১৮৩. পঞ্চম দিনের যুদ্ধ-ভীষ্মের স্বপ্নে অস্ত্ৰপ্ৰাপ্তি

১৮৩তম অধ্যায়

পঞ্চম দিনের যুদ্ধ-ভীষ্মের স্বপ্নে অস্ত্ৰপ্ৰাপ্তি

“অনন্তর আমি রাত্রিকালে ব্ৰাহ্মণ, পিতৃগণ, দেবতা, রাক্ষস, ক্ষত্রিয় ও ভূতগণকে নমস্কার করিয়া নির্জ্জনে শয্যায় শয়ন করিয়া মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলাম, ‘বহু দিবস অতীত হইল, জামদগ্ন্যের সহিত আমার ঘোরতর সংগ্রাম হইতেছে; কিন্তু আমি কিছুতেই তাঁহাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হইতেছি না! যদি তাঁহাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হই, তাহা হইলে দেবগণ প্ৰসন্ন হইয়া আমাকে স্বপ্ন প্রদর্শন [দুরারোগ্য ব্যাধি বা পুরুষকারপ্ৰযত্নসত্ত্বেও অপ্রতিবিধেয় বিপদ দেখা দিলে তৎপ্রতীকারের জন্য দৈব ঔষধি বা দৈবশক্তির সূক্ষ্ম ইঙ্গিতলাভের জন্য লোক অভিনিবেশসহকারে ধ্যান্যপরায়ণ হয়। বর্ত্তমানকালে তারকেশ্বরের মন্দিরে হত্যা দিয়া অনেকে তথাবিধ প্ৰতীকারপ্ৰদ স্বপ্নলব্ধ ঔষধ বা প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হইয়া থাকে। উপবাসাদিতে প্রাণশক্তি ক্ষয় করিয়া ঐরূপ প্রার্থনা করা হয় বলিয়া উহার নাম হইয়াছে হত্যা। এই স্বপ্নপ্রদর্শনপ্রার্থনাও হত্যাজাতীয়।] করুন।’ আমি এইরূপ চিন্তা করিয়া দক্ষিণপার্শ্বে শায়িত ও নিদ্রিত হইলাম।

“অনন্তর আমি রথ হইতে নিপতিত হইলে যাঁহারা উত্থাপন, ধারণ ও অভয়প্রদানপূর্ব্বক সান্তনা দান করিয়াছিলেন, সেইসমস্ত ব্রাহ্মণেরা আমাকে স্বপ্নযোগে দর্শনপ্রদান ও চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিয়া কহিলেন, “হে গাঙ্গেয়! গাত্ৰোত্থান কর। তোমার আর কিছুমাত্র শঙ্কা নাই। তুমি আমাদিগেরই দেহস্বরূপ, আমরা তোমাকে সতত রক্ষা করিতেছি। জামদগ্ন্য কোনরূপেই তোমাকে তোমাকে সমরে পরাজিত করিতে পরিবেন না; প্রত্যুত তুমিই তাঁহাকে পরাজিত করিবে। এক্ষণে প্রস্বীপ [‘স্বাপ’ শব্দের অর্থ নিদ্রা। প্ৰ’ উপসর্গ যোগে উহার অর্থ হইতেছে প্রকৃষ্টরূপে নিদ্রা। প্রস্বীপ-অন্ত্রের আঘাতে বিপক্ষ পক্ষ গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত হয়। প্রত্যুত পরবর্ত্তী ঘটনায় দেখা যায়,-পরশুরামের তাহাই হইয়াছিল। রামায়ণের রামরাবণের যুদ্ধেও এইরূপ অস্ত্র ব্যবহৃত হইয়াছিল। এইরূপ অস্ত্রের আবিষ্কারে যে বর্ত্তমান যুরোপীয় বিজ্ঞানে বাহবা পড়িয়াছে, প্রকৃত প্রস্তাবে সে বাহবা পাওয়ার পাত্র প্রাচ্যবিজ্ঞান-পাশ্চাত্তাবিজ্ঞান নহে।] নামক এই বিশ্বকৃৎ [বিশ্বরক্ষক] প্রাজাপত্য অস্ত্ৰ [ব্ৰহ্মাস্ত্র] তোমার প্রত্যভিজ্ঞাত [স্মরণ] হইবে। তুমি পূর্ব্বদেহে ইহা অবগত ছিলে। এই পৃথিবীতে রাম বা অন্য কেহই ইহা বিদিত নহেন। অতএব তুমি ঐ অস্ত্ৰ স্মরণ ও সংযোজনা কর, উহা স্বয়ংই তোমার সন্নিধানে উপনীত হইবে। তুমি সেই অস্ত্ৰপ্ৰভাবে জামদগ্ন্যকে পরাজিত ও অন্যান্য মহাবল পরাক্রান্ত বীরপুরুষদিগকে শ্বাসিত করিতে সমর্থ হইবে। পাপাচার তোমাকে স্পর্শ করিতে পরিবে না। জামদগ্ন্য তোমার বাণবলে নিপীড়িত হইয়া রণস্থলে নিদ্রিত হইবেন। পরে তুমি এই প্রিয়তর সম্বোধননামক [‘বোধ’ শব্দের অর্থ জ্ঞান চৈতন্য; ‘সং’ উপসৰ্গযোগে সর্বাংশের অর্থ সমক্ জ্ঞান-নিখুঁতভাবে চৈতন্যপ্রাপ্তি। বাণাঘাতে অচৈতন্য অবস্থায় অধিক কাল থাকিলে প্রাণহানিও হইতে পারে অথবা শারীর ধাতু বিকৃত হইয়া দেহ বিকৃতও করিতে পারে, কিন্তু উক্ত অস্ত্র এমনই সুকৌশলে নির্মিত যে, সে আশঙ্কা তাহার থাকে না। ‘সি’ উপসর্গের ইহাও অপর অর্থ। প্রাণনাশ না করিয়া শক্রকে অভিভব করার পক্ষে পূর্ব্বের প্রস্বাপ এবং এ সম্বোধন অতীব উপযুক্ত। আর ভীষ্মের মনোগত অভিপ্রায়ও তাহাই। ব্ৰাহ্মাণভক্ত ভীষ্মের বিপ্রদেহে বিশেষতঃ গুরুর গাত্রে অস্ত্রনিক্ষেপে পরাঙ্মুখতায় দৈবপ্রেরিত ব্ৰাহ্মণেরাই স্বপ্নের নায়ক হইয়া এই কাৰ্য্যের যোগাযোগ করিয়া দেন। যাহা হউক, ইহাও আধুনিক বিজ্ঞানে আবিষ্কৃত দেখা যায়। প্রস্বাপবাণে গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত করিয়া— দস্যুতস্কর গ্রেপ্তার করিয়া, তাহাদের চৈতন্যসম্পাদনপূর্ব্বক বিচারাদি করা হইয়া থাকে। বলা বাহুল্য ইহাও নবাবিষ্কার নহে, বহু পূর্ব্বের বহু প্রাচীন আর্য্য-আবিষ্কার।] অস্ত্রদ্বারা তাঁহাকে পুনরায় উত্থাপিত করিবে। অতএব আজিই প্ৰভাতে রথারোহণ করিয়া এইরূপ অনুষ্ঠান কর। পরশুরাম কখনই কলেবর পরিত্যাগ করিবেন না; আমরা তৎকালে তাঁহাকে সুষুপ্ত বা মৃতজ্ঞান করিব; অতএব এক্ষণে তুমি এই প্রস্বাপ-অস্ত্ৰ যোজনা কর।” এই বলিয়া তেজঃপুঞ্জকলেবরতুল্যরূপ সেই আটটি ব্রাহ্মণ তথায় অন্তর্হিত হইলেন।”