০৯০. ধর্ম্মহীন রাজ্যে বিশৃঙ্খলা—উতথ্য-মান্ধাতার কথা

৯০তম অধ্যায়

ধর্ম্মহীন রাজ্যে বিশৃঙ্খলা—উতথ্য-মান্ধাতার কথা

ভীষ্ম কহিলেন, “যুধিষ্ঠির! ব্রহ্মবেত্তা উতথ্য যুবনাশ্বতনয় মান্ধাতাকে প্রফুল্লমনে যেরূপ ধৰ্ম্মোপদেশ প্রদান করিয়াছিলেন, আমি তাহা আদ্যোপান্ত কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। রাজা ধৰ্ম্মরক্ষার্থই উৎপন্ন হইয়াছেন, অতএব স্বেচ্ছাচারে প্রবৃত্ত হওয়া তাঁহার বিধেয় নহে। রাজা লোকরক্ষক; রাজা ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিলে দেবলোকে ও অধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিলে নরকে গমন করিয়া থাকেন। ধৰ্ম্মপ্রভাবেই প্রাণীগণ অবস্থান করিতেছে [রক্ষিত হইতেছে] এবং ধর্ম্ম ভূপালগণেরই আশ্রিত হইয়া আছে, অতএব যে রাজা নিয়মানুসারে ধর্ম্ম প্রতিপালন করেন, তিনিই প্রকৃত রাজা। ধর্ম্মানুষ্ঠাননিরত ঐশ্বৰ্য্যশালী ভূপতি সাক্ষাৎ ধর্ম্মস্বরূপ, রাজ্য হইতে পাপ নিরাকৃত না হইলে দেবগণ রাজাকে ধর্ম্মহীন বলিয়া নিন্দা করিয়া থাকেন, অধার্ম্মিকদিগের উদ্দেশ্য অনায়াসে সুসিদ্ধ হয়, ধৰ্ম্ম এককালে উচ্ছিন্ন হইয়া যায়, অধর্ম্ম পরিবর্দ্ধিত হয়, লোকের অন্তঃকরণে সতত ভয় সঞ্চারিত হইতে থাকে; কেহ ধৰ্ম্মানুসারে কোন বস্তু অধিকার করিতে পারে না; ভাৰ্য্যা, পশু, ক্ষেত্র ও আবাসে কোন ব্যক্তিরই অধিকার থাকে না। দেবগণ পূজা, পিতৃগণ শ্রাদ্ধাদি কাৰ্য্য ও অতিথিসকল সমুচিত সৎকারদ্বারা পরিতৃপ্ত হয়েন না; ব্রতপরায়ণ ব্রাহ্মণেরা বেদাধ্যয়ন ও যাগযজ্ঞাদির অনুষ্ঠানে বিরত হয়েন এবং মনুষ্যগণের চিত্ত বৃদ্ধের ন্যায় বিহ্বল হইয়া যায়। মহর্ষিগণ উভয়লোক নিরীক্ষণপূৰ্ব্বক সাক্ষাৎ ধৰ্ম্মস্বরূপ রাজার পুষ্টি করিয়াছেন; সুতরাং যে রাজাতে ধর্ম্ম বিরাজমান থাকে, তিনিই যথার্থ রাজা; আর যাহা হইতে ধৰ্ম্ম উচ্ছিন্ন হইয়া যায়, তিনি বৃষলস্বরূপ। ধর্ম্মের একটি নাম বৃষ, যিনি সেই ধৰ্ম্ম উচ্ছিন্ন করেন, তাঁহাকে বৃষল বলিয়া নির্দেশ করা যুক্তিবহির্ভূত নহে। সাধ্যানুসারে ধর্ম্ম পরিবর্দ্ধিত করাই রাজার কৰ্ত্তব্য। ধর্ম্ম পরিবর্দ্ধিত হইলে প্রজা পরিবর্দ্ধিত এবং ধর্ম্ম বিলুপ্ত হইলে প্রজাগণও বিলুপ্ত হয়; অতএব ধর্ম্মলোপ করা কোন মতেই বিধেয় নহে। ধনাগম ও ধনসঞ্চয় করে বলিয়া ধৰ্ম্মের ধৰ্ম্ম নাম নির্দিষ্ট হইয়াছে। উহার প্রভাবে দুষ্কাৰ্য্যসমুদয় এককালে অপসারিত হইয়া যায়। ভগবান ব্রহ্মা ভূতগণের উৎপত্তিবিধানের নিমিত্ত ধৰ্ম্মের সৃষ্টি করিয়াছেন; অতএব প্রজাদিগের হিতসাধনার্থ ধৰ্ম্মপ্রতিপালন করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। ধৰ্ম্মই সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পদার্থ। যিনি ধৰ্ম্মানুসারে প্রজাপালন করেন, তিনিই রাজা। অতএব হে মান্ধাতঃ! তুমি কাম ও ক্রোধে অনাদর প্রদর্শনপূর্ব্বক ধৰ্ম্ম প্রতিপালন কর। ধর্ম্মই ভূপালগণের শ্রেয়স্কর। ব্রাহ্মণ ধৰ্ম্মের উৎপত্তিস্থান; অতএব নিরন্তর ব্রাহ্মণগণের অর্চ্চনা ও মত্সরশূন্য হইয়া তাঁহাদিগের অভীষ্টসাধন করিবে। ব্রাহ্মণেরা পূর্ণমনোরথ না হইলে রাজার নানাপ্রকার ভয়, মিত্ৰক্ষয় ও শত্রুর প্রাদুর্ভাব উপস্থিত হয়।

মান্ধাতার প্রতি উতথ্যের ধর্ম্মবিষয়ক উক্তি

“বিরোচনতনয় বলি বালস্বভাবনিবন্ধন ব্রাহ্মণগণের প্রতি অসূয়াপ্রদর্শনে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন বলিয়াই লক্ষ্মী: তাঁহাকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক দেবরাজ ইন্দ্রের নিকট গমন করিয়াছিলেন। তদর্শনে দানবরাজ যারপরনাই অনুতাপিত হইয়াছিলেন। অসূয়া ও অভিমানের ঐরূপই ফললাভ হইয়া থাকে, অতএব এক্ষণে তুমি সাবধান হও; তোমা হইতে যেন রাজলক্ষ্মী বিচলিত না হয়েন। শ্রুতিতে নির্দিষ্ট আছে যে, লক্ষ্মীর গর্ভে অধৰ্ম্ম হইতে দর্পনামে এক পুত্র হয়। সুর, অসুর ও রাজর্ষিগণমধ্যে অনেকেই উহার বশবর্ত্তী হইয়াছিলেন। যিনি সেই দর্পকে বশীভূত করিতে পারেন, তিনিই রাজা হইয়া থাকেন; আর যিনি উহার বশীভূত হয়েন, তাহাকে উহার দাস হইতে হয়। এক্ষণে যদি তোমার চিরকাল সুখে অতিবাহিত করিবার অভিলাষ থাকে, তাহা হইলে অধর্ম্ম ও দর্পকে আশ্রয় প্রদান করিও না। তুমি মত্ত, উন্মত্ত, পাষণ্ড, নিগৃহীতঅমাত্য, স্ত্রী, সরীসৃপ প্রভৃতি হিংস্র জন্তুগণের সহবাস পরিহার কর। পৰ্ব্বতে আরোহণ ও বিষম দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিও না। রজনীতে সঞ্চরণ করা রাজার কর্ত্তব্য নহে। কৃপণতা, অভিমান, অহঙ্কার ও ক্রোধ যত্নপূৰ্ব্বক পরিত্যাগ কর। অপরিচিতা, স্বেচ্ছাচারিণী, পরকীয়া, অবিবাহিতা ও ক্লীবী স্ত্রীর সহিত সংসর্গ করা রাজার নিতান্ত দূষণীয়। ভূপতি অধর্ম্মে লিপ্ত হইলে বর্ণসঙ্করতাপ্রভাবে সংশে ক্লীব, বিকলাঙ্গ, মূক ও অজ্ঞান প্রভৃতি নানাপ্রকার মনুষ্যের জন্ম হইয়া থাকে; অতএব প্রজার হিতসাধনার্থ সাবধানে অবস্থান করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। রাজা প্রমাদযুক্ত হইলে প্রজা-সঙ্করকারক অধৰ্ম্মের বৃদ্ধি, অকালে শীতের প্রাদুর্ভাব, শীতকালে শীতের অভাব এবং অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি প্রভৃতি ভূরি ভূরি উপদ্রব উপস্থিত হইতে থাকে। প্রজাদিগকে নানাপ্রকার ব্যাধিযন্ত্রণা সহ্য করিতে হয়। ঘোরদর্শন ধূমকেতু প্রভৃতি গ্রহ ও অশুভ নক্ষত্রসমুদয় প্রতিনিয়ত নভোমণ্ডলে সমুদিত এবং ক্ষয়কারক অন্যান্য উৎপাতসমুদয় সতত প্রাদুর্ভূত হইয়া থাকে। যে রাজা আত্মরক্ষা ও প্রজাপালনে নিতান্ত অমনোযোগী, তাঁহাকে অচিরাৎ প্রজাদিগের সহিত বিনষ্ট হইতে হয়। রাজা অধর্ম্মপরায়ণ হইলে দুই ব্যক্তি একের ও বহুসংখ্যক লোক দুই ব্যক্তির ধন বলপূর্ব্বক অপহরণ করিয়া থাকে, কন্যাদিগের কুমারীভাব দূষিত হইয়া যায় এবং কেহই কোন দ্রব্য আপনার বলিয়া অধিকার করিতে পারে না।”