয় অতিশয় ক্লেশ, না হয়, অত্যুৎকৃষ্ট সুখ সম্ভোগ করিয়া থাকে, আর ইন্দ্ৰিয়সুখাভিলাষী ব্যক্তিগণ মধ্যবিত্তাবস্থাতেই সন্তুষ্ট থাকে, কিন্তু উহা দুঃখের আকর; রাজ্যলোভ বা বনবাস সুখের নিদান।
“পাণ্ডবগণ সাতিশয় ধীর; তন্নিমিত্তই তাঁহারা মধ্যবিত্তাবস্থায় পরিতুষ্ট হয়েন নাই। যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চভ্রাতা কৃষ্ণসমভিব্যাহারে আপনাকে অভিবাদনপূর্ব্বক তাঁহাদের কুশলবাতাঁ নিবেদন করিয়া অনাময়জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। আপনি অচিরাৎ তাঁহাদিগকে শত্রুবিনাশ করিয়া সকল লোকের আধিপত্য ও অতুল সম্পত্তি সম্ভোগ করিতে দেখিবেন।”
তনয়শোকসন্তপ্তা কুন্তী কৃষ্ণকর্ত্তৃক এইরূপ আশ্বাসিত হইয়া অজ্ঞানজ তম সংবরণপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে মধুসূদন! তুমি যাহা যাহা পাণ্ডবগণের হিতকর বোধ করিবে, ধর্মের অব্যাঘাতে অকপটে তৎসমুদয় বিষয়ের অনুষ্ঠানে যত্নবান হইবে। হে কৃষ্ণ! আমি ব্যবস্থা, মিত্র, বুদ্ধি ও বিক্রম বিষয়ে তোমার প্রভাব বিলক্ষণ অবগত আছি, তুমি আমাদের কুলে ধর্ম্মস্বরূপ, সত্যস্বরূপ ও তপঃস্বরূপ; তুমিই মহান; তুমি পাণ্ডবগণের ভ্রাতা; তুমিই ব্ৰহ্মা; তোমাতে সমুদয় প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে; তুমি যাহা যাহা কহিলে, তৎসমুদয়ই সত্য হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”
অনন্তর মহাত্মা গোবিন্দ কুন্তীকে আমন্ত্রণ ও প্রদক্ষিণ করিয়া দুৰ্য্যোধনভাবনাভিমুখে গমন করিলেন।