০৯২. রাজার ধার্ম্মিকতা—বামদেব-বসুমনার কথা

৯২তম অধ্যায়

রাজার ধার্ম্মিকতা—বামদেব-বসুমনার কথা

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! নরপতি ধৰ্ম্মপরায়ণ হইতে মানস করিলে কিরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিবেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! তত্ত্বার্থদর্শী ভগবান্ বামদেব যে পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিয়া গিয়াছেন, তাহা শ্রবণ কর। একদা শুদ্ধাচারী কোশলরাজ বসুমনা মহর্ষি বামদেবকে কহিলেন, ‘ভগবন্! যাহাতে আমি স্বধৰ্ম্মচ্যুত না হই, আপনি আমাকে এরূপ কোন উপদেশ প্রদান করুন। তখন মহর্ষি বামদেব নহুষনন্দন যতিতুল্য প্রভাবশালী কোশলরাজকে কহিলেন, ‘মহারাজ! ধর্ম্মপথ আশ্রয় কর। ধৰ্ম্মের পর শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নাই। ধৰ্ম্মপরায়ণ ভূপতিগণ অনায়াসে পৃথিবী জয় করিতে পারেন। যে রাজা ধর্ম্মকে অর্থসিদ্ধির দ্বারস্বরূপ বিবেচনা করিয়া সাধুলোকের উপদেশানুসারে কাৰ্য্যানুষ্ঠান করেন, তিনি ধর্ম্মপ্রভাবে দেদীপ্যমান হইয়া পরমসুখে কালাতিপাত করিতে সমর্থ হয়েন। আর যে অধার্ম্মিক রাজা বলপ্রকাশপূৰ্ব্বক অর্থসিদ্ধির চেষ্টা করেন, তাঁহার ধর্ম্ম ও অর্থ উভয়ই অবিলম্বে ধ্বংস হইয়া যায়। যে ধর্ম্মঘাতক নরপতি পাপিষ্ঠ মন্ত্রীর বশবর্ত্তী হইয়া কার্য্যানুষ্ঠান করেন, তিনি সকলের বধ্য; তাঁহাকে অচিরাৎ সপরিবারে বিনষ্ট হইতে হয়। গৰ্ব্বিত, কার্য্যানুষ্ঠানপরাঙ্মুখ, যথেচ্ছাচারী ভূপতি এই অখণ্ড ভূমণ্ডলের একাধিপতি হইলেও অচিরাৎ কালকবলে নিপতিত হয়েন। কল্যাণাকাঙ্ক্ষী, অসূয়াবিহীন, জিতেন্দ্রিয়, বুদ্ধিমান রাজা সাগরের ন্যায় ক্রমে ক্রমে পরিবর্দ্ধিত হইয়া থাকেন। ধৰ্ম্ম, অর্থ, কাম এবং বুদ্ধি ও মিত্রই রাজ্যরক্ষার প্রধান উপায়; অতএব ঐ সমুদয় অল্পমাত্ৰ লাভ করিয়া আপনাকে পরিতৃপ্ত-জ্ঞান করা নরপতির কৰ্ত্তব্য নহে।

‘হে মহারাজা নরপতি এই সমুদয় উপদেশবাক্য শ্রবণ করিলে বিপুল ঐশ্বৰ্য্য, কীৰ্ত্তি ও প্রজা লাভ করিতে পারেন। যে ধর্ম্মার্থদর্শী মহীপাল এই উপদেশানুসারে বিবেচনা করিয়া অর্থোপায়ের চেষ্টা করেন, তাঁহার উন্নতিলাভে কিছুমাত্র সংশয় নাই। স্নেহশূন্য অদাতা ভূপতি প্রজাগণের প্রতি নিরন্তর দণ্ডবিধান করিয়া অচিরাৎ বিনষ্ট হইয়া যান। বুদ্ধিহীন রাজা প্রায়ই আপনার পাপকাৰ্য্য বুঝিতে পারেন না; সুতরাং তাঁহাকে ইহলোকে অকীৰ্ত্তিলাভ ও পরলোকে ঘোরতর নরকভোগ করিতে হয়। রাজা সম্মানজ্ঞ, দাতা ও মিষ্টভাষী হইলে মানবগণ তাঁহার বিপদ আপনাদিগের বিপদের ন্যায় জ্ঞান করিয়া প্রাণপণে উহার নিবারণে যত্নবান হয়। যে রাজার ধৰ্ম্মোপদেষ্টা গুরু বিদ্যমান নাই এবং যিনি অন্যের নিকট ধর্ম্ম জিজ্ঞাসা না করিয়া স্বেচ্ছানুসারে অর্থসংগ্রহে বাসনা করেন, তিনি কোনক্রমেই চিরকাল সুখভোগ করিতে পারেন না। আর যিনি উপদেশকের বশীভূত হইয়া স্বয়ং সমুদয় কাৰ্য্য পর্য্যালোচনা ও ধর্ম্মানুসারে অর্থলাভের চেষ্টা করেন, তিনি যাবজ্জীবন সুখভোগে সমর্থ হয়েন।’ ”