০৭৮. আপৎকালের জীবিকাকথন—বৈশ্যবৃত্তি বিবরণ

৭৮তম অধ্যায়

আপৎকালের জীবিকাকথন—বৈশ্যবৃত্তি বিবরণ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে পিতামহ! আপৎকাল উপস্থিত হইলে ব্রাহ্মণ রাজধৰ্ম্মানুসারে জীবিকানির্ব্বাহ করিতে পারেন; কিন্তু তিনি বৈশ্যধর্ম্মানুসারে জীবিকানির্ব্বাহ করিতে পারেন কি না, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! ব্রাহ্মণ ক্ষাত্রধর্ম্মানুসারে জীবিকা নিৰ্ব্বাহে অশক্ত হইলে বৈশ্যধর্ম্ম আশ্রয় করিতে পারেন।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! বৈশ্যধৰ্ম্মে অবস্থিত হইয়া কোন্ কোন্ দ্রব্য বিক্রয় করিলে ব্রাহ্মণকে স্বর্গচ্যুত হইতে হয় না?”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! ব্রাহ্মণ সুরা, লবণ, তিল, অশ্ব ও গো-মহিষাদি পশু, মধু, মাংস ও পক্কান্ন বিক্রয় করিবেন না। ঐ সমস্ত দ্রব্য বিক্রয় করিলে তাঁহাকে নরকগামী হইতে হয়। অজ বিক্রয় করিলে অগ্নি, মেষ বিক্রয় করিলে বরুণ, অশ্ব বিক্রয় করিলে সূৰ্য্য, অন্ন বিক্রয় করিলে পৃথিবী ও ধেনু বিক্রয় করিলে যজ্ঞ ও সোমরস বিক্রয় করা হয়; অতএব ঐ সমস্ত দ্রব্য বিক্রয় করা ব্রাহ্মণের নিতান্ত অকর্ত্তব্য। ভোজনের নিমিত্ত পক্কদ্রব্য প্রদানপূর্ব্বক আমবস্তু গ্রহণ করাই নিতান্ত দোসাবহ; আমবস্তু প্রদানপূর্ব্বক পক্কদ্রব্যগ্রহণ শাস্ত্রবিরুদ্ধ নহে। আমি আপনার পক্কবস্তু ভোজন করিব, আপনি আমাকে উহা প্রদান করিয়া স্বয়ং আমার এই অপক্কবস্তু গ্রহণপূৰ্ব্বক পাক করিয়া লউন,’ এই বলিয়া 
কোন ব্যক্তিকে অপ
ক্কবস্তু প্রদানপূৰ্ব্বক পক্কবস্তু গ্রহণ করিলে অধর্ম্মে লিপ্ত হইতে হয় না। ব্যবহারনিরত [স্মৃতিশাস্ত্রের অন্তর্গত ব্যবহারশাস্ত্রে অনুরক্ত] ধর্ম্মাবলম্বী পুরাতন ব্যক্তিগণের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ‘আমি তোমাকে এই বস্তু প্রদান করিতেছি, তুমি এই বস্তু প্রদান কর’, এই বলিয়া এক ব্যক্তিকে সম্মত করিয়া আপনার দ্রব্যের বিনিময়ে তাহার দ্রব্য গ্রহণ করিলে ধৰ্ম্মহানি হয় না। বলপূৰ্ব্বক অন্যের দ্রব্য গ্রহণ করিলেই ধর্ম্মভ্রষ্ট হইতে হয়। পূর্ব্বতন ঋষি ও অন্যান্য ব্যক্তিগণ ঐরূপ ব্যবহার করিয়া গিয়াছেন; উহা অতিশয় উৎকৃষ্ট, সন্দেহ নাই।”

প্রজাবিদ্রোহে রাজার কর্ত্তব্য

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! যখন প্রজাগণ স্বধৰ্ম্ম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক রাজার বিপক্ষে শস্ত্রগ্রহণ করে তখন নিশ্চয়ই তাঁহার বলক্ষয় হয়; অতএব ঐ সময় তিনি কিরূপে প্রজাপালন করিবেন, এই বিষয়ে আমার সংশয় উপস্থিত হইতেছে, আপনি ইহা সবিস্তর কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! ঐ সময় ব্রাহ্মণ প্রভৃতি সমূদয় বর্ণ দান, তপস্যা, যজ্ঞ, অদ্রোহ ও দমগুণদ্বারা আপন আপন মঙ্গল চেষ্টা করিবেন এবং উহাদের মধ্যে যাঁহারা বেদপারগ, তাঁহারা স্ব স্ব ব্রহ্মবল প্ৰকাশপূৰ্ব্বক দেবগণ যেমন দেবরাজের বলবৃদ্ধি করেন, তদ্রূপ রাজার বলবর্দ্ধনে প্রবৃত্ত হইবেন। রাজার ক্ষয়দশা উপস্থিত হইলে ব্রহ্মবলই তাঁহার একমাত্র আশ্রয়। এই নিমিত্ত বিজ্ঞলোকেরা ব্রহ্মবল আশ্রয় করিয়াই উন্নতিলাভের বাসনা করেন। যখন রাজা জয়শীল হইয়া রাজ্যের মঙ্গলবিধানে সচেষ্ট হয়েন, তখন সকল বর্ণই স্ব স্ব ধৰ্ম্মে সন্নিবেশিত থাকে। যখন রাজ্য দস্যুগণকর্ত্তৃক আক্রান্ত ও নিয়মবিহীন হয়, তখন সকল বর্ণই শস্ত্রধারণ করিতে পারে।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! যদি সমুদয় ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়, তাহা হইলে কোন ব্যক্তি ব্রাহ্মণকে ও তাঁহাদিগের বেদ রক্ষা করিবে? আর তৎকালে ব্রাহ্মণেরাই বা কোন ধর্ম্ম অবলম্বন করিয়া আত্মরক্ষা করিবেন?”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! ক্ষত্রিয়েরা ব্রাহ্মণগণের প্রতি অত্যাচারপরায়ণ হইলে বেদই ব্রাহ্মণগণকে রক্ষা করিবে এবং তাঁহারা তৎকালে তপস্যা, ব্রহ্মচর্য্য, অস্ত্রবল, সরলতা ও কপটতাদ্বারা ক্ষত্রিয়গণকে পরাস্ত করিয়া আত্মরক্ষায় যত্নবান্ হইবেন। সলিল হইতে অগ্নি, ব্রাহ্মণ হইতে ক্ষত্রিয় ও প্রস্তর হইতে লৌহ উৎপন্ন হইয়াছে, উহাদিগের তেজঃ সৰ্ব্বত্রগামী; কিন্তু উহারা স্বীয় স্বীয় আকরে নিপতিত হইলে এককালে প্রশান্ত হয়। লৌহ পাষাণ ভেদ, অগ্নি জল আক্রমণ ও ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণের বিদ্বেষে প্রবৃত্ত হইলে উহারা স্বয়ং বিনষ্ট হইয়া যায়; অতএব ক্ষত্রিয়ের তেজঃ যত প্রবল হউক না কেন, ব্রাহ্মণের উপর নিপতিত হইলে নিশ্চয়ই বিনষ্ট হইবে। ব্রহ্মবীৰ্য্য ও ক্ষত্রিয়তেজঃ নিতান্ত দুৰ্ব্বল এবং পাপাত্মারা ব্রাহ্মণের প্রতিকুলাচরণে প্রবৃত্ত হইলে যাঁহারা ধর্ম্ম ও ব্রাহ্মণের পরিত্রাণার্থ জীবিতাশা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সংগ্রামে প্রবৃত্ত হয়েন, তাঁহারাই যথার্থ মনস্বী, তেজস্বী ও পুণ্যলোকলাভের উপযুক্ত পাত্র। ব্রাহ্মণের পরিত্রাণার্থ সকল বর্ণের শস্ত্রগ্রহণ করা কৰ্ত্তব্য। যে মহাত্মা ব্রাহ্মণার্থ কলেবর পরিত্যাগ করেন, তিনি পরলোকে সুবিস্তৃত যজ্ঞানুষ্ঠানকারী, অধ্যয়নসম্পন্ন, তপোনিরত ও অনশনে অগ্নিপ্রবিষ্ট ব্যক্তিদিগের অপেক্ষাও সদ্‌গতি লাভে সমর্থ হয়েন। তিনবর্ণের পরিত্রাণাৰ্থ শস্ত্রগ্রহণ করা ব্রাহ্মণের দোয়াবহ নহে। পণ্ডিতেরা লোকরক্ষার্থ সংগ্রামে শরীরত্যাগই পরমধৰ্ম্ম বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। যাঁহারা ব্রাহ্মণদ্বেষ্টাদিগের নিবারণাৰ্থ জীবন পরিত্যাগ করেন, তাঁহাদিগকে নমস্কার। আমরা যেন চরমে তাঁহাদের সালোক্যলাভ করিতে পারি। মহাত্মা মনু ঐ সকল লোককে ব্রহ্মলোকগামী বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। লোকে অশ্বমেধযজ্ঞাবসানে স্নান করিয়া যেরূপ পবিত্র হয়, পরোপকারার্থ সংগ্রামে অস্ত্রাঘাতে নিহত হইলেও সেইরূপ পবিত্রতা লাভ করিয়া থাকে। দেশ, কাল ও কারণভেদে ধৰ্ম্ম অধৰ্ম্মরূপে ও অধৰ্ম্ম ধৰ্ম্মরূপে পরিণত হয়। উতঙ্ক ও পরাশরাদি মহর্ষিগণ সর্পযজ্ঞ, রাক্ষসযজ্ঞ প্রভৃতি ক্রূরকার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া স্বর্গলাভ করিয়াছেন এবং ধার্ম্মিক ক্ষত্রিয়গণ পররাজ্য আক্রমণ প্রভৃতি পাপানুষ্ঠান করিয়াও সদ্‌গতি লাভ করিয়া থাকেন; অতএব ব্রাহ্মণ আৰ্ত্তত্রাণ, বর্ণ[জাতিদোষ-জন্মদোষ]দোষনিবারণ ও দুর্দ্দম্যদমনার্থ শস্ত্রগ্রহণ করিতে পারেন।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! রাজ্য দস্যুদলাক্রান্ত, ক্ষত্রিয়গণ রাজ্যরক্ষায় অক্ষম এবং লোকসমুদয় অজ্ঞানাবৃত ও পরদারনিরত। হইলে যদি ব্রাহ্মণ বৈশ্য বা শূদ্ৰধৰ্ম্মানুসারে দণ্ডধারণপূর্ব্বক দস্যুগণ হইতে প্রজাদিগকে রক্ষা করিতে সমর্থ হয়েন, তাহা হইলে তাঁহাকে তদ্বিষয়ে অনুমোদন কি নিবারণ করা কর্ত্তব্য?”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! যিনি প্লবস্বরূপ হইয়া লোকদিগকে বিপদসাগর হইতে পরিত্রাণ করেন, তিনি শূদ্র হউন বা অন্য কোন বর্ণই হউন, তাঁহাকে অবশ্যই সম্মান করিতে হইবে। দস্যুপীড়িত অনাথ প্রজাগণ যাঁহাকে আশ্রয় করিয়া পরিত্রাণ পায়, তাঁহাকে স্বীয় বান্ধবের ন্যায় প্রীতিপূৰ্ব্বক পরিচর্য্যা করা অবশ্য কর্ত্তব্য। অভয়দাতা সম্মানলাভের যথার্থ পাত্র। ভারবহনে অসমর্থ বলীবর্দ্দ, দুগ্ধবিহীনা ধেনু, বন্ধ্যা ভাৰ্য্যা ও অরক্ষক রাজা কিছুমাত্র কাৰ্য্যকারক নহে। অধ্যয়নবিহীন ব্রাহ্মণ, পালনপরাঙ্মুখ নরপতি, বৃষ্টিহীন মেঘ, দারুময় হস্তী, চম্মময় মৃগ ও নপুংসক পুরুষ উষর[অনুর্ব্বর]ক্ষেত্রের ন্যায় নিতান্ত নিরর্থক। যে ব্যক্তি সর্ব্বদা সাধুদিগের রক্ষা ও অসাধুদিগের দণ্ডবিধান করেন, তিনিই রাজা হইবার উপযুক্ত পাত্র।”