০৬৯. নৃপতির চরনিয়োগব্যবস্থা

৬৯তম অধ্যায়

নৃপতির চরনিয়োগব্যবস্থা

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! কোন্ কাৰ্য্য রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য? আর কিরূপে রাজ্যরক্ষা, শত্ৰুপরাজয়, চরপ্রয়োগ এবং স্ত্রী, পুত্র, ভৃত্য ও চারিবর্ণের অন্যান্য লোকদিগের বিশ্বাসোৎপাদন করিতে হয়, তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! প্রথমতঃ রাজা বা রাজপ্রতিনিধির যাহা কৰ্ত্তব্য, তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, অবহিতচিত্তে শ্রবণ কর। ভূপতি প্রথমে আপনার চিত্তকে পরাজিত করিয়া পরিশেষে অরিবিজয়ে প্রবৃত্ত হইবেন। চিত্তপরাজয় না হইলে অরিপরাজয়ের সম্ভাবনা নাই। শ্ৰোত্রাদি ইন্দ্রিয়গণকে পরাজয় করিতে পারিলেই চিত্তপরাজয় করা হয়। দুর্গ, রাজ্যের শেষসীমা, নগরোপবন[নগরের সীমান্তস্থিত বন], গৃহোপবন[গৃহপ্রান্তস্থ বন], উপবেশনস্থান, অন্তঃপুর, নগর ও রাজভবনে পদাতিসৈন্য সংস্থাপনপূর্ব্বক অন্ধ, জড় ও বধিরের ন্যায় আকার সম্পন্ন, ক্ষুৎপিপাসা-পরিশ্রম-সহিষ্ণু, পরীক্ষোত্তীর্ণ, সুপ্রাজ্ঞ গূঢ়চরসমুদয় সংগ্রহ করিয়া উহাদের দ্বারা গুপ্তভাবে অমাত্য, মিত্র, তনয়, সামন্তভূপতি এবং নগর ও জনপদবাসী লোকদিগের আচার-ব্যবহারাদি অবগত হওয়া রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। শত্রুগণ রাজ্যমধ্যে চর প্রেরণ করিয়াছে কি না, তত্ত্বাবধারণ করিবার নিমিত্ত পানভূমি, মল্লযুদ্ধস্থান, মহাজনসমাজ, ভিক্ষুকসমাজ, পুরবাটিকা[অন্তঃপুর-গৃহ], বহিৰ্ব্বাটিকা[বাহির বাঢ়ী], পণ্ডিতগণের সমাগমস্থান, চত্বর, রাজসভা ও ভদ্রলোকদিগের আবাসস্থানে অন্বেষণ করা আবশ্যক। শত্রপক্ষীয় গুঢ়চরকে আপনার আয়ত্ত করিতে পারিলে রাজার অধিক মঙ্গললাভের সম্ভাবনা। নরপতি যখন আপনাকে অপেক্ষাকৃত হীনবল বিবেচনা করিবেন, তৎকালে অমাত্যগণের সহিত মন্ত্রণা করিয়া বলবান্ ব্যক্তির সহিত সন্ধিস্থাপন করাই তাঁহার সর্ব্বতোভাবে বিধেয়। যাহার সহিত সন্ধি করিলে কিঞ্চিৎ লাভের সম্ভাবনা থাকে, তাহার সহিত সন্ধি করাও অবিধেয় নহে। কিংবা সন্ধিৎসু[অনুসন্ধানতৎপর], গুণবান, উৎসাহসম্পন্ন, ধর্ম্মপরায়ণ ও সচ্চরিত্র ব্যক্তিদিগের সহিত সন্ধিস্থাপনপুৰ্ব্বক ধৰ্ম্মানুসারে রাজ্যরক্ষা করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য।

রাজার যুদ্ধযাত্রাদির নিয়ম

“রাজা আপনার উচ্ছেদদশা সমুপস্থিত হইয়াছে বুঝিতে পারিলেই পূৰ্ব্বাপকারী ও লোকবিদ্বিষ্ট ব্যক্তিদিগকে বিনাশ এবং যে নরপতি উপকার বা অপকারকরণে অসমর্থ, তাহাকে উপেক্ষা করিবেন। বিপুল সৈন্যসামন্ত সংগ্রহ করিয়া দুর্ব্বল, মিত্রবিহীন, অন্যের সহিত যুদ্ধে আসক্ত বা প্রমত্ত ব্যক্তির প্রতিই যুদ্ধযাত্রা করা রাজার কর্ত্তব্য। যুদ্ধযাত্রা করিবার পূর্বে নগরের রক্ষাবিধান নিতান্ত আবশ্যক। চিরকাল মহাপরাক্রান্ত ভূপতির বশবর্ত্তী হইয়া থাকা বলবিহীন রাজার কদাপি বিধেয় নহে। হীনবল ভূপতির ভৃত্যাদিদ্বারা বলবানের রাজ্য আকর্ষণ, অস্ত্র, অগ্নি. ও বিষপ্রয়োগদ্বারা উহার উৎপীড়ন এবং অমাত্য ও বন্ধুবান্ধবগুণ মধ্যে বিবাদোৎপাদন করা অবশ্য কর্ত্তব্য। বৃহস্পতি কহিয়াছেন, রাজ্যলাভার্থী বুদ্ধিমান ব্যক্তি সাম, দান ও ভেদ এই ত্রিবিধ উপায়দ্বারা অর্থসিদ্ধি হইলে কদাপি বিগ্রহে প্রবৃত্ত হইবেন না। পূর্বোক্ত উপায়ত্ৰয়দ্বারা যে অর্থলাভ হয়, পণ্ডিত ব্যক্তিরা তাহাতেই সন্তুষ্ট হইয়া থাকেন। প্রজাদিগের নিকট হইতে তাহাদিগের উপার্জিত ষড়ভাগ[ছয় ভাগের এক ভাগ] গ্রহণপূৰ্ব্বক তদ্দারা তাহাদিগকে রক্ষা করা এবং মত্ত, উম্মত্ত প্রভৃতি ব্যক্তির অপরাধানুসারে অর্থদণ্ড করিয়া প্রজাবর্গের উপদ্রবনিরাকরণে প্রবৃত্ত হওয়া। ভূপতির অবশ্য কর্ত্তব্য। পুরবাসীদিগকে সুতনির্ব্বিশেষে প্রতিপালন করা রাজার উচিত বটে, কিন্তু বিচারকাল উপস্থিত হইলে কাহারও প্রতি দয়া প্রকাশ করা বিধেয় নহে। অর্থ ও প্রত্যর্থীদিগের বাক্য শ্রবণার্থ বহুদর্শী বিজ্ঞব্যক্তিদিগকে ধর্ম্মাসনে নিয়োগ করা আবশ্যক। ঐরূপ ব্যবহার করিলে ভূপতির রাজ্য চিরস্থায়ী হয়।

“রাজা সুবর্ণ ও লবণাদির আকর, ধান্যাদিবিক্রয়স্থান, নদীসন্তরণস্থান ও নাগবলে অমাত্য বা বিশ্বাসী পুরুষদিগকে, নিযুক্ত করিবেন। যে মহীপাল ন্যায়ানুসারে প্রতিনিয়ত দণ্ডবিধান করেন, তাঁহার ধর্ম্মলাভ হয়। দণ্ডবিধানই রাজার যথার্থ ধর্ম্ম ও প্রশংসনীয়। বেদবেদাঙ্গবেত্তা, প্রাজ্ঞ, তপঃপরায়ণ, দানশীল ও যজ্ঞশীল হওয়া রাজার নিতান্ত আবশ্যক। সুবিচার করিতে না পারিলে তাঁহার স্বর্গ বা যশোলাভের কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই। মহীপাল বলবান্ লোকের বলবীর্য্যে নিতান্ত নিপীড়িত হইলে দুর্গ আশ্রয়পূৰ্ব্বক মিত্রগণকে সুরক্ষিত করিয়া সন্ধিভেদ বা যুদ্ধের চেষ্টায় তৎপর হইবেন। ঐ সময় তিনি বনবাসীদিগকে রাজপথে সন্নিবেশিত, গ্রামবাসীদিগকে গ্রাম হইতে উত্থাপিত করিয়া উপনগরমধ্যে প্রবেশিত এবং দেশবাসী ধনী ও প্রধান প্রধান সৈন্যদিগকে বারংবার আশ্বাসপ্রদানপূর্ব্বক সুরক্ষিত দুর্গসমুদয়ের মধ্যে সন্নিবেশিত করিবেন। রাজ্যের সমুদয় শস্য দুর্গমধ্যে সংস্থাপন করিবেন, এবং যদি শস্য আনয়নে নিতান্ত অশক্ত হয়েন, তবে অগ্নিদ্বারা তৎসমুদয় দগ্ধ করিয়া ফেলিবেন। শস্যসমুদয় যদি ক্ষেত্রমধ্যে থাকে, তাহা হইলে শত্রুসৈন্যগণকে প্রলোভনপূৰ্ব্বক তাহাদের দ্বারা তৎসমুদয় আহরণ করিতে সচেষ্ট হইবেন এবং যদি উহাতে কৃতকাৰ্য্য না হয়েন, তাহা হইলে স্বীয় সৈন্যদ্বারা সমস্ত, বিনষ্ট করিবেন। নদীর সেতুসমুদয় ভগ্ন করিয়া দিবেন। সমুদয় প্রণালীর জল এককালে নির্গত করাইবেন। কূপাদির সলিলে বিষসংযোগ করিবেন। মিত্রগণের রক্ষাবিধান করা কর্ত্তব্য হইলেও তাহা পরিত্যাগ করিয়া শত্রুর প্রবল বিপক্ষ, অনন্তর দেশবাসী মহীপালের আশ্রয়গ্রহণ করিবেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুর্গ উন্মূলিত করিয়া ফেলিবেন। সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃক্ষ ও বিশাল বৃক্ষসমুদয়ের প্রসিদ্ধ শাখাসকল ছেদন করিবেন। চৈত্যের একটি পত্রও ছিন্ন করিবেন না। দুর্গের উপরিভাগে সচ্ছিদ্র সুদীর্ঘ বহিঃপ্রাকার[বাহিরের প্রাচীর] নির্ম্মাণ করিয়া দিবেন। পরিখাসকল সলিলপূর্ণ এবং শূল ও নক্ৰমকরাদিদ্বারা সঙ্কীর্ণ করিয়া রাখিবেন। বায়ুসঞ্চারার্থ নগরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বারসমুদয় নির্ম্মাণপূৰ্ব্বক তত্সমুদয়ে প্রহরী নিয়োগ এবং দৃঢ়তর যন্ত্র ও শতঘ্নী সমুদয় সংস্থাপন করিবেন। ঐ সমুদয় দ্বার দিয়া সকলকেই গমনাগমন করিতে দিবেন। কাষ্ঠ-আহরণ, কুপ-খনন ও পূৰ্ব্বকৃত কুপের সংস্কারসাধন করিবেন। যেসমস্ত গৃহ তৃণসমাচ্ছন্ন, তাহাতে পঙ্ক লেপন করিয়া দিবেন। রাত্রিকালে অন্নপাক করাইবেন। অগ্নিহোত্র ব্যতিরেকে দিবাভাগে কদাচ অগ্নি প্রজ্বলিত করিবেন না। কর্ম্মারগৃহ[কারখানা] ও সূতিকালয়ে সাবধানে অগ্নি প্রজ্বলিত করিতে আদেশ করিয়া স্বয়ং ঐ সমুদয়ের মধ্যে প্রবেশপূৰ্ব্বক অগ্নি আচ্ছাদিত করিয়া দিবেন এবং যে ব্যক্তি দিবাভাগে অগ্নি প্রজ্বালিত করিবে, তাহার প্রাণদণ্ড হইবে বলিয়া রাজ্যমধ্যে ঘোষণা প্রচারিত করিবেন। ভিক্ষুক, শকট, বালক, ক্লীব ও কুশীলব[নৃত্যগীতকারী]দিগকে নগর হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিবেন। উহারা ঐ সময় নগরমধ্যে থাকিলে অনিষ্ট ঘটিবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা।

“চত্বর, তীর্থস্থান ও প্রধান প্রধান লোকের আলয়ে চর-নিয়োগ অবশ্য কর্ত্তব্য। রাজ্যমধ্যে অতি বিস্তীর্ণ রাজপথ, বিপণি, ভাণ্ডাগার, আয়ুধাগার, যোধাগার, অশ্বশালা, গজশালা, বলাধিকরণ[সৈন্যের আবাস], পরিখা ও উপবন প্রস্তুত করিয়া তৎসমুদয় গোপনে রাখা নিতান্ত আবশ্যক। পরবলপীড়িত মহীপাল অর্থ, তৈল, বসা, মধু, ঘৃত, সমস্ত ঔষধ, অঙ্গার, কুশ, মুঞ্জাপত্র, শর, লেখক[বাঁশের কঞ্চী], বালতৃণ, বিষাক্ত বাণ, শক্তি, ঋষ্টি ও প্রাস প্রভৃতি আয়ুধ, ফলমূল, চতুৰ্ব্বিধ বৈদ্য এবং নগরের শোভাপরিবর্ধক ও আমোদজনক নট, নর্ত্তক, মল্ল ও মায়াবীদিগকে সংগ্রহ করিয়া রাখিবেন। ভৃত্য, মন্ত্রী, পুরবাসী বা অন্য কোন ভূপাল, যাহা হইতে রাজার ভয় উৎপন্ন হইবে, তিনি অচিরাৎ তাহাকে আপনার অধীন করিবেন। কোন ব্যক্তি উপকার করিলে রাশি রাশি অর্থপ্রদান বা বিবিধ সান্ত্ববাদ প্রয়োগপূৰ্ব্বক তাহার সৎকার করা কর্ত্তব্য। শাস্ত্রে এইরূপ নির্দিষ্ট আছে যে, রাজা শত্রুকে প্রহার বা বিনাশ করিলে অঋণী হয়েন।

“হে যুধিষ্ঠির! এক্ষণে সপ্তাঙ্গ রাজ্যের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। রাজা স্বয়ং এবং অমাত্য, কোষ, দণ্ড, মিত্ৰসমুদয়, জনপদ ও পুর এই সাতটি রাজ্যের অঙ্গ বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়া থাকে। এই সপ্তাঙ্গ রাজ্য অতিযত্নসহকারে রক্ষা করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। যে মহীপাল ষাড় গুণ্য, ত্রিবর্গ ও মোক্ষের বিষয় বিশেষ অবগত আছেন, তিনি রাজ্যভোগ করিবার সম্যক উপযুক্ত। এক্ষণে ষাড় গুণ্যের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। সন্ধি করিয়া নির্ভয়ে অবস্থান, যুদ্ধগমন, বৈরোৎপাদনপুৰ্ব্বক অবস্থান, শত্রুকে ভীতিপ্রদর্শনার্থ যাত্রার ছল, দ্বেষীভাব ও অন্যের আশ্রয়গ্রহণ, এই ছয়টি ষাড় গুণ্য বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়াছে। এক্ষণে ত্রিবর্গ কীৰ্ত্তন করিতেছি, অনন্যমনে শ্রবণ কর। ক্ষয়, স্থিতি ও বৃদ্ধি এই তিনটি বিষয় ত্রিবর্গ বলিয়া অভিহিত হয়। আর ধর্ম্ম, অর্থ ও কাম এই তিনটিও ত্রিবৰ্গনামে নির্দিষ্ট হইয়া থাকে। পর্য্যায়ক্রমে ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কামের সেবা করা অবশ্য কর্ত্তব্য। রাজা ধর্ম্মাবলম্বী হইলে চিরকাল পৃথিবী প্রতিপালন করিতে পারেন। সুরগুরু বৃহস্পতি, এই বিষয়ে যেরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন, শ্রবণ কর। মহীপাল রাজ্যপালন ও অন্যান্য কর্ত্তব্য কাৰ্য্যসমুদয়ের অনুষ্ঠানপূর্ব্বক অতিপবিত্র সুখভোগ করিয়া থাকেন। যে রাজা ধর্ম্মপরায়ণ হইয়া সুপ্রণালীক্রমে প্রজাপালন করেন, তাঁহার তপস্যা ও যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রয়োজন কি?”

দণ্ডনীতি-কীৰ্ত্তন

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! দণ্ডনীতি ও রাজা এই উভয় হইতে ইহাদের পরস্পরের ও প্রজাগণের কিরূপ সিদ্ধিলাভ হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ। দণ্ডনীতি হইতে রাজা ও প্রজাগণের যেরূপ সৌভাগ্যের উদয় হয়, তাহা সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। দণ্ডনীতি ভূপতিকর্ত্তৃক প্রথানিয়মে প্রযুক্ত হইয়া চারিবর্ণকে নিয়মাবলী, নিঃশঙ্ক, অধৰ্ম্ম হইতে নিবৃত্ত ও স্ব স্ব ধৰ্ম্মে সংস্থাপিত করে। তখন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যগণ যত্নসহকারে বিধিপূৰ্ব্বক স্ব স্ব কাৰ্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়েন এবং তন্নিবন্ধন প্রজাগণের সুখস্বচ্ছন্দতার পরিসীমা থাকে না।

“কাল রাজার কারণ, কি রাজা কালের কারণ, এ বিষয়ে তোমার কিছুমাত্র সন্দেহ করিবার প্রয়োজন নাই। রাজাই কালের কারণ। রাজা যখন দণ্ডনীতির অনুসারে সুচারুরূপে রাজ্যপালন করেন, তখনই সত্যযুগনামে শ্রেষ্ঠ কাল উপস্থিত হয়। ঐ কালে বিন্দুমাত্রও অধৰ্ম্মসঞ্চার হয় না। সকল বর্ণেরই অন্তঃকরণ ধর্ম্মবিষয়ে আসক্ত থাকে। প্রজাগণ অলব্ধবস্তু লাভ ও লব্ধবস্তু পরিবর্ধন করে। বৈদিক কর্ম্মসমুদয় দোষশূন্য হয়। ঋতুসকুল নিরাময় ও সুখাবহ হইয়া উঠে। মানবগণের স্বর, বর্ণ ও মনঃ নিৰ্ম্মল হয়। ব্যাধিসমুদয় তিরোহিত হইয়া যায়। প্রজাগণ দীর্ঘায়ু হইয়া পরমসুখে কালযাপন করে। বিধবা স্ত্রী বা কৃপণ পুষ কুত্রাপি দৃষ্টিগোচর হয় না। পৃথিবী কৃষ্ট না হইয়াও শস্যোৎপাদন করে। ওষধি, ত্বক, পত্র ও ফলমূলসমুদয় তেজঃসম্পন্ন হইয়া উঠে। অধৰ্ম্ম এককালে তিরোহিত এবং ধর্ম্ম সৰ্ব্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়। সত্যযুগে এইরূপে ধৰ্ম্মেরই প্রাদুর্ভাব হইয়া থাকে।

‘যখন রাজা চতুষ্পদ দণ্ডনীতির তিনপাদ গ্রহণ করিয়া রাজ্যপালন করেন, সেই কালকে ত্রেতাযুগ কহে। তখন পাপের একপাদমাত্র সঞ্চারিত হয়। তখন পৃথিবী কৃষ্টা না হইলে প্রচুর পরিমাণে শস্য-উৎপাদনে সমর্থ হয় না। যখন রাজা দণ্ডনীতির অৰ্দ্ধাংশ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অর্ধাংশ গ্রহণ করিয়া প্রজাপালন করেন, সেই কালকে দ্বাপরযুগ কহে। দ্বাপরযুগে অধৰ্ম্মের দুইপাদ কুমণ্ডলে সঞ্চারিত হয়। তখন পৃথিবী কৃষ্টা হইয়াও সত্যযুগে আকৃষ্টাবস্থায় যে ফল উৎপাদন করিত তাহার অর্দ্ধেক ফল উৎপাদন করে। যেসময় নরপতি একমাত্র দণ্ডনীতি পরিত্যাগপূৰ্ব্বক বিবিধ প্রকারে কষ্ট প্রদান করেন, সেই কালকে কলিযুগ কহে। কলিযুগে সকলেই প্রায় অধৰ্ম্মানুষ্ঠানে নিরত হয়। ধৰ্ম্মানুষ্ঠান তিরোহিতপ্রায়[লুপ্তপ্রায়] হইয়া যায়। সকল বর্ণেরই স্বধর্ম্মত্যাগ প্রবৃত্তি জন্মে। শূদ্রেরা ভিক্ষাবৃত্তি ও ব্রাহ্মণেরা দাস্যবৃত্তি অবলম্বন করিয়া জীবিকানির্ব্বাহ করেন। সমুদয় লোকই মঙ্গলহীন এবং সৰ্ব্বত্র বর্ণসঙ্কর প্রাদুর্ভূত হয়। বৈদিক কার্য্যসকল অপরিশুদ্ধ এবং ঋতুসমুদয় ক্লেশকর ও রোগজনক হইয়া উঠে। মনুষ্যগণের স্বর, বর্ণ ও মনোবৃত্তির হ্রাস হইয়া যায়। নানাপ্রকার ব্যাধি ও অকালমৃত্যু জীবগণকে আক্রমণ করিতে আরম্ভ করে। রমণীগণ বিধবা ও প্রজাগণ নৃশংস হইতে থাকে। নিরূপিত সময়ে বৃষ্টিপাত বা শস্যোৎপত্তি হয় না এবং সমুদয় রস ক্ষীণ হইয়া যায়।

“অতএব রাজাকেই সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিযুগের কারণ বলিতে হইবে। যে রাজা হইতে সত্যযুগের উৎপত্তি হয়, তিনি সম্পূর্ণ স্বর্গসুখ অনুভব করেন; যাঁহা হইতে ত্রেতাযুগের উৎপত্তি হয়, তিনি ত্রিপাদ স্বর্গসুখভোগে অধিকারী হয়েন, যাঁহা হইতে দ্বাপরযুগের উৎপত্তি হয়, তিনি দ্বিপাদ স্বর্গসুখ অনুভব করিয়া থাকেন; আর যিনি কলিযুগোৎপত্তির কারণ হয়েন, তাঁহাকে সম্পূর্ণ পাপভোগ করিতে হয়। কলির রাজা স্বীয় দুষ্কৰ্ম্মনিবন্ধন প্রজাগণের পাপে মগ্ন হইয়া ইহলোকে অকীৰ্ত্তিলাভ ও পরলোকে বহুদিন ঘোর নরকে বাস করেন।

“ক্ষত্রিয় দণ্ডনীতির অনুগামী হইয়া সৰ্ব্বদা অপ্রাপ্ত বস্তুর লাভাকাঙ্ক্ষা ও প্রাপ্ত বস্তুর রক্ষা করিবেন। দণ্ডনীতি যথানিয়মে প্রযুক্ত হইলে সুশৃঙ্খলতাসম্পাদন ও মাতা-পিতার ন্যায় মঙ্গল বিধান করে। উহার প্রভাবেই প্রাণীগণ জীবিত থাকে। দণ্ডনীতি অনুসারে কার্য্য করা রাজার প্রধান ধৰ্ম্ম; অতএব এক্ষণে তুমি নীতিপরায়ণ হইয়া ধৰ্ম্মানুসারে প্রজাপালন কর, তাহা হইলে দুর্জ্জয় স্বর্গলোক জয় করিতে পারিবে।”