০৮০. রাজমস্ত্রিনিরূপণ

৮০তম অধ্যায়

রাজমস্ত্রিনিরূপণ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! রাজ্যশাসনের কথা দূরে থাক, সামান্য কার্য্যও একাকী সাধন করা নিতান্ত সুকঠিন; অতএব রাজকার্য্য করিতে হইলে ঋত্বিক ও মন্ত্রী প্রভৃতির সাহায্য ও পরামর্শগ্রহণ করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। এক্ষণে আপনি রাজমন্ত্রী কিরূপ স্বভাব ও কিরূপ আচারসম্পন্ন হইবেন এবং রাজা কিরূপ লোকের প্রতি বিশ্বাস আর কিরূপ লোকের প্রতিই বা অবিশ্বাস করিবেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন,“ধৰ্ম্মরাজ! নরপতিদিগের মিত্র চারিপ্রকার— এককাৰ্য্যসাধনসমুদ্যত[একমতে সকলে কার্য্যসাধনে উদ্‌যুক্ত], অনুগত, সহজ ও কৃত্রিম। এতদ্ভিন্ন ধৰ্ম্মাত্মা ব্যক্তিকেও রাজার মিত্র বলিয়া গণনা করা যায়, কিন্তু রাজা অধার্ম্মিক হইলে তিনি কদাপি তাঁহার সহিত মিত্ৰতা করেন। না। পক্ষপাতশূন্য, অকপট, ধর্ম্মপরায়ণ ব্যক্তি ধার্মিকের আশ্রয়গ্রহণেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া থাকেন। বিজিগীষু নরপতিদিগের কেবল ধর্ম্মপথ অবলম্বন করিলেই কার্য্যসিদ্ধ হয় না; তাঁহাদিগকে ধর্ম্ম ও অধৰ্ম্ম দুই পথই অবলম্বন করিতে হয়। অতএব যে ব্যক্তির যাহা অভিমত নহে, ভূপতি কদাচ তাহার নিকট তাহা প্রকাশ করিবেন না।

“পূর্ব্বোক্ত চারিপ্রকার মিত্রের মধ্যে অনুগত ও সহজ মিত্রই শ্রেষ্ঠ। অপর দুইপ্রকার মিত্রকে সতত ভয় করা কর্ত্তব্য। আর দুষ্ট অমাত্যের নিগ্রহ প্রভৃতি কার্য্যবিশেষের অনুষ্ঠানসময়ে সর্ব্বপ্রকার মিত্রকেই ভয় করিয়া কাৰ্য্য করা উচিত। সতত অবহিত হইয়া মিত্রগণের স্বভাব পরীক্ষা করা অবশ্য কর্ত্তব্য। ভূপতি প্রমাদযুক্ত হইলে সকলেই তাঁহাকে পরাভব করে। মনুষ্যের চিত্ত স্বভাবতঃই চঞ্চল। সময়ক্রমে সাধুব্যক্তি অসাধু ও অসাধুব্যক্তি সাধু এবং শত্রু মিত্র ও মিত্র শত্রু হইয়া উঠে। অতএব কাহারও প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস না করিয়া আবশ্যক কার্য্যসমুদয় স্বয়ং সম্পন্ন করাই কর্ত্তব্য। সকলের প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিলে ধর্ম্ম ও অর্থের উচ্ছেদ হয়, আর একেবারে সকলের প্রতি অবিশ্বাস করিলেও মৃত্যুলাভের বিলক্ষণ সম্ভাবনা। সম্পূর্ণ বিশ্বাস অকালমৃত্যুস্বরূপ। সৰ্ব্বত্র বিশ্বাস করিলে নিশ্চয়ই বিপদগ্রস্ত হইতে হয়। যে যাহার প্রতি দৃঢ়বিশ্বাস করে, সে তাহার ইচ্ছাক্রমেই জীবিত থাকে; অতএব বিশ্বাস ও শঙ্কা উভয় থাকা আবশ্যক। এই সনাতন নীতিমার্গের প্রতি সতত দৃষ্টিপাত করা অবশ্য কর্ত্তব্য। উত্তরাধিকারীর[পরবর্ত্তী রাজ্যাধিকারীর] প্রতি অনিষ্টাশঙ্কা করা উচিত। পণ্ডিতগণ উত্তরাধিকারীকে অমিত্র বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। লোকে তড়াগসমীপস্থ স্বীয় ক্ষেত্রের সেতুভেদপূৰ্ব্বক জল আনয়ন করিলে যেমন তাহার ও তৎসমীপবর্ত্তী অন্যান্য ক্ষেত্রের শস্যহানি হয়, তদ্রূপ রাজ্যের শেষসীমারক্ষক প্রবল অরাতিদিগের সমীপে থাকিয়া নিয়ম ভগ্ন করিলে তাহার দোষে সমুদয় রাজ্যের ক্ষয় হইবার সম্ভাবনা; অতএব শেষসীমারক্ষককে মিত্ৰবোধে বিশ্বাস করা রাজার কর্ত্তব্য নহে।

“যাহার উন্নতিদর্শনে আনন্দের সীমা থাকে না এবং যাহার হ্রাস হইলে কাতর হইতে হয়, সেই যথার্থ মিত্র। আপনার অভাবে যাহার অভাব হয়, পিতার ন্যায় তাহার প্রতি বিশ্বাস করা কর্ত্তব্য। ধর্ম্মকাৰ্য্যের সময়েও যিনি নিয়ত আপদ হইতে উদ্ধার করেন, শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি সৰ্ব্বতোভাবে তাঁহার উন্নতিসাধন করিবে। যে ব্যক্তি বন্ধুর বিপদ চিন্তা করিয়া ভীত হয়, সেই যথার্থ মিত্র। আর যাহারা বন্ধুর বিপদ কামনা করে, তাহারা শত্রু বলিয়া পরিগণিত হয়। যে ব্যক্তি বিপদের সময় ভীত হয় এবং সম্পদে অনুতাপ করে না, তাহাকে আত্মতুল্য জ্ঞান করা কর্ত্তব্য; রূপবান, স্বরবান্[মধুরভাষী], ক্ষমাবান্‌, পরদ্বেষশূন্য ও সৎকুলসম্ভূত ব্যক্তিও তাদৃশ মিত্র হইতে অনেক বিভিন্ন।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! তোমার ঋত্বিক্‌, আচাৰ্য্য বা সখা যদি সরলস্বভাব, মেধাবী ও কার্য্যদক্ষ হয়েন, মানিত হউন বা অবমানিত হউন, যদি তোমার প্রতি দোষারোপ না করেন এবং অমাত্যপদবী গ্রহণ করিয়া তোমার ভবনে বাস করিতে সম্মত হয়েন, তাহা হইলে তাঁহাদিগের পরমসমাদর ও পিতার ন্যায় বিশ্বাস করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। তাঁহাদের নিকট গূঢ়মন্ত্রণা ও ধৰ্ম্মার্থের বিষয় প্রকাশ করিলে তোমার কিছুমাত্র বিপদের আশঙ্কা নাই।

“এক কাৰ্য্যসম্পাদনের নিমিত্ত একজন অধ্যক্ষকেই নিযুক্ত করা উচিত। অনেক ব্যক্তির উপর এক কার্য্যের অধ্যক্ষতা প্রদান করিলে মতভেদবশতঃ কাৰ্য্যহানি হইবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা। যিনি কীর্ত্তিমান, কার্য্যদক্ষ, মিতভাষী ও নীতিমর্য্যাদাসম্পন্ন, যিনি অনিষ্টচিন্তা ও সমর্থদিগের প্রতি দ্বেষপ্রকাশে নিরত থাকেন এবং যিনি কাম, ক্রোধ, লোভ বা ভয়ের বশবর্ত্তী হইয়া কদাচ ধর্ম্ম পরিত্যাগ করেন না, তুমি তাঁহাকেই প্রধানপদে নিযুক্ত করিবে। কুলশীলসম্পন্ন, ক্ষমাবান, বলশালী, মান্য, বিদ্বান, অহঙ্কারহীন ও কার্য্যাকার্য্যবিবেককুশল মহাত্মাদিগকেই অমাত্যপদে নিযুক্ত করিয়া তাঁহাদের যথোচিত সম্মান ও সাহায্য গ্রহণ করা কর্ত্তব্য। তাঁহারা পরস্পরের প্রতি স্পৰ্দ্ধাপ্রকাশপূর্ব্বক কাৰ্য্যানুষ্ঠান ও পরস্পর যুক্তিসহকারে অর্থচিন্তা করিয়া থাকেন; অতএব তাদৃশ ব্যক্তিদিগকে অমাত্যপদে নিযুক্ত করিলে তোমার আয়ব্যয় ও শত্ৰুজয়াদিসমুদয় কাৰ্য্যেই মঙ্গললাভের বিলক্ষণ সম্ভাবনা। জ্ঞাতিদিগকে মৃত্যুর [যমের] ন্যায় ভীষণ বলিয়া বিবেচনা করা কর্ত্তব্য। উপরাজা [এক রাজার রাজ্যসীমাস্থ অপর রাজা] যেমন রাজার সম্পদ্‌দর্শনে কাতর হয়, তদ্রূপ জ্ঞাতিবর্গও জ্ঞাতির সম্পত্তিদর্শনে নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া থাকে। জ্ঞাতি ভিন্ন আর কেহই সরলস্বভাব, বদান্য, সত্যবাদী, লজ্জাশীল ব্যক্তিবিনাশে সন্তুষ্ট হয় না। জ্ঞাতি না থাকাও নিতান্ত অসুখের বিষয়। জ্ঞাতিবিহীন মনুষ্যের মত অবজ্ঞেয় [অনাদরণীয়] আর কেহই নাই। শত্রুগণ জ্ঞাতিহীন ব্যক্তিকে অনায়াসে পরাভব করিতে পারে। লোকে যখন অন্যান্য ব্যক্তিকর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হয়, তখন জ্ঞাতিই তাহার একমাত্র অবলম্বন হইয়া থাকে। অন্য ব্যক্তি জ্ঞাতির অপমান করিলে জ্ঞাতিরা কদাচ তাহা সহ্য করিতে পারে না। তাহারা সেই জ্ঞাতির অপমান আপনাদের অপমান বলিয়া বোধ করে। জ্ঞাতিগণে গুণ-দোষ উভয়ই লক্ষিত হয়, অতএব মানবগণ বাক্য ও কাৰ্য্যদ্বারা সতত জ্ঞাতিবর্গের সম্মান ও প্রিয়কার্য্যের অনুষ্ঠান করিবে। উহাদিগের অপ্রিয় চেষ্টা করা কদাপি কর্ত্তব্য নহে। উহাদিগের প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস না করিয়া উহাদের সহিত বিশ্বস্তের ন্যায় ব্যবহার করাই কৰ্ত্তব্য। যে ব্যক্তি সাবধান হইয়া এইরূপ ব্যবহার করিতে পারেন, তাঁহার শত্রুগণও মিত্রস্বরূপ হইয়া উঠে এবং তিনি চিরকাল বিপুল কীৰ্ত্তিলাভ করিতে সমর্থ হয়েন।”