০৬৫. ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মরক্ষায় সর্ব্বধৰ্ম্মরক্ষা

৬৫তম অধ্যায়

ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মরক্ষায় সর্ব্বধৰ্ম্মরক্ষা

“ইন্দ্র কহিলেন, ‘মহারাজ! অসামান্য প্রভাবসম্পন্ন ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম সকল ধৰ্ম্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। লোকের হিতানুষ্ঠানপরতন্ত্র উদারভাব ভবাদৃশ লোকেরাই ঐ ধর্ম্মপ্রতিপালনে সমর্থ হয়েন। ঐ ধৰ্ম্ম অধার্মিকের হস্তে নিপতিত হইলে লোকক্ষয়রূপ অনিষ্টফল উৎপাদন করিয়া থাকে। ভূমির উর্ব্বরত্ব-সম্পাদন, রাজসূয়, অশ্বমেধ প্রভৃতি যজ্ঞের অনুষ্ঠান, ভিক্ষাবৃত্তিতে। অনাদরপ্রদর্শন, প্রজাপালন ও যুদ্ধে কলেবর পরিত্যাগ করাই পরম দয়ালু রাজার প্রধান ধর্ম্ম। মহর্ষিগণ ত্যাগকেই শ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম বলিয়া গণনা করেন। ভূপতিগণ সমরক্ষেত্রে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ কলেবর পরিত্যাগেও পরাত্মখ হয়েন না। তাঁহারা শাস্ত্রজ্ঞান, গুরুশুশ্রূষা ও পরস্পরের বিনাশসাধনদ্বারা রাজধৰ্ম্ম প্রতিপালন করিয়া থাকেন। ক্ষত্রিয় ধর্ম্মলাভার্থী হইয়া গার্হস্থাশ্রম আশ্রয় করিবে। সামান্য কার্য্যের বিচার আরম্ভ হইলেও পক্ষপাত-পরিত্যাগ, বর্ণচতুষ্টয়ের ধৰ্ম্মসংস্থাপন, সুপ্রণালীক্রমে প্রতিপালন এবং উৎকৃষ্ট উপায়, নিয়ম ও পুরুষকার অবলম্বনপুৰ্ব্বক অতিযত্নসহকারে রাজধৰ্ম্ম রক্ষা করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। সকল ধৰ্ম্ম অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মই সৰ্ব্বপ্রকারে উৎকৃষ্ট। যে স্বধর্ম্মপালনে পরাঙ্মুখ হইয়া অন্য ধৰ্ম্ম আশ্রয় করে, তাহার সে ধৰ্ম্মানুষ্ঠান অধৰ্ম্মানুষ্ঠানের তুল্য হয়। উচ্ছৃঙ্খল, অর্থলুব্ধ ও পশুতুল্য মনুষ্যেরা ক্ষত্রিয় ধর্ম্মপ্রভাবেই নীতিশিক্ষা করে। ব্রাহ্মণগণের যাগযজ্ঞাদি কৰ্ম্মানুষ্ঠান ও আশ্ৰমধৰ্ম্ম প্রতিপালন করা অবশ্য কর্ত্তব্য, যিনি উহার বিপরীত কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হয়েন, তাঁহাকে শত্রুর ন্যায় শস্ত্রদ্বারা বধ করা কর্ত্তব্য। ব্রাহ্মণই আশ্ৰমধৰ্ম্ম ও বেদধৰ্ম্ম প্রতিপালন করিবেন, অন্য জাতির উহাতে হস্তক্ষেপ করা কর্ত্তব্য নহে। ব্রাহ্মণ কদাচ স্বধর্ম্মের অন্যথাচরণ করিবেন না। ব্রাহ্মণের কাৰ্য্যদ্বারা ধর্ম্ম পরিবর্দ্ধিত হয়, অতএব ব্রাহ্মণ ধৰ্ম্মস্বরূপ। যে ব্রাহ্মণ স্বধৰ্ম্ম পরিত্যাগ করেন, তাঁহাকে সম্মান ও বিশ্বাস করা কর্ত্তব্য নহে। হে মহারাজ! যেসমস্ত ধৰ্ম্ম কীর্ত্তন করিলাম, তৎসমুদয়ের মধ্যে রাজধৰ্ম্মই সৰ্ব্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট।

“মান্ধাতা কহিলেন, ‘দেবরাজ! আপনি আমাদিগের পরম বন্ধু। যবন, কিরাত, গান্ধার, চীন, শবর, বৰ্ব্বর, শক, তুঙ্গার, কঙ্ক, পহ্ণব, চান্দ্র, মদ্রক, পৌন্ড্র, পুলিন্দ, রমঠ, কাম্বোজ এবং ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় হইতে সমুদ্ভুত বৈশ্য ও শূদ্রগণ কিরূপ ধর্ম্ম প্রতিপালন করিবে, আর আমরাই বা সেই দস্যুগণকে কিরূপে স্বধৰ্ম্মে স্থাপন করিব, তাহা আপনার নিকট শ্রবণ করিতে অভিলাষ হইতেছে, অতএব উহা কীৰ্ত্তন করুন।’

“ইন্দ্ৰ কহিলেন, ‘মহারাজ! দস্যুগণ যাহাতে পিতা, মাতা, আচার্য্য, গুরু ও রাজার সেবা, বেদোক্ত ধর্ম্মপ্রতিপালন, যথাসময়ে পিতৃযজ্ঞানুষ্ঠান, কূপাদিখনন, ব্রাহ্মণগণকে শয়নীয় [শয্যা] প্রভৃতি বিবিধ বস্তু প্রদান, হিংসাক্রোধ-পরিত্যাগ, সত্যপালন, স্ত্রীপুত্রের ভরণপোষণ, দ্রোহ[অযথা পরপীড়ন]পরিত্যাগ, বিশুদ্ধ ব্যবহার, উন্নতিলাভের বাসনা, ব্রাহ্মণগণকে সৰ্ব্বযজ্ঞের দক্ষিণা-প্রদান ও পাকযজ্ঞের [চরু-পুরোডাশাদিদ্বারা অনুষ্ঠেয় যজ্ঞের] উদ্দেশ্যে ধনদান করে, ভূপতির তদ্বিষয়ে সবিশেষ চেষ্টা অবশ্য কর্ত্তব্য। পূৰ্ব্বে অন্যান্য লোকের যেসকল কর্ম্ম কর্ত্তব্য বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়াছে, দস্যুদিগেরও সেই সকল কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করা বিধেয়।’

“মান্ধাতা কহিলেন, ‘দেবেন্দ্র! দস্যুগণ চারিবর্ণ ও চারি আশ্রমের মধ্যে ছদ্মবেশে অবস্থান করিতেছে। ইন্দ্র কহিলেন, মহারাজ! দণ্ডনীতি ও রাজধৰ্ম্ম বিলুপ্ত হইলে প্রাণীগণ রাজার দৌরত্মনিবন্ধন নিতান্ত মুগ্ধ হইয়া উঠে। সত্যযুগ অতীত হইলে অসংখ্য লোক ছদ্মবেশধারণপুৰ্ব্বক ভিক্ষুক হইবে এবং কাম ক্রোধের বশীভূত হইয়া ধৰ্ম্মবাক্যশ্রবণ পরিহারপূর্ব্বক কুপথে গমন করিবে। যখন মহাত্মারা দণ্ডনীতি প্রভাবে পাপ নিবারণ করেন, তখন নিত্যধৰ্ম্ম অবিচলিতভাবে অবস্থান করে। যে ব্যক্তি সৰ্ব্বলোকগুরু রাজার অবমাননা করে, তাহার দান, হোম ও শ্রাদ্ধের কিছুমাত্র ফললাভ হয় না। দেবতারাও ধৰ্ম্মপরায়ণ নরপতির অপমান করেন না। ভগবান্ প্রজাপতি সমুদয় জগতের সৃষ্টি করিয়া ক্ষত্রিয়ের উপর ধৰ্ম্মরক্ষার ভার সমর্পণ করিয়াছেন। ক্ষত্রিয়েরা বুদ্ধিবলে ধৰ্ম্মের গতি বুঝিতে পারেন; অতএব উহারা আমার মান্য ও পূজ্য।’ ”

ভীষ্ম কহিলেন, “মহারাজ! ইন্দ্ররূপী ভগবান বিষ্ণু ইহা কহিয়া দেবগণের সহিত স্বস্থানে গমন করিলেন। ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্ম অতি উৎকৃষ্ট। অতএব বহুশ্রুত ক্ষত্রিয়কে অপমান করা কাহারও সাধ্যায়ত্ত নহে। যে ব্যক্তি ক্ষাত্রধৰ্ম্মে অবজ্ঞা করিয়া কুকার্য্যে প্রবৃত্ত ও সৎকৰ্ম্মানুষ্ঠানে বিরত হয়, তাহাকে পথিমধ্যস্থ অন্ধের ন্যায় অচিরাৎ বিপদগ্রস্ত হইতে হয়। হে ধৰ্ম্মরাজ! তুমি ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুষ্ঠানে বিলক্ষণ নিপুণ; অতএব পূৰ্ব্বপদ্ধতি অবলম্বনপূৰ্ব্বক উক্ত ধর্ম্ম প্রতিপালনে যত্নবান্ হও।”