০৯৯. রণপরাঙ্মুখে অধোগতি–উম্মুখের ঊর্দ্ধগতি

৯৯তম অধ্যায়

রণপরাঙ্মুখে অধোগতি–উম্মুখের ঊর্দ্ধগতি

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! বীরজনের উৎসাহদানবিষয়ে প্রতর্দ্দন ও জনকরাজার সংগ্রাম উপলক্ষে এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তিত আছে। মহাত্মা জনকরাজা যজ্ঞোপবীত-সংগ্রামে [সংগ্রামরূপ যজ্ঞে দীক্ষিত মহাত্মা রাজা জনক স্বীয় সৈন্যগণের] যোধগণের যেরূপ আহ্লাদ বৰ্দ্ধন করিয়াছিলেন, তাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর।

“তত্ত্বজ্ঞানসম্পন্ন মিথিলাধিপতি মহাত্মা জনক ঐ যুদ্ধে স্বীয় সৈন্যগণকে স্বর্গ ও নরক প্রদর্শনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “হে যোধগণ! যাহারা সমরে ভীত না হয়, তাহারা এই গন্ধৰ্ব্বকন্যা-পরিপূর্ণ সৰ্ব্বফলপ্রদ ভাস্কর [ভাস্বর-উজ্জ্বল] স্বর্গলোক লাভ করে; আর যাহারা প্রাণভয়ে সংগ্রাম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পলায়ন করে, তাহারা অনন্তকাল এই অকীৰ্ত্তিকর নরকে নিপতিত হয়; অতএব তোমরা প্রাণপরিত্যাগে কৃতনিশ্চয় হইয়া শত্রুগণকে পরাজয় কর; অতি কুৎসিত নরকের বশবর্ত্তী হইও না। সংগ্রামস্থলে শরীর ত্যাগ করাই বীরগণের স্বর্গদ্বারস্বরূপ।’

“জনকরাজ সংগ্রামস্থলে এই কথা কহিলে তাঁহার সৈন্যগণ তাঁহার আনন্দবর্ধনপূৰ্ব্বক অরাতিগণকে পরাজয় করিতে আরম্ভ করিল; অতএব দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তিদিগের রণস্থলে রথিদিগকে, রথিগণের পশ্চাদ্ভাগে অশ্বারোহীদিগকে এবং অশ্বারোহীদিগের মধ্যস্থলে বর্ম্মধারী পদাতিগণকে সংস্থাপন করা উচিত। যে রাজা এইরূপ ব্যূহ রচনা করেন, তিনি সতত জয়লাভে সমর্থ হয়েন। অতএব সকল যুদ্ধেই ঐরূপ ব্যূহ প্রস্তুত করা কর্ত্তব্য। যুদ্ধানুরাগী মনুষ্যেরা ধর্ম্মযুদ্ধদ্বারা স্বর্গলাভ করিতে অভিলাষ করিয়া থাকেন। ভূপতিগণ মকরেরা যেমন সাগরকে বিক্ষোভিত করে, তদ্রূপ সংগ্রামস্থল বিক্ষোভিত করিয়া শত্রুসৈন্যগণকে বিচলিত ও বিষণ্ন ব্যক্তিদিগকে হর্ষিত করিবেন। যে ভূমি আয়ত্ত করা হইয়াছে, সতত যত্নসহকারে তাহার রক্ষাবিধান করিবেন। যেসমস্ত সৈন্য ছিন্নভিন্ন হইয়া গিয়াছে, কদাচ তাহার অনুসরণ করিবেন না। যেসমস্ত সৈন্য একবার পলায়নপূর্ব্বক পুনরায় জীবিতনিরপেক্ষ হইয়া রণস্থলে উপস্থিত হয়, তাহাদিগের বেগ অতি দুঃসহ; অতএব বিশেষ সাবধান না হইয়া সহসা তাহাদের সম্মুখীন হওয়া বিধেয় নহে। যে ব্যক্তি দ্রুতবেগে পলায়ন করিতেছে, বীরপুরুষ তাহাকে কদাচ প্রহার করিবেন না। স্থাবরসকল জঙ্গমের ভক্ষ্য, দশনহীন দন্তবানের ভক্ষ্য, জল পিপাসার্ত্ত ব্যক্তির ভক্ষ্য ও কাতর ব্যক্তিরা বীরগণের ভক্ষ্য। ভীরু ব্যক্তিরা শূরগণের ন্যায় হস্তপদাদিসম্পন্ন হইয়াও ভয়প্রযুক্ত তাহাদের নিকট পরাভূত হইয়া থাকে; এই নিমিত্তই ভীরুদিগকে বীরগণের আশ্রয়গ্রহণ ও তাহাদিগের নিকট অঞ্জলিবন্ধন করিতে হয়। বীরগণের বাহুদণ্ডে জগতীতলস্থ সমস্ত লোক লম্বিত রহিয়াছে; অতএব বীরগণ সকল অবস্থাতেই সম্মানলাভ করিবার উপযুক্ত, সন্দেহ নাই। ত্রিলোকমধ্যে শৌর্য্য অপেক্ষা প্রধান আর কিছুই নাই। শূর ব্যক্তি সকলকেই প্রতিপালন করিয়া থাকেন।