১৬৬তম অধ্যায়
ভীষ্মের আশ্বাস-নৈরাশ্যমিশ্র বাণী
“ ‘হে কুরুশ্রেষ্ঠ! মহাবলপরাক্রান্ত গান্ধারপ্রধান রমণীয়দৰ্শন ক্ৰোধপরায়ণ যুবা অচল ও বৃষক নামে দুই ভ্রাতা তোমার শত্ৰুগণকে বিনষ্ট করিবে। যে পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত করিবার নিমিত্ত সতত তোমাকে প্রোৎসাহিত [প্রকৃষ্টরূপে উৎসাদিত] করিতেছে, যে তোমার প্রিয়সখা, মন্ত্রী ও নেতা, সেই শ্লাঘাপরতন্ত্র [আত্মপ্রশংসাপরায়ণ] পরনিন্দক নীচপ্রকৃতি হীনজাতি অভিমানী কর্ণসহজাতকবচ ও দিব্যকুণ্ডলযুগলে বঞ্চিত [ইন্দ্ৰকর্ত্তৃক ছলনাদ্বারা গ্রহণে বিড়ম্বিত] এবং আপনাকে ব্ৰাহ্মণ পরিচয় প্রদান করাতে রাম[পরশুরাম]কর্ত্তৃক অভিশাপগ্ৰস্ত আছে; এই নিমিত্ত রাখী বা অতিরথ হইতে পারে না। আমার মতে ইহাকে অৰ্দ্ধরথ [নিকৃষ্ট যোদ্ধা-প্রায় পদাতি তুল্য] বলিয়া জ্ঞান করা উচিত; এই কৰ্ণ অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইলে কখনই জীবিতাবস্থায় প্রত্যাগত হইবে না।”
“অনন্তর সর্ব্বধনুৰ্দ্ধারাগ্রগণ্য [সমস্ত ধনুৰ্দ্ধারীদিগের শ্রেষ্ঠ] দ্রোণাচাৰ্য্য কহিলেন, “হে ভীষ্ম! আপনি যাহা কহিলেন, তাহার অণুমাত্রও মিথ্যা নয়। কর্ণ সাতিশয় অভিমানী, অবধানশূন্য [অসাবধান] ও প্রত্যেক রণেই পরাঙ্মুখ হইয়া থাকে; সুতরাং আমার মতেও ইহাকে অৰ্দ্ধরথ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে।”
ভীষ্মের প্রতি কর্ণের ক্ৰোধ
“অন্যন্তর কর্ণ এই কথা শ্রবণগোচর করিবামাত্র অতিমাত্র ক্ৰোধবিস্মফারিতনয়নে [ক্ৰোধে বিস্তারিতনেত্রে]। কঠোরবচনে কহিতে লাগিলেন, “হে পিতামহ! আমার কোনো অপরাধ নাই; তথাপি আপনি আমাকে স্বেচ্ছানুসারে বিদ্বেষবশতঃ পদে পদে বাক্যশরে বিদ্ধ করিতেছেন, আপনি আমাকে কাপুরুষের ন্যায় নিতান্ত মন্দ জ্ঞান করিয়া থাকেন। এক্ষণে আমি মহারাজ দুৰ্য্যোধনের অনুরোধেই আপনাকে ক্ষমা করিতেছি। আপনি যখন আমাকে অৰ্দ্ধরথ বলিয়া নির্দ্দেশ করিলেন, তখন পৃথিবীস্থ সমস্ত লোকেই এই কথা কখনো মিথ্যা বলিয়া বিবেচনা করিবে না, কারণ, সকলে জানে, ভীষ্ম কদাচ মিথ্যা কহেন না। আপনি কৌরবগণের নিতান্ত অহিতকারী; কিন্তু রাজা দুৰ্য্যোধন ইহা অবগত হইতেছেন না। আপনি যেমন গুণবিদ্বেষবশতঃ [পরশ্ৰীকাতরতাহেতু] আমার প্রতি দ্বেষ প্রকাশ করিতেছেন, তদ্রূপ কোন ব্যক্তি যুদ্ধে পরস্পরের ভেদ করিতে অভিলাষী হইয়া সমকক্ষ ভূপালগণের এইরূপ তেজোবধ [তেজের অপলাপ] করিয়া থাকেন? আপনি কি ধনসম্পত্তি, কি বন্ধু কি বয়ঃক্রম, কি বাৰ্দ্ধক্য কিছুতেই মহারথীত্ব [মহারথের লক্ষণ] নির্ণয় করিতে সমর্থ হইবেন না। ক্ষত্ৰিয়গণ বলে, দ্বিজাতিগণ মন্ত্রে, বৈশ্যেরা ধনে এবং শূদ্রেরা বয়সে জ্যেষ্ঠতা লাভ করিয়া থাকেন। আপনি কাম ও দ্বেষপরায়ণ হইয়া মোহপ্রযুক্ত স্বেচ্ছানুসারে রথী ও অতিরথদিগকে নির্দ্দেশ করিতেছেন। হে দুৰ্য্যোধন! আপনি এই সকল বিষয় সম্যক পৰ্য্যালোচনা করিয়া এই দুষ্টুস্বভাবসম্পন্ন ভীষ্মকে পরিত্যাগ করুন; ইনি আপনার অহিতকারী। পুরুষপরম্পরাগত সৈন্যসকল ভিন্ন [অনৈক্য-ভিন্নমত] হইলে যখন তাহাদিগকে একত্র করা দুঃসাধ্য, তখন যাহারা নানা স্থান হইতে সমাগত হইয়াছে, তাহারা ভিন্ন হইলে যে একত্র করা দুষ্কর, তাহাতে সন্দেহ নাই। এক্ষণে এইসকল যোদ্ধৃদিগের দ্বৈধভাব [মতের অনৈক্য] সঞ্জাত হইয়াছে; তাহাতে আবার ভীষ্ম প্রত্যক্ষেই আমাদের তেজোবধ করিতেছেন। দেখুন, রথিবিজ্ঞানই বা কোথা আর অল্পমতি ভীস্মই বা কোথা [উভয় পদার্থের মধ্যে অনেক তফাৎ]?
“ ‘হে কুরুরাজ! আমি পাণ্ডবগণের সৈন্য আক্রমণ করিব; যেমন ব্যাঘ্রকে সন্দর্শন করিলে বৃষভগণ পলায়ন করিয়া থাকে, তদ্রূপ আমি সম্মুখীন হইলে পাণ্ডবেরা পঞ্চালগণসমভিব্যাহারে দশদিকে প্রস্থান করিবে। যুদ্ধ বা বিমৰ্দ [কর-চারণাদির প্রহরদ্বারা পীড়া প্রদান] এবং মন্ত্র ও ব্যাহৃতই [বাক্যপ্রয়োগের কৌশল] বা কোথা আর অতিবৃদ্ধ কালপ্রেরিত [যমমুখেগমনশীল] ভীষ্মই বা কোথা? ভীষ্ম একাকী প্রতিনিয়ত পৃথিবীস্থ সমস্ত লোকের সহিত স্পৰ্দ্ধা করিয়া থাকেন এবং কাহাকেও গণনা করেন না। শাস্ত্রে উক্ত হইয়া থাকে, বৃদ্ধের বাক্য শ্রবণ করা বিধেয়; কিন্তু অতিবৃদ্ধদিগের কথা কখনই শ্রবণ করিবে না; তাহাঁরা বালক বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকেন। আমি একাকীই পাণ্ডবগণের সৈন্য সংহার করিব। আপনি ভীষ্মকে সেনাপতিপদে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন; সুতরাং আপনার যুদ্ধে ভীষ্মেরই যশোলাভ হইবে; কারণ, যুদ্ধে সেনাপতিরই যশোলাভ হইয়া থাকে, সেনাগণ তদ্বিষয়ে বঞ্চিত হয়। হে মহারাজ! ভীষ্ম জীবিত থাকিতে আমি কখনই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব না; তিনি কলেবর পরিত্যাগ করিলে পর অন্যান্য মহারথগণ-সমভিব্যাহারে যুদ্ধ করিব।”
“ভীষ্ম কহিলেন, ‘হে কর্ণ। এই যুদ্ধের সাগরসদৃশ গুরুভার [উত্তরণে উপায়নির্দ্দেশরূপ] আমাতেই সমাপিত হইবে, ইহা আমি বহুকাল অবধারণ করিয়াছি। সেই লোমহর্ষণ [রোমাঞ্চকর] সংগ্রামকাল উপস্থিত হইলে আমি কদাচ পরস্পরের ভেদ করিব না; অতএব তুমিও জীবিত থাকিবে। তুমি নিতান্ত বালক; আজি আমি বৃদ্ধ হইলেও বিক্রম প্রকাশপূর্ব্বক তোমার যুদ্ধশ্রদ্ধা [সমরপ্রিয়তা] ও জীবিতাভিলাষ [বাঁচিবার ইচ্ছা] নিরাশ করিব না। মহাবীর জমদগ্ন্য [পরশুরাম] মহাস্ত্র পরিত্যাগ করিয়াও আমাকে কোনরূপ পীড়া প্ৰদান করিতে সমর্থ হয়েন নাই; সুতরাং এক্ষণে তুমি আমার কি করিবে? হে হীনকুলপাংশুল [নীচ-কুলাঙ্গার]! সাধুলোকেরা কদাচ আপনার বলবীৰ্য্যের প্রশংসা করেন না, কিন্তু আমি এক্ষণে নিতান্ত সন্তপ্ত হইয়াই এই কথা উত্থাপন করিতেছি; কাশিরাজকন্যাদিগের স্বয়ংবর কালে আমি একমাত্র রথে আরোহণ করিয়া সমবেত ক্ষত্ৰিয়গণকে পরাজিত করিয়া বলপূর্ব্বক কন্যাদিগকে হরণ করিয়াছিলাম এবং আমি একাকীই সমরাঙ্গনে অতি বিখ্যাত সহস্ৰ সহস্ৰ সসৈন্য ভূপালগণকে নিরস্ত করিয়াছিলাম। তোমাকে প্রাপ্ত হইয়া কৌরবগণের অনয় [অনীতি-মন্দবুদ্ধি] উপস্থিত হইয়াছে; তুমিও বিনাশলাভের নিমিত্ত আগত হইয়াছ। অতএব পুরুষকার প্রদর্শনপূর্ব্বক যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। তুমি যাহার সহিত সতত স্পৰ্দ্ধা করিয়া থাক, আজি সেই পার্থের সহিত যুদ্ধ কর। আমি সেই যুদ্ধ হইতে তোমাকে প্রত্যাগত [প্ৰাণ লইয়া ফিরিতে দেখিব না-উপহাস বাক্য] দেখিব।”
“তখন রাজা দুৰ্য্যোধন উভয়কে এইরূপ বিবাদে প্রবৃত্ত দেখিয়া ভীষ্মদেবকে কহিলেন, “হে পিতামহ! আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করুন; এক্ষণে মহৎকার্য্য উপস্থিত হইয়াছে; অতএব যাহাতে আমার শ্রেয়োলাভ হয়, আপনি তাহা অবধারণ করুন। আপনারা উভয়েই আমার মহৎকর্ম্ম অনুষ্ঠান করিবেন। রজনী প্রভাত হইলেই যুদ্ধ আরম্ভ হইবে। এক্ষণে পুনরায় বিপক্ষগণের বলাবল এবং রথী ও অতিরাথ-সংখ্যা শ্রবণ করিতে অভিলাষ করি।’ ”