০৮৭. রাজ্যবিস্তার–সামন্তদ্বারা রাজ্যপালন

৮৭তম অধ্যায়

রাজ্যবিস্তার–সামন্তদ্বারা রাজ্যপালন

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! কিরূপে রাজ্যপালন ও রাজ্যসংগ্রহ করিতে হয়, তাহা সবিশেষ কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! যেরূপে রাজ্যরক্ষা ও রাজ্যসংগ্রহ করিতে হয়, তাহা সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিতেছি, অবহিত হইয়া শ্রবণ কর। কাহাকে এক গ্রামের, কাহাকে দশ গ্রামের, কাহাকে বিংশতি গ্রামের, কাহাকে শত গ্রামের ও কাহাকে সহস্র গ্রামের আধিপত্য প্রদান করা নরপতির কর্ত্তব্য। ঐ সকল গ্রামাধিপতি ভূপতিকর্ত্তৃক নিযুক্ত হইয়া প্রজারক্ষণে যারপরনাই যত্নবান্ হইবেন এবং এক গ্রামের অধিপতি দশ গ্রামের অধিপতির নিকট, দশ গ্রামাধিপতি বিংশতি গ্রামাধিপতির নিকট এবং বিংশতি গ্রামাধিপতি শত গ্রামাধিপতির নিকট আপন আপন অধিকারস্থ মানবগণের দোষ নির্দেশ করিবেন। এইরূপে সকলেরই অপেক্ষাকৃত উচ্চপদারূঢ় ব্যক্তির নিকট স্ব স্ব প্রজাগণের দোষ প্রকাশ করা আবশ্যক। গ্রামসমুৎপন্ন দ্রব্যসমুদয়ে গ্রামিকের অধিকার থাকে। এক গ্রামাধিপতি দশ গ্রামরক্ষককে ও দশ গ্রামাধিপতি বিংশতি গ্রামের রক্ষককে কর প্রদান করিবেন। শত গ্রামের অধিপতি এক বহুজনপূর্ণ প্রধান গ্রামের সমুদয় দ্রব্য ভোগ করিতে পারেন। শত গ্রামাধিপতির ভোগ্যগ্রাম বহু গ্রামাধিপতির আয়ত্ত থাকা আবশ্যক। সহস্র গ্রামের অধিপতি ধনধান্যপরিপূর্ণ শাখানগরভোগে অধিকারী হইয়া থাকেন। ঐ সকল গ্রামপালের সংগ্রাম ও গ্রামসম্বন্ধীয় অন্যান্য কাৰ্য্য পর্য্যবেক্ষণ করিবার নিমিত্ত একজন আলস্যবিহীন বিচক্ষণ মন্ত্রীকে এবং প্রতি নগরের কাৰ্য্যদর্শনার্থ একজন সৰ্ব্বাধ্যক্ষকে নিযুক্ত করা রাজার আবশ্যক। গ্রহগণ যেমন নক্ষত্রগণের উচ্চস্থানে অবস্থান করে, তদ্রূপ সর্বাধ্যক্ষগণ সমুদয় সভাসদের উচ্চপদে অধিরূঢ় হইয়া চরদ্বারা তাঁহাদিগের ব্যবহার পরীক্ষা করিবেন।

বাণিজ্যবিষয়ক ব্যবস্থা

“অধিকারস্থ হিংসাপরায়ণ পরধনাপহারী শঠদিগের হস্ত হইতে প্রজাগণের রক্ষা এবং বণিকগণের ক্রয়, বিক্রয়, বৃদ্ধি, পথ [পণ্য আমদানী-রপ্তানী করার জন্য জলপথ ও স্থলপথ] ও গ্রাসাচ্ছাদন আর শিল্পজীবীদিগের উৎপত্তিদান [শুল্ক— উৎপত্তিকর] বৃদ্ধি বিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়া তাহাদিগের নিকট হইতে করগ্রহণের নিয়ম নির্দ্ধারণ করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। রাজা নানাপ্রকারে প্রজাদিগের নিকট কর গ্রহণ করিবেন, কিন্তু যাহাতে তাহারা অবসন্ন হয়, কদাচ, এরূপ কাৰ্য্য করিবেন না। ফল ও কাৰ্য্যের পরীক্ষা না করিয়া নিয়ম সংস্থাপন করা নরপতির কর্ত্তব্য নহে। কেহই কারণ ব্যতীত কার্য্যানুষ্ঠান বা ফল লাভ করে না। যখন যাহাতে রাজা ও কৰ্ম্মবেত্তা উভয়েরই কার্য্যের ফলভোগ হয়, এইরূপ বিবেচনা করিয়া সর্ব্বদা করগ্রহণের নিয়ম নির্দ্ধারণ করা ভূপতির কর্ত্তব্য। ধনলালসায় নিতান্ত বিমোহিত হইয়া রাজ্য ও কৃষিবাণিজ্যাদি এককালে উচ্ছিন্ন করা কোনক্রমেই বিধেয় নহে। রাজা অপরিমিত কর গ্রহণ করিলে সকলেরই দ্বেষভাজন হয়েন; সুতরাং তাহার মঙ্গললাভের সম্ভাবনা কোথায়? যে ব্যক্তি সকল লোকের অপ্রিয়, সে কখনই অভিলষিত ফল লাভ করিতে পারে না। বৎস যেমন দুগ্ধপানদ্বারা বলবান্ হইলে বিপুল ভার বহন করিতে পারে, আর স্তন্যপানের ব্যাঘাতনিবন্ধন ক্ষীণ হইলে কোন কার্য্যের অনুষ্ঠানে সমর্থ হয় না, তদ্রূপ প্রজাগণ রাজার পরিমিত করগ্রহণনিবন্ধন বিভবশালী হইলে অনায়াসে অসংখ্য সৎক্রিয়ার অনুষ্ঠানে সমর্থ হয়, আর অপরিমিত করগ্রহণনিবন্ধন হৃতসৰ্ব্বস্ব হইলে কোন কাৰ্য্যই সম্পাদন করিতে পারে না। অতএব অপরিমিত কর গ্রহণ করা রাজার নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। যে রাজা স্বয়ং যত্নবান্ হইয়া রাজ্য রক্ষা করেন, তাহার নানাবিধ উৎকৃষ্ট ফল লাভ হইয়া থাকে। প্রজারা সকলেই তাঁহার আপদ্‌নিবারণাৰ্থ ধন প্রদান করে এবং তাঁহার রাষ্ট্র কোষের [কোষাগারের] ন্যায় ও কোষ শয়নগৃহের [ধনরত্ন সৰ্ব্বদা করস্থের] ন্যায় হইয়া উঠে। পুর ও জনপদবাসী আশ্রিতগণ নিতান্ত দীনদরিদ্র হইলেও তাহাদের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করা রাজার কর্ত্তব্য। যে রাজা অসভ্য দস্যুগণকে নিপীড়িত করিয়া গ্রামস্থ লোকদিগকে প্রতিপালন করেন, তাঁহার প্রজাগণ তাঁহার সুখে সুখী ও দুঃখে দুঃখী হইয়া থাকে এবং তাঁহার প্রতি কুপিত হয় না। রাজা প্রথমে মনে মনে ধনলাভের বাসনা করিয়া প্রজাগণকে ভয়প্রদর্শনপূর্ব্বক কহিবেন, দেখ, আমার রাজ্যে শত্রুভয় উপস্থিত হইয়াছে, কিন্তু ইহা ফলিত বংশের [ফলবান্ বংশের—বাঁশের ফল হইলে বাঁশ মরিয়া যায়] ন্যায় অচিরাৎ বিনষ্ট হইবে। শত্রুগণ দস্যুদলের সহিত মিলিত হইয়া আত্মবিনাশের নিমিত্তই আমার রাজ্য আক্রমণ করিতে অভিলাষ করিতেছে। এক্ষণে এই ঘোরতর ভয়াবহ আপদ সমুপস্থিত হওয়াতে আমি তোমাদিগের পরিত্রাণার্থ অর্থ প্রার্থনা করিতেছি। উপস্থিত ভয় নিরাকৃত হইলে আমি তোমাদিগের ধন তোমাদিগকে পুনরায় প্রদান করিব। আর শত্রুগণ যদি বলপূৰ্ব্বক তোমাদের ধন গ্রহণ করে, তাহা হইলে তোমরা কদাচ উহা পুনঃপ্রাপ্ত হইবে না। বিশেষতঃ অরাতিগণ রাজ্য আক্রমণ করিলে তোমাদের পুত্ৰকলত্রাদিও বিনষ্ট হইবে। তাহা হইলে তোমাদের অর্থ আর কে ভোগ করিবে? তোমরা আমার পুত্রের ন্যায়, আমি তোমাদের সমৃদ্ধিদর্শনে যারপরনাই পরিতুষ্ট হইয়া এই আপৎকালে রাজ্যরক্ষাৰ্থ তোমাদিগের নিকট অর্থ প্রার্থনা করিতেছি। তোমরা যথাশক্তি ধনপ্রদানপূর্ব্বক রাজ্যের উপদ্রব নিবারণ কর। বিপদকালে ধনকে প্রিয় বোধ করা নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য।’

“কালজ্ঞ মহীপাল এইরূপে করগ্রহণের উপায় উদ্ভাবনপুৰ্ব্বক পদাতি প্রেরণ করিয়া সাদর ও সুমধুরবাক্যে প্রজা হইতে ধন গ্রহণ করিবেন। প্রাকারনির্ম্মাণ, ভৃত্যদিগের প্রতিপালন প্রভৃতি নানাপ্রকার কারণ প্রদর্শন করিয়া বৈশ্যদিগের নিকট করগ্রহণ করা রাজার কর্ত্তব্য। বৈশ্যদিগের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিলে উহারা বনে গমন করিয়া বাস করে; এতএব ভূপতি উহাদিগের সহিত মৃদু ব্যবহার করিবেন। উহাদের প্রিয়কার্য্যাসাধন, সান্ত্বনা, রক্ষাবিধান ও উহাদিগকে অর্থদানপূর্ব্বক উহাদিগের প্রযত্নসমুৎপন্ন ফল ভোগ করা রাজার কর্ত্তব্য। বৈশ্যেরা রাজ্য, ব্যবহার ও কৃষিকার্য্যের সবিশেষ উন্নতিসাধন করিয়া থাকে। অতএব দয়ালু অপ্রমত্ত রাজা তাহাদের প্রতি প্রীতি প্রদর্শন ও তাহাদিগের নিকট পরিমিত কর গ্রহণ করিবেন। বৈশ্যদিগের মঙ্গলানুষ্ঠান করা অতি সুলভ এবং উহা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট কাৰ্য্য আর কিছুই নাই।”