০৮৫. মন্ত্রণানৈপুণ্যে প্রজাপালন রীতি

৮৫তম অধ্যায়

মন্ত্রণানৈপুণ্যে প্রজাপালন রীতি

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! ইহলোকে নরপতি কিরূপে প্রজাপালন করিলে পরমপ্রীতি ও অক্ষয়-কীৰ্ত্তিলাভে সমর্থ হয়েন?”

ভীষ্ম কহিলেন, “রাজ! নরপতি প্রজাপালনে তৎপর হইয়া বিশুদ্ধ ব্যবহার করিলে উভয় লোকেই ধর্ম্ম ও কীৰ্ত্তি লাভ করিয়া থাকেন।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, ‘মহাত্মন! কোন কোন ব্যক্তির সহিত কিরূপ ব্যবহার করিতে হইবে, তাহা কীৰ্ত্তন করুন। আপনি ইতিপূৰ্ব্বে অমাত্যদিগের যেসকল গুণের কথা উল্লেখ করিলেন, আমার বোধ হয়, একাধারে ঐ সমস্ত গুণ থাকা নিতান্ত অসম্ভব।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! তুমি সত্য কহিয়াছ; একাধারে ঐ সকল গুণ থাকা সম্ভবপর নহে। যাহা হউক, এক্ষণে তুমি যাদৃশ লোকদিগকে অমাত্যপদবী প্রদান করিবে, তাহাদের বিষয়ে সংক্ষেপে কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। চারিজন সুপবিত্র বেদবিদ্যাবিশারদ স্নাতক ব্রাহ্মণ, আটজন অস্ত্রধারী মহাবল পরাক্রান্ত ক্ষত্রিয়, অতুল ঐশ্বৰ্য্যসম্পন্ন একবিংশতি বৈশ্য, বিনীততস্বভাব অতিপবিত্র তিনজন শূদ্র এবং একজন শুশ্রূষাদি অষ্টগুণসম্পন্ন পুরাণবেত্তা সূতকে অমাত্যপদে নিযুক্ত করা তোমার কর্ত্তব্য। অমাত্যগণ সকলেই যেন পঞ্চাষদ্‌বর্ষবয়স্ক, বিনীত, বুদ্ধিমান, অপক্ষপাতী, বিচারক্ষম, লোভ ও মৃগয়াদি সপ্তবিধ [মৃগয়া, পাশাখেলা, ভাৰ্য্যাসক্তি, মদ্যপান, অর্থলোভে দণ্ডদান, কর্কশবাক্য, অন্যায়পূৰ্ব্বক অর্থসঞ্চয়] দোষবিবর্জ্জিত হয়েন। ঐ সমুদয় অমাত্যের মধ্যে চারিজন ব্রাহ্মণ, তিনজন ক্ষত্রিয় ও একজন সূত এই আটজনের সহিত তুমি স্বয়ং মন্ত্রণা করিয়া নিয়ম নির্ণয় করিবে, তৎপরে ঐ নিয়ম রাজ্যমধ্যে ঘোষণা করিয়া দিবে। এইরূপে প্রজার রক্ষণাবেক্ষণ করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। এক দ্রব্যে দুইজনের বিবাদ উপস্থিত হইলে সেই দ্রব্যে তাহাদের উভয়কে বঞ্চিত করিয়া তাহা গ্রহণ করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। তুমি অসঙ্গত বিচার করিলে অধৰ্ম্মনিবন্ধন নিশ্চয়ই তোমাকে ও তোমার প্রজাগণকে পীড়িত হইতে হইবে এবং রাজ্যস্থ যাবতীয় লোক শ্যেনদর্শনভীত পক্ষীকুলের ন্যায় রাজ্য হইতে পলায়ন করিবে।

বিচারবিষয়ক বিবিধ নীতি

“রাজা, রাজমন্ত্রী অথবা রাজকুমার ধৰ্ম্মাসনে উপবিষ্ট হইয়া অধৰ্ম্মানুসারে প্রজাপালন করিলে নিশ্চয়ই তাঁহাদের হৃদয়ে ভয়সঞ্চার ও স্বর্গগমনের পথরোধ হইয়া থাকে। রাজকর্ম্মচারীরা যদি সম্যক্‌রূপে কার্য্যানুষ্ঠান না করে, তাহা হইলে তাহাদিগকে নরপতির সহিত ঘোর নরকে নিপতিত হইতে হয়। দুৰ্ব্বল ব্যক্তিরা বলবানদিগের অত্যাচারে কাতর হইয়া আৰ্তনাদ পরিত্যাগ করিলে রাজা সেই অনাথগণের নাথ হইবেন। বিচারকালে উভয় পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ করা রাজার কর্ত্তব্য। নিরাশ্রয় ব্যক্তির যদি সাক্ষ্যবল না থাকে, তাহা হইলে তাহার বিষয় বিশেষরূপে পর্য্যালোচনা করা উচিত। বিচারদ্বারা যাহার যেরূপ দোষ সপ্রমাণ হইবে, রাজা তাহার প্রতি তদনুরূপ দণ্ডবিধান করিবেন। ধনীদিগকে ধনদণ্ড, নিৰ্দ্ধনদিগকে বন্ধনদণ্ড ও দুর্ব্বৃত্তদিগকে দৈহিক দণ্ডদ্বারা শাসন করা নরপতির অবশ্য কৰ্ত্তব্য। শিষ্ট ব্যক্তিদিগের প্রতি সান্ত্ববাক্য প্রয়োগ করাই সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। যে ব্যক্তি রাজার বিনাশকামনা করে, তাহাকে বিবিধ যন্ত্রণাপ্রদানপূৰ্ব্বক বিনাশ করা উচিত। গৃহদাহকারী, ধনাপহারক ও ব্যভিচারদোষদূষিত ব্যক্তির প্রতি যথাবিধি দণ্ড বিধান করিলে নরপতির বা তাহার নিযুক্ত বিচারকের কিছুমাত্র অধৰ্ম্ম জন্মিবার সম্ভাবনা নাই, প্রত্যুত শাশ্বত ধর্ম্মলাভই হইয়া থাকে। অবিচক্ষণ, নরপতি স্বকাৰ্য্য সাধনার্থ অন্যায়াচরণপূর্ব্বক লোকের প্রতি দণ্ডবিধান করিলে ইহলোকে অপযশ লাভ ও পরলোকে ঘোরতর নরকভোগ করেন। একের অপরাধে অন্যের দণ্ডবিধান করা কর্ত্তব্য নহে। বিশেষ পর্য্যালোচনা করিয়া অপরাধীদিগকে বদ্ধ বা মুক্ত করা বিধেয়। দূতগণ একজনের নিকট অন্যের বাক্য কীৰ্ত্তন করে, অতএব যেরূপ আপদ উপস্থিত হউক না কেন, দূতদিগকে বিনাশ করা কোনক্রমেই কৰ্ত্তব্য নহে। দূতহন্তা নরপতি স্বয়ং সচিবগণের সহিত নিরগামী হয়েন এবং পিতৃলোকদিগকে ভূণহত্যাপাপে লিপ্ত করেন।

দূত, দ্বারপাল ও দুর্গরক্ষাকারীদিগের বিবরণ

“দূত, দ্বারপাল ও দুর্গনগরাদি রক্ষকদিগের কৌলীন্য, আভিজাত্য, প্রিয়ভাষিতা, বক্তৃতা, কাৰ্য্যপটুতা, যথোক্তবাদিতা [সত্যবাদিতা] ও স্মারকতা [পূর্বাপর ঘটনার স্মৃতি] এই সাতগুণে ভূষিত হওয়া নিতান্ত উচিত। অমাত্য ধর্ম্মশাস্ত্রজ্ঞ, সন্ধিবিগ্রহবেত্তা, বুদ্ধিমান, ধৈর্য্যশালী, লজ্জাশীল, রহস্যগোপনক্ষম, কুলীন ও সত্ত্বসম্পন্ন হইলে সৰ্ব্বত্র সমাদৃত হয়েন। সেনাপতিদিগেরও পূর্বোক্ত গুণসমুদয় এবং যন্ত্র[মারাত্মক যন্ত্র–বর্ত্তমান কালের মাইন প্রভৃতি], আয়ুধ ও ব্যূহরচনাবিষয়ে বিজ্ঞতা, শৌর্য্য, শীতগ্রীষ্মদি ক্লেশসহিষ্ণুতা ও পররন্ধ্রান্বেষণক্ষমতা থাকা আবশ্যক। ভূপতিগণ শত্রুর বিশ্বাস উৎপাদন করিবেন, কিন্তু স্বয়ং কাহারও প্রতি বিশ্বাস করিবেন না। অন্যের কথা দূরে থাকুক, পুত্রের প্রতি বিশ্বাস করাও তাঁহাদের বিদেহ নহে। হে ধৰ্ম্মরাজ! শাস্ত্রের যাহা যথার্থ মৰ্ম্ম, তাহা তোমার নিকট কীৰ্ত্তন করিলাম। ফলতঃ অবিশ্বাসই ভূপালগণের প্রধান কার্য্য।”