০৬৭. রাজার প্রয়োজনীয়তা–অরাজক রাজ্যের দোষ

৬৭তম অধ্যায়

রাজার প্রয়োজনীয়তা–অরাজক রাজ্যের দোষ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপনি চারি-আশ্রম ও চারি বর্ণের কর্ত্তব্য কার্য্য কীৰ্ত্তন করিলেন। এক্ষণে রাজ্যের হিতসাধনার্থ যাহা কৰ্ত্তব্য, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! সৰ্ব্বপ্রথমে রাজ্যমধ্যে রাজাকে অভিষেক করাই প্রধান কার্য্য। রাজ্য অরাজক ও বলবিহীন হইলেই দস্যুরা উহা আক্রমণ করে, ধৰ্ম্ম উহাতে ক্ষণকালও অবস্থান করেন না এবং প্রজারা পরস্পর পরস্পরের মাংসভক্ষণে প্রবৃত্ত হয়। শাস্ত্রে রাজা ইন্দ্র বলিয়া কীৰ্ত্তিত হইয়াছেন। অতএব উদয়োম্মুখ [উন্নতির পথে অগ্রসর] হইবার বাসনা করিলে নরপতিকে ইন্দ্রের ন্যায় পূজা করা কর্ত্তব্য। অরাজক রাজ্যমধ্যে অগ্নি হবিগ্রহণ করেন না। আমার মতে অরাজক রাজ্যে বাস করাই বিধেয় নহে। অরাজকতা অপেক্ষা পাপজনক আর কিছুই নাই। রাজ্যের অরাজকাবস্থায় যদি কোন বলবান ব্যক্তি আগমনপূর্ব্বক উহা গ্রহণাভিলাষে আক্রমণ করেন, তাহা হইলে তাঁহাকে তৎক্ষণাৎ প্রত্যুদগমনপুৰ্ব্বক[অভ্যর্থনা করিয়া] সম্মানিত করা প্রজাগণের অবশ্য কর্ত্তব্য। কেন না, ঐ বলবান ব্যক্তি প্রজাদিগের কর্ত্তৃক সম্মানিত হইলে তত্ত্বাবধারণ দ্বারা উহার মঙ্গলসম্পাদন করিতে পারেন। আর যদি প্রজারা উঁহাকে সম্মান না করে, তাহা হইলে তিনি ক্রূদ্ধ হইয়া নিশ্চয়ই এককালে সমস্ত নিঃশেষিত করিয়া ফেলেন। অতএব সেরূপ স্থলে মৃদুতা অবলম্বন করাই প্রজাদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। দেখ, যে গাভীকে কষ্টে দোহন করিতে হয়, সে সমধিক ক্লেশভোগ করে, আর যাহাকে সুখে দোহন করা যায়, সে কিছুমাত্র কষ্টভোগ করে না। যে স্বয়ং প্রণত[সম্যক প্রকারে মত] হয়, তাহাকে তাপিত এবং যে বৃক্ষ স্বয়ং অবনত হইয়া থাকে, তাহাকে কিছুমাত্র ক্লেশ প্রাপ্ত হইতে হয় না। অতএব বলবান ব্যক্তির নিকট প্রণত হওয়াই উচিত। বলীয়ান্‌ ব্যক্তিকে প্রণাম করিলেই ইন্দ্রকে নমস্কার করা হয়।

“মঙ্গললাভার্থী ব্যক্তিদিগের পক্ষে একজনকে নরপতিপদে অভিষেক করা অবশ্য কর্ত্তব্য। রাজ্য অরাজক হইলে কেহই নির্ব্বিঘ্নে স্ত্রীসম্ভোগ ও ধৰ্ম্ম-উপভোগ করতে পারে না। ঐ সময় পাপাত্মারা অন্যের ধন অপহরণ করিয়া মহা আহ্লাদিত হয়, কিন্তু যখন অপরাপর ব্যক্তিরা তাহার ধন হরণ করে, তখন সে বাজার সাহায্য প্রাপ্ত হইতে বাসনা করে; অতএব অরাজকতা পাপাত্মাদিগেরও সুখজনক নহে। ঐ সময় দুইজন পাপাত্মা একত্র হইয়া এক ব্যক্তির এবং অনেক লোক একত্র হইয়া সেই দুইজনের ধন অপহরণ করে। বলবান্ ব্যক্তি দুর্ব্বলকে আপনার দাস করিয়া রাখে এবং বলপূৰ্ব্বক পরস্ত্রীহরণে প্রবৃত্ত হয়।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! ঐ সকল দৌরাত্ম নিবারণের নিমিত্তই দেবতারা রাজ্যমধ্যে নরপতির আবশ্যকতা নির্দেশ করিয়া দিয়াছেন। যদি পৃথিবীমধ্যে রাজা দণ্ড ধারণ না করেন, তাহা হইলে সলিলস্থ বৃহৎ মৎস্যেরা যেমন ক্ষুদ্র মৎস্যসমুদয়কে ভক্ষণ করে, সেইরূপ বলবান ব্যক্তিরা দুৰ্ব্বলদিগকে ভক্ষণ করিতে প্রবৃত্ত হয়।

অরাজক রাজ্যে ব্রহ্মার রাজনিয়োগ—মনুমন্তব্য

“পূর্ব্বকালে পৃথিবী ভূপতিবিহীন হওয়াতে প্ৰজাসকল পরস্পর পরস্পরকে ভক্ষণ করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। ঐ সময় কতকগুলি ধৰ্ম্মপরায়ণ লোক একত্র সমবেত হইয়া এই নিয়ম করিলেন যে, যে ব্যক্তি নিষ্ঠুরভাষী, উগ্ৰস্বভাব, পরদারাভিমর্ষী[পরনারী-পীড়নকারী] ও পরস্বাপহারক[পরধনহারী] হইবে, আমরা তাদৃশ লোকসকলকে পরিত্যাগ করিব। প্রজাগণ সকল বর্ণের বিশ্বাসের নিমিত্ত এইরূপ নিয়ম নির্দ্ধারণপূৰ্ব্বক কিয়ৎকাল অতিবাহিত করিয়া পরিশেষে নিতান্ত অসুখিত-চিত্তে লোকপিতামহ ব্রহ্মার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিল, “ভগবন্! আমরা রাজার অভাবে বিনষ্ট হইতেছি; অতএব আপনি আমাদিগকে একজন রাজা প্রদান করুন। আমরা সকলে তাঁহাকে পূজা করিব এবং তিনিও আমাদিগকে প্রতিপালন করিবেন।’

“লোকপিতামহ ব্রহ্মা প্রজাগণের বাক্য শ্রবণ করিয়া মনুকে তাহাদের প্রতিপালনে আদেশ করিলে মনু উহা স্বীকার না করিয়া কহিলেন, “আমি পাপানুষ্ঠানে নিতান্ত ভীত হইয়া থাকি। রাজ্যশাসন, বিশেষতঃ মিথ্যাপরায়ণ মনুষ্যগণকে স্বধর্ম্মে সংস্থাপন অতি দুরূহ ব্যাপার।’ তখন প্রজাগণ মনুকে কহিল, ‘প্রভো! ভীত হইবেন না, পাপ আপনাকে স্পর্শ করিবে না। আমরা আপনার কোষবর্দ্ধনের[ধনবৃদ্ধির] নিমিত্ত পশু ও সুবর্ণের পঞ্চাশদ্‌ভাগ এবং ধান্যের দশমভাগ প্রদান করিব। বিবাদ, দ্যূতক্রীড়া ও শুল্কপ্রসঙ্গ[বিবাহবিষয়ক পণের কথা] উপস্থিত হইলে আপনি অতি মনোহররূপা কন্যা প্রাপ্ত হইবেন। আর যাহারা অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োগ ও বাহনারোহণে প্রধান হইবে, তাহারা দেবগণ যেমন ইন্দ্রের অনুগমন করেন, তদ্রূপ আপনার অনুগমন করিবে, তাহা হইলেই আপনি মহাবলপরাক্রান্ত ও প্রবলপ্রতাপ হইয়া কুবেরের ন্যায় পরমসুখে আমাদিগকে প্রতিপালন করিতে পারিবেন। আর আমরা আপনার পরাক্রমে রক্ষিত হইয়া যে যে ধর্ম্মের অনুষ্ঠান করিব, আপনি তাহার চতুর্থাংশভাগী হইবেন। অতএব মহারাজ! আপনি এক্ষণে দেবরাজ ইন্দ্রের ন্যায় আমাদিগকে প্রতিপালন করুন; সূৰ্য্যের ন্যায় শত্রুগণকে প্রতাপিত করিয়া জয়লাভার্থ নির্গত হউন, আপনার প্রভাবে শত্রুগণের দর্প চূর্ণ হউক এবং ধর্ম্ম নিয়ত আমাদিগকে রক্ষা করুন।

মনুর প্রজাপিলনার্থ রাজত্বগ্রহণ

“প্রজাগণ এই কথা কহিলে সেই সৎকুলোদ্ভব মহাতেজস্বী মনু অসংখ্য সৈন্যসমাবৃত হইয়া তেজঃপুঞ্জকলেবরে প্রজাপালনার্থ নির্গত হইলেন। প্রজাগণ দেবরাজ ইন্দ্রের ন্যায় মনুর মহত্ত্ব দর্শনে ভীত হইয়া স্ব স্ব ধৰ্ম্মে নিরত হইল। এইরূপে মহারাজ মনু সৰ্ব্বতোভাবে পাপের শাস্তিবিধানপূৰ্ব্বক প্রজাদিগকে স্ব স্ব কৰ্ম্মে সংযোজিত করিয়া মহীমণ্ডলে আধিপত্য বিস্তার করিলেন।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! এই ভূমণ্ডলে যাঁহারা মঙ্গল কামনা করেন, তাঁহাদিগের সব্বাগ্রে রাজার আশ্রয় গ্রহণ করা কর্ত্তব্য। দেবতারা যেমন দেবরাজ ইন্দ্রকে ও শিষ্যগণ যেমন গুরুকে সর্ব্বদা প্রণাম করে, তদ্রূপ রাজাকে ভক্তিপূৰ্ব্বক প্রণাম করা প্রজাগণের অবশ্য কৰ্ত্তব্য। ইহলোকে যে ব্যক্তি আত্মীজনকর্ত্তৃক সৎকৃত হয়, সে শত্রুপক্ষেরও সমাদরভাজন হইয়া থাকে; আর যে ব্যক্তি আত্মীয়লোকের অবজ্ঞার পাত্র হয়, শত্রুগণ তাহাকে অনায়াসে পরাভব করিলে প্রজারা সকলেই অসুখী হয়; অতএব নরপতিকে ছত্র, বাহন, বস্ত্র, আভরণ, অন্ন, পান, গৃহ, শয্যা ও আসন প্রভৃতি সমুদয় ব্যবহারোপযোগী দ্রব্য প্রদান করা প্রজাদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। তাহা হইলে রাজা শত্রুগণের দুর্দ্ধর্ষ হইয়া উঠেন, সর্ব্বদা সকলকে হাস্যমুখে মধুরবাক্যে সম্ভাষণ করেন এবং কৃতজ্ঞ, অনুরাগী ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া প্রজাগণের রক্ষণাবেক্ষণে যত্নবান হয়েন।”