০৬৮. রাজাভাবে বিপদ–বসুমনা ও বৃহস্পতিসংবাদ

৬৮তম অধ্যায়

রাজাভাবে বিপদ–বসুমনা ও বৃহস্পতিসংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ। ব্রাহ্মণেরা কি নিমিত্ত নরপতিকে দেবতুল্য বলিয়া নির্দেশ করেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! মহারাজ বসুমনা, বৃহস্পতিকে যাহা জিজ্ঞাসা এবং সুরগুরু উঁহাকে যেরূপ প্রত্যুত্তর প্রদান করিয়াছিলেন, সেই পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা সৰ্ব্বলোকহিতৈষী ধাৰ্ম্মিকাগ্রগণ্য কোশলরাজ বসুমনা যথোচিত বিনয়সহকারে কৃতপ্রজ্ঞ মহাত্মা বৃহস্পতিকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করিয়া প্রজাগণের ধর্ম্মলাভার্থ জিজ্ঞাসা করিলেন, ভগবন্! প্রাণীগণ কি কৰ্ম্ম করিলে বৰ্দ্ধিত আর কি নিমিত্তই বা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং প্রাজ্ঞলোকেরা কাহার পরিচর্য্যা করিয়া অক্ষয় সুখলাভে সমর্থ হয়েন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন। ’

“ভগবান্ বৃহস্পতি অমিততেজাঃ কোশলরাজকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া কহিলেন, “মহারাজ! রাজাই সকল লোকের ধৰ্ম্মানুষ্ঠানের মূল। রাজশাসন না থাকিলে প্রজাগণ পরস্পরকে ভক্ষণ করিত। প্রজাগণ নিয়মহীন ও পরদারনিরত হইলে ভূপতি তাহাদের প্রতি ধৰ্ম্মানুসারে দণ্ডবিধান করিয়া তাহাদিগের পাপমোচন করে। চন্দ্র বা সূর্য্য সমুদিত না হইলে প্রাণীগণ যেমন বস্তুদর্শনে অসমর্থ ও ঘোরান্ধকারে নিমগ্ন হয়, যেমন অল্পোদক[অল্প জল] প্রদেশে মৎস্যগণ ও হিংস্ৰভয়বিহীন[সমধিক বলবান শত্রুশূন্য] স্থানে বিহঙ্গমগণ হিংসাপরতন্ত্র হইয়া স্বেচ্ছানুসারে বিহার ও পরস্পরকে আক্রমণ করিয়া অচিরাৎ প্রাণপরিত্যাগ করে, তদ্রূপ রাজ্য অরাজক হইলে প্রজাগণ ঘোরতর পাপপঙ্কে লিপ্ত হইয়া গোপালবিহীন পশুগণের ন্যায় বিনষ্ট হইয়া যায়। যদি রাজা রাজ্যপালন না করেন, তাহা হইলে বলবান্ ব্যক্তিরা অনায়াসে দুর্বল পুরুষের গৃহাদি অপহরণে প্রবৃত্ত হয়, কেহই আর পুত্রকলত্র ও ভক্ষ্যভোজ্য প্রভৃতি আপনার আয়ত্ত করিয়া বাস করিতে পারে না; সংসার বিলুপ্তপ্রায় হইয়া যায়। পাপাত্মারা সহসা অন্যের যান, বস্ত্র, অলঙ্কার ও বিবিধ রত্ন হরণ করে। ধার্ম্মিক পুরুষগণের উপর বিবিধ শস্ত্রপাত হইতে থাকে। রাজ্য অধৰ্ম্মে পরিপূর্ণ হয়। অধমেরা পিতা, মাতা, বৃদ্ধ, আচার্য্য, গুরু ও অতিথিগণকে কষ্ট প্রদান ও তাহাদিগের প্রাণসংহার করে। ধনবান ব্যক্তিরা সর্ব্বদা বধ ও বন্ধনজনিত বিষম ক্লেশে নিপতিত হয়। কাহারও আর কোন দ্রব্যে মমতা থাকে না। অকালে সকলেই ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া যায়। সমুদয় স্থানই দস্যুগণপরিপূর্ণ ও প্রজাগণ ঘোর নরকে নিপতিত হয়। যোনিবিচার ও কৃষি-বাণিজ্যের নিয়ম এককালে তিরোহিত হইয়া যায়। ধৰ্ম্ম, বেদাধ্যয়ন, দক্ষিণান্বিত বিবিধ যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান, বিবাহপ্রথা ও সমাজ-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হইতে থাকে। বৃষগণ রেততানিঃসারণে পরাঙ্মুখ [রাজা বৃষ রক্ষা না করিলে গাভীতে উত্তম বৎসের উৎপাদন বন্ধ], আভীরপল্লী উৎসন্ন [গোপপল্লী ধ্বংস] ও দধিমন্থন কাৰ্য্য বিলুপ্ত হয়; সমুদয় প্রাণী উদ্বিগ্নহৃদয়, বিচেতন ও ভীত হইয়া ক্ষণকালমধ্যে হাহাকার শব্দ করিতে করিতে মৃত্যুমুখে প্রবেশ করে। সংবৎসরব্যাপী দক্ষিণান্বিত যজ্ঞ নির্ব্বিঘ্নে বিধিপূৰ্ব্বক সম্পূর্ণ হয় না। ব্রতস্নাত বিদ্বান্ ব্রাহ্মণগণ বেদাধ্যয়নে বিরত হয়েন। লোকে বিবিধ প্রতিবন্ধকবশতঃ কালে ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিতে পারে না। অপরাধী ব্যক্তি সুস্থচিত্তে কালযাপন করে। বলবান ব্যক্তি দুৰ্ব্বলের করস্থিত বস্তুও অনায়াসে অপহরণ ও সমুদয় নিয়ম লঙঘন করে। সকলেই ভয়ার্ত্ত হইয়া ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে থাকে এবং সৰ্ব্বস্থানেই বর্ণসঙ্কর ও দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব হয়।

নৃপতির ক্রূর-সৌম্যাদিমুক্তির আবশ্যকতা

“ভূপতি যথানিয়মে রাজ্যপালন করিলে প্রজাগণ গৃহদ্বার উদঘাটনপূৰ্ব্বক [ঘরের দরজা খুলিয়া] অকুতোভয়ে শয়ন করিয়া থাকে। সর্ব্বালঙ্কারভূষিতা রমণীগণ রক্ষকবিহীন হইয়া অকুতোভয়ে ভ্রমণ করিতে পারে। সমস্ত লোকই ধৰ্ম্মপরায়ণ ও হিংসাবিহীন হইয়া পরস্পরের আনুকূল্যে প্রবৃত্ত হয়। ব্রাহ্মণাদি বর্ণত্রয় অনায়াসে বিবিধ মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান ও বিদ্যাভ্যাস করিতে পারেন। লোকসমুদয়ের জীবিকাভূত বার্ত্তাশাস্ত্র [কৃষি-ব্যবসা-বাণিজ্যাদি জীবিকার উপদেশক শাস্ত্র] ও লোকপালক বেদ সৰ্ব্বত্র বিদ্যমান থাকে এবং সমস্ত লোক প্রসন্ন হইয়া পরমসুখে কালাতিপাত করে। রাজার জীবনেই প্রজাগণ জীবিত থাকে এবং রাজার বিনাশেই উহারা বিনষ্ট হয়। অতএব ভূপতিকে অর্চ্চনা করা সকলেরই কর্ত্তব্য। যে ব্যক্তি রাজার প্রিয়চিকীর্ষু[হিতেচ্ছু] হইয়া সৰ্ব্বলোকহিতার্থ তাঁহার কাৰ্য্যসাধন করিতে পারেন, তিনিই উভয় লোক জয় করিতে সমর্থ হয়েন। যে পুরুষ মনে মনেও রাজার অনিষ্টচিন্তা করে, তাহাকে নিঃসন্দেহে ইহলোকে কষ্টভোগ ও পরলোকে নিরয়গামী হইতে হয়। নরপতি নররূপধারী দেবতাস্বরূপ; অতএব উঁহাকে মনুষ্য বলিয়া অবজ্ঞা করা বিধেয় নহে। রাজা সময়ক্রমে অগ্নি, আদিত্য, মৃত্যু, কুবের ও যম এই পাঁচ মূর্ত্তি ধারণ করিয়া থাকেন। যখন তিনি মিথ্যাবাক্যে প্রতারিত হইয়া অতিকঠোর তেজঃপ্রভাবে সন্নিহিত মিথ্যাবাদীকে দগ্ধ করেন, তখন তাঁহার হুতাশনমূৰ্ত্তি, যখন চরদ্বারা প্রজাগণের কার্য্যাকাৰ্য্য দর্শন ও তাহাদের মঙ্গলবিধান করেন, তখন তাঁহার ভাস্করমূৰ্ত্তি, যখন ক্রুদ্ধ হইয়া অধার্ম্মিকদিগকে পুত্রপৌত্র ও বন্ধুবান্ধবসমভিব্যাহারে বিনষ্ট করেন, তখন তাঁহার মৃত্যু[অন্তক]মূৰ্ত্তি, যখন সুতীক্ষ্ণদণ্ডে পাপাত্মাদিগের দণ্ডবিধান ও ধার্ম্মিকদিগের প্রতি সমুচিত অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন, তখন তাঁহার সমমূৰ্ত্তি এবং যখন ধনদ্বারা উপকারীদিগের তৃপ্তিসাধন ও অপকারীদিগের ধনরত্ন অপহরণ করেন, তখন তাঁহার কুবেরমূৰ্ত্তি লক্ষিত হয়। ধৰ্ম্মাকাঙ্ক্ষী, কার্য্যদক্ষ মনুষ্য কখনই রাজার অপযশ ঘোষণা করিবে না। পুত্র, ভ্রাতা ও বয়স্য প্রভৃতি যে কেহই হউক না কেন, রাজার নিতান্ত প্রিয়পাত্র হইয়াও তাঁহার প্রতিকূলাচরণ করিলে কদাচ সুখলাভে সমর্থ হয় না। দাহ্য বস্তু বায়ুসমীরিত হুতাশনে দগ্ধ হইলে উহার কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকিতে পারে, কিন্তু যে ব্যক্তি ভূপালের কোপানলে নিপতিত হয়, তাহার আর কিছুমাত্র চিহ্ন থাকে না। রাজা যেসমস্ত বস্তু অতিযত্নসহকারে রক্ষা করেন, তাহা গ্রহণে যত্নবান হওয়া নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। লোকে মৃত্যু হইতে যেরূপ ভীত হয়, রাজস্ব-অপহরণেও সেইরূপ ভীত হইবে। মৃগ যেমন মারণযন্ত্র স্পর্শ করিলে বিনষ্ট হয়, তদ্রূপ মনুষ্যের রাজস্বস্পৰ্শমাত্রই মৃত্যু হইবার সম্ভাবনা। বুদ্ধিজীবী ব্যক্তি আপনার ধনের ন্যায় অতিযত্নসহকারে রাজস্ব রক্ষা করিবে। যাহারা রাজস্বাপহারী, তাহারা চিরকালের নিমিত্ত ঘোরতর নরকে নিপতিত হয়। যে মহাত্মা মহারাজ, প্রজারঞ্জক, সুখপ্রবর্ত্তক, শ্রীমান্ ও সম্রাট প্রভৃতি বিবিধ শব্দদ্বারা সতত সংস্তুত হইয়া থাকেন, কোন ব্যক্তি তাঁহার পূজা না করিবে? অতএব উন্নতিলাভেচ্ছু, জিতেন্দ্রিয়, মেধাবী মহীপালের আশ্রয়গ্রহণ করাই কৰ্ত্তব্য। মন্ত্রী কৃতজ্ঞ, প্রাজ্ঞ, উদারপ্রকৃতি, দৃঢ়ভক্তিসম্পন্ন, জিতেন্দ্রিয় ধর্ম্মপরায়ণ ও নীতিপর হইলে রাজার সমাদরভাজন হয়েন। যে ব্যক্তি বুদ্ধিমান, সদাশয়, মহাবলপরাক্রান্ত এবং যিনি অন্যের সাহায্যনিরপেক্ষ হইয়া কার্য্যানুষ্ঠান করিতে পারেন, মহীপাল সেইরূপ লোকেরই আশ্রয়গ্রহণ করিবেন। প্রজ্ঞা[বুদ্ধি] মনুষ্যকে প্রগলভ্‌[উদ্যমী] করে এবং ভূপাল মনুষ্যকে ক্ষীণ[আপনা হইতে হীন] করিয়া থাকেন। যে ব্যক্তি রাজার কোপে নিপতিত হয়, সে সতত অসুখে, আর যে তাঁহার অনুগৃহীত হয়, সে পরমসুখে কালযাপন করে। রাজা প্রজাদিগের হৃদয়, গুরু, গতি ও উৎকৃষ্ট সুখস্বরূপ। প্রজারা তাঁহাকে আশ্রয় করিয়া ইহলোকে ও পরলোকে সুখী হইয়া থাকে। রাজা বিবিধ যজ্ঞানুষ্ঠান এবং ইন্দ্রিয়দমন, সত্যব্যবহার ও সৌহার্দ্যসহকারে রাজ্যশাসন করিলে দেবলোকে স্থান লাভ, করিতে পারেন।’ কোশলাধিপতি বসুমনা মহাত্মা বৃহস্পতিকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া অতিযত্নসহকারে প্রজাপালনে প্রবৃত্ত হইলেন।”