০৮৬. দুর্গাদি ব্যবস্থাদ্বারা রাজধানী রক্ষা

৮৬তম অধ্যায়

দুর্গাদি ব্যবস্থাদ্বারা রাজধানী রক্ষা

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! রাজার কিরূপ পুরমধ্যে বাস করা কর্ত্তব্য? আর তিনি কি পূৰ্ব্বকৃত পুরমধ্যেই বাস করিবেন, না স্বয়ং পুর নির্ম্মাণ করাইয়া তন্মধ্যেই অবস্থান করিবেন?”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! যথায় জ্ঞাতি, পুত্র ও বন্ধুবর্গের সহিত বাস করিতে হয়, তথায় কি কি কার্য্যের অনুষ্ঠান ও কিরূপে সেই স্থানের রক্ষাবিধান করিতে হইবে, তাহা জিজ্ঞাসা করা অবশ্য কৰ্ত্তব্য। এক্ষণে আমি তোমার নিকট ঐ বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, তুমি উহা শ্রবণপূৰ্ব্বক তদনুসারে কার্য্যানুষ্ঠান করিবে। দুর্গ ছয়প্রকার—ধন্ব[নির্জ্জন প্রদেশস্থ]দুর্গ, মহীদুর্গ, গিরিদুর্গ, মনুষ্যদুর্গ, জলদুর্গ ও বনদুর্গ। সর্বাগ্রে এই ছয় প্রকার দুর্গ নির্ম্মাণ করাইয়া তন্মধ্যে সমৃদ্ধিসম্পন্ন পুরী সংস্থাপন করিবেন। যে নগর উক্তপ্রকার দুর্গ, আয়ুধ, সুদৃঢ় প্রাকার, পরিখা এবং হস্তী, অশ্ব ও রথে সমাকীর্ণ, যথায় অনেকানেক বিদ্বান্, শিল্পী ও সুনিপুণ ধার্মিকেরা বাস করিয়া থাকেন, যথায় অসংখ্য তেজস্বী মনুষ্য, হস্তী, অশ্ব এবং চত্বর ও আপণ[বাজার] থাকে, সেখানে কিছুমাত্র শঙ্কা নাই। যে স্থানের লোকেরা অতিশয় অতিথিপ্রিয়, বীর, ধনী, বিশুদ্ধব্যবহারসম্পন্ন; যথায় নিরন্তর বেদধ্বনি, দেবপূজা ও উৎসব হইয়া থাকে, রাজা সৈন্যসামন্ত ও অমাত্যগণকে বশীভূত করিয়া সেই নগরে বাস করিবেন। তিনি তথায় কোষ, সৈন্য ও মিত্র পরিবর্দ্ধন ও বিচারালয় সংস্থাপনপূৰ্ব্বক অন্যান্য নগর ও গ্রাম হইতে দোষসকল দূরীকৃত করিতে সচেষ্ট হইবেন। সতত অস্ত্রসংখ্যাবৃদ্ধি, ধানাদি সংগ্রহ এবং যন্ত্র ও অর্গল [পথরোধের ব্যবস্থা] রক্ষা করিবেন। কাষ্ঠ, লৌহ, তুষ, অঙ্গার, শৃঙ্গ, অস্থি, বংশ[বাঁশ], মজ্জা, তৈল, মধুক্রম[মৌমাছির চাক], ঔষধ, শণ, সর্জ্জরস [ধূনা], শরৎ, চৰ্ম্ম, স্নায়ু, বেত্র, মুঞ্জা ও বল্লজ [বল্লজতৃণ] সংগ্রহ এবং পুষ্করিণী ও কূপ প্রভৃতি নানাপ্রকার জলাশয় খনন করিয়া রাখিবেন। বট, অশ্বত্থ প্রভৃতি বৃক্ষসমুদয় প্রযত্নসহকারে রক্ষা করিবেন। আচার্য্য, ঋত্বিক, পুরোহিত, স্থপতি, সাংবৎসরিক, চিকিৎসক এবং প্রজ্ঞাবান, জিতেন্দ্রিয়, মেধাবী, দক্ষ, শাস্ত্রজ্ঞ, সৎকুলসম্ভূত, মহাবলপরাক্রান্ত, সৰ্ব্বকাৰ্য্যবিশারদ ব্যক্তিদিগকে পরমসমাদরে সম্মানিত করিবেন। ধার্মিকের সৎকার ও অধাৰ্ম্মিককে নিগ্রহপূর্ব্বক বর্ণচতুষ্টয়কে স্ব স্ব কাৰ্য্যে নিয়োজিত করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। তিনি চর প্রয়োগপূৰ্ব্বক সতত পুর ও গ্রামবাসী প্রকৃতিবর্গের বাহ্য, আন্তরিক ভাবসমুদয় সবিশেষ জ্ঞাত হইয়া তাহাদের প্রতি নিগ্রহ ও অনুগ্রহ প্রকাশ করিবেন। চরপ্রয়োগ, মন্ত্রণা, কোষ ও দণ্ডবিধানে সবিশেষ মনোযোগ করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। ঐ সমুদয় রাজ্যরক্ষার মূল কারণ।

“রাজ্য, গ্রাম ও নগরে চর প্রয়োগ করিয়া উদাসীন, শত্রু ও মিত্রগণের ব্যবহার পর্য্যালোচনা করিবেন এবং সতত মিত্রের প্রতি অনুগ্রহ ও শত্রুর প্রতি নিগ্রহপ্রদর্শনে প্রবৃত্ত হইবেন। নিরন্তর যজ্ঞানুষ্ঠান ও দরিদ্রকে বিভবানুরূপ অর্থদান ও প্রজাপালন করা অবশ্য কর্ত্তব্য। যাহাতে ধর্ম্মের কোন অনিষ্ট উপস্থিত হয়, রাজা কদাচ এরূপ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিবেন না। তিনি অনাথ, দীন, দরিদ্র, বৃদ্ধ ও বিধবাদিগের জীবিকা নির্দেশ করিয়া দিবেন। আশ্রমস্থ তপস্বীদিগকে যথোচিত উপচারে অর্চ্চনা ও সম্মান করিয়া নিয়মিত সময়ে অন্নবস্ত্র ও ভোজনপত্র প্রদান করিবেন এবং তাঁহাদের নিকট রাজ্যের শুভাশুভবার্তা, রাজ্যসম্পৰ্কীয় কাৰ্য্য এবং স্বীয় সুখদুঃখসমুদয় নিবেদন করিয়া সতত নম্রভাবে থাকিবেন। যিনি সৎকুলসম্ভূত সন্ন্যাসী ও শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন হইবেন, রাজা তাঁহার শয্যা, আসন ও অন্নদানপূৰ্ব্বক অর্চ্চনা করিবেন। বিপদ উপস্থিত হইলে ঐরূপ ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। দস্যুরাও তপস্বিগণকে বিশ্বাস করিয়া থাকে; তাঁহাদিগের নিকট নিধি[ধনরত্ন]সংস্থাপন ও তাঁহাদিগের পরামর্শ গ্রহণবিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ করিবার আবশ্যক নাই। কিন্তু সতত তাঁহাদিগের সেবা ও সৎকার করা বিধেয় নহে। কারণ, দস্যুগণ ঐ বিষয় অবগত হইলে হয় ত’ তাঁহাদের প্রাণসংহার করিতে পারে। রাজা স্বরাষ্ট্রমধ্যে একজন, পররাষ্ট্রমধ্যে একজন, অরণ্যমধ্যে একজন ও সামন্তরাজ্যে একজন তপস্বীর সহিত সখ্যভাব সংস্থাপন করিয়া তাঁহাদিগকে সৎকার ও অন্ন প্রদান করিবেন। রাজা বিপৎকালে শরণাপন্ন হইলে তপস্বীরা তাঁহার অভিলাষ সফল করিয়া থাকেন। হে ধৰ্ম্মরাজ! যেরূপ নগরে রাজার বাস করা কর্ত্তব্য, আমি তাহা সবিশেষ নির্দেশ করিলাম।”