০৯১. রাজার পুণ্যে প্রজাবৃদ্ধি–পাপে প্রজাক্ষয়

৯১তম অধ্যায়

রাজার পুণ্যে প্রজাবৃদ্ধি–পাপে প্রজাক্ষয়

“উতথ্য কহিলেন, ‘হে মান্ধাতঃ! জলধর যথাসময়ে সলিলবর্ষণ ও রাজা ধর্ম্মপরায়ণ হইয়া প্রজাপালন করিলে যে যে সম্পত্তি সমুদ্ভূত হয়, তাহাতেই পরমসুখে প্রজাবর্গের । জীবিকানির্ব্বাহ হইয়া থাকে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের মধ্যে যাঁহারা স্বধর্ম্ম পরিত্যাগ বা শূদ্রের ন্যায় ব্যবহার করেন, তাঁহারা বস্ত্রপরিষ্করণে অক্ষম রজকের ন্যায় নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। তাঁহাদের জীবিত থাকা আর না থাকা উভয়ই সমান। শূদ্রের দানবৃত্তি, বৈশ্যের কৃষিবাণিজ্য, রাজার দণ্ডনীতি অনুসারে কার্য্যানুষ্ঠান এবং ব্রাহ্মণের ব্রহ্মচর্য্য, তপানুষ্ঠান, মন্ত্রপাঠ ও সত্যপ্রতিপালনই মুখ্য ধৰ্ম্ম। যে ক্ষত্রিয় লোকের চরিত্রদোষ সংশোধন করিতে সমর্থ, তিনিই যথার্থ রাজা ও প্রজাবর্গের পিতাস্বরূপ। রাজাদিগের ব্যবহারনিবন্ধনই সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি এই চারি যুগের উৎপত্তি হইয়া থাকে। এই নিমিত্তই রাজা যুগস্বরূপ বলিয়া কীর্ত্তিত হয়েন। রাজা প্রমাদযুক্ত হইলেই তিন অগ্নি, বেদ, দক্ষিণান্বিত যজ্ঞ এবং চারি-আশ্রম ও চারিবর্ণের ধর্ম্ম বিলুপ্ত হইয়া যায়; আর তাঁহার পুত্র, কলত্র, বন্ধুবান্ধব প্রভৃতি সকলকেই অনুতাপ করিতে হয়। রাজা ধার্ম্মিক হইলে প্রজাদিগের ঈশ্বর [প্রভু-প্রতিপালক] এবং অধাৰ্ম্মিক হইলে প্রজানাশক বলিয়া বিখ্যাত হয়েন। রাজা পাপাচরণপরায়ণ হইলে হস্তী, অশ্ব, গো, উষ্ট্র, অশ্বতর ও গর্দ্দভসকল নিতান্ত অবসন্ন হইয়া পড়ে। দুৰ্ব্বলের নিমিত্তই নরপতির সৃষ্টি হইয়াছে। অতএব দুর্ব্বলদিগের প্রতিপালন করিলে রাজার সমধিক পুণ্যলাভ ও তাহাদিগের প্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হইলে যারপরনাই পাপ হইয়া থাকে। প্রজাগণ যাঁহার পরিবারস্বরূপ এবং তাহারা যাঁহার আশ্রয় গ্রহণ করিয়া নির্ভয়ে কালযাপন করে, তিনি ধর্ম্মচ্যুত হইলে সকলকেই পরিতাপিত হইতে হয়। দুর্ব্বল ব্যক্তিরা নিয়ত অপমানিত হইয়া থাকে। অতএব তুমি কদাচ দুর্ব্বলতা অবলম্বন করিও না। প্রতিনিয়ত দুর্ব্বলদিগের সাহায্য করাই তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। দুর্ব্বল ব্যক্তি, মুনি ও আশীবিষের কোপদৃষ্টি নিতান্ত অসহ্য। তুমি যেন দুর্ব্বলদিগের প্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হইয়া সবান্ধবে তাহাদের দৃষ্টিদহনে দগ্ধ হইও না।।

‘রাজা দুৰ্ব্বলদিগের সাহায্যদানে পরাত্মখ হইলে তাঁহার বংশ উহাদের কোপানলে সমূলে ভস্মসাৎ হইয়া যায়। অতএব বলবান ব্যক্তি অপেক্ষা দুর্ব্বল ব্যক্তিই প্রধান। রাজা যদি অবমানিত, আহত ও আর্তব্যক্তির পরিত্রাণের উপায় না করেন, তাহা হইলে তাঁহাকে দৈবদণ্ডে নিহত হইতে হয়। তুমি বলবানের পক্ষ হইয়া কদাপি দুর্ব্বল ব্যক্তির নিকট অর্থগ্রহণ করিও না। প্রজাগণ মিথ্যা অপবাদগ্রস্ত হইয়া অশ্রুপাত করিলে নিশ্চয়ই রাজার পুত্রবিয়োগ ও পশুনাশ হয়। অনেক স্থানে পাপকৰ্ম্ম করিলে অচিরাৎ তাহার ফলভোগ হয় না বটে, কিন্তু কোন না কোন সময়ে অবশ্যই উহার ফল সমুৎপন্ন হইয়া থাকে। পাপাত্মা পাপানুষ্ঠান করিয়া যদি স্বয়ং উহার ফলভোগ না করে, তাহা হইলে পুত্র, পৌত্র বা প্রপৌত্রকে উহা ভোগ করিতে হইবে, সন্দেহ নাই। জনপদবাসী যাবতীয় প্রজা একত্র হইয়া ব্রাহ্মণের ন্যায় ভিক্ষাৰ্থ পৰ্য্যটনে প্রবৃত্ত হইলে অচিরাৎ নরপতিকে কালকবলে নিপতিত হইতে হয়। বহুসংখ্যক রাজপুরুষ একত্র সমবেত হইয়া নীতিমার্গ অতিক্রম ও যুক্তিপরিত্যাগপূৰ্ব্বক কাম ও অর্থের বশীভূত হইয়া প্ৰজাগণের নিকট ধন গ্রহণ করিলে রাজার ঘোরতর পাপ ও ক্ষয় উপস্থিত হইয়া থাকে।

‘রাজার বিপদে রাজপুরুষদিগকে যারপরনাই বিপদগ্রস্ত হইতে হয়। বৃক্ষ সঞ্জাত হইয়া ক্ৰমশঃ পরবর্দ্ধিত হইলে জীবগণ উহাকে আশ্রয় করিয়া অবস্থান করে; কিন্তু ঐ বৃক্ষ ছিন্ন বা দগ্ধ হইলে একেবারে সকলেই নিরাশ্রয় হইয়া পড়ে। লোকে রাজ্যমধ্যে নরপতির গুণগাথা কীৰ্ত্তন ও সত্যধর্ম্মের অনুষ্ঠান করিলে রাজার ঐশ্বৰ্য্য পরিবর্দ্ধিত ও রাজ্য হইতে পাপ নিরাকৃত হয়। দুরাত্মারা রাজ্যমধ্যে জ্ঞানপূর্ব্বক সাধুদিগের প্রতি পাপাচরণে প্রবৃত্ত হইলে রাজাকেই তাহার পাপভাগী হইতে হয়। যে রাজা দুর্দ্দান্তদিগকে দমন এবং অমাত্যগণের সম্মাননাপূৰ্ব্বক মন্ত্রণা করিয়া তাহাদিগকে যুদ্ধে প্রেরণ করেন, তিনি অনায়াসে রাজ্যের উন্নতি লাভ করিয়া সুদীর্ঘ কাল নিরাপদে বসুন্ধরা ভোগ করিতে সমর্থ হয়েন। যিনি সুহৃদের সৎকৰ্ম্ম ও হিতবাক্যের প্রশংসা করেন, তাঁহার পরমধর্ম্মলাভ হইয়া থাকে।

উতথ্যের বিবিধ রাজকর্ত্তব্য উপদেশ

‘সকলকে অংশ প্রদান করিয়া ভোজন, অমাত্যগণের প্রতি সমুচিত সমাদরপ্রদর্শন ও বলমদে মত্ত ব্যক্তির বিনাশসাধন করা রাজার প্রধান ধৰ্ম্ম। তিনি কায়মনোবাক্যে প্রজাগণের রক্ষায় প্রবৃত্ত হইবেন, স্নেহাস্পদ পুত্রের প্রতিও ক্ষমাপ্রদর্শন করিবেন না এবং দস্যুদলদমন, সংগ্রামে জয়লাভ, সতত ভোজ্য প্রদানপূর্ব্বক দুর্বল ব্যক্তিদিগের বলবর্ধন ও প্রজাপ্রতিপালন করিবেন। যে ব্যক্তি পাপকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান বা পাপকাৰ্য্যের জল্পনা করে, সে অতিশয় প্রিয়পাত্র হইলেও তাহাকে কদাচ ক্ষমাপ্রদর্শন করিবেন না এবং প্রধান প্রধান বণিকদিগকে সূতনির্ব্বিশেষে রক্ষণাবেক্ষণ করা ও নিয়ম উল্লঙ্ঘন না করা রাজার নিতান্ত আবশ্যক। তিনি পরমশ্রদ্ধাসহকারে কাম ও লোকবিদ্বেষে অনাদর প্রদর্শনপূর্ব্বক ভূরিদক্ষিণ [প্রচুর দক্ষিণাযুক্ত] যজ্ঞের অনুষ্ঠান এবং দীন-দরিদ্র, অনাথ ও বৃদ্ধদিগের দুঃখাশ্রু মোচনপূৰ্ব্বক সুখবৃদ্ধি করিবেন। মিত্রসংখ্যাবর্দ্ধন ও শত্রুসংখ্যাহ্ৰাস করিতে সতত যত্নবান্ হওয়া এবং সাধুগণের পূজা, সত্যপালন, প্রীতিসহকারে ভূমিদান, অতিথিসৎকার ও ভৃত্যবর্গের সমুচিত সম্মান করা রাজার প্রধান ধর্ম্ম। যে রাজা লোকের প্রতি নিগ্রহ ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করিয়া থাকেন, তিনি ইহলোক ও পরলোকে তাহার ফলভোগ করেন। ধাৰ্ম্মিকগণের প্রতি অনুগ্রহ করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। রাজা জিতেন্দ্রিয় হইলে পরম ঐশ্বৰ্য্য লাভ করিতে পারেন এবং ইন্দ্রিয়ের বশবর্ত্তী হইলে নরকে নিপতিত হয়েন। ঋত্বিক, পুরোহিত ও আচার্য্যদিগকে সৎকার ও সমাদর করা ভূপতির অবশ্য কর্ত্তব্য। যম যেমন প্রাণীদিগের প্রতি যথোচিত দণ্ডবিধান করেন, তদ্রূপ রাজা প্রজাদিগকে নিয়মানুসারে দণ্ড প্রদান করিবেন। লোকে মহীপতিকে ত্রিদশাধিপতি ইন্দ্রের সদৃশ জ্ঞান করিয়া থাকে; অতএব তিনি যাহা ধৰ্ম্ম বলিয়া স্থির করিবেন, তাহাই প্রকৃত ধৰ্ম্ম। রাজা সতত সাবধানে বুদ্ধিবৃত্তিপরিচালন, ক্ষমাপ্রদর্শন, ধৈৰ্য্যাবলম্বন, প্রাণীগণের বলাবল পরীক্ষা ও সদসদ্‌বিবেচনা করিবেন। প্রাণীসংগ্রহ [প্রাণীগণের পালন], অর্থদান, মধুরবাক্যপ্রয়োগ এবং পুর ও জনপদবাসী প্রজাবর্গের রক্ষণাবেক্ষণ করা তাঁহার সর্ব্বতোভাবে শ্রেয়স্কর। অপটু রাজা প্রজারক্ষা করিতে কিছুতেই সমর্থ হয়েন না। দুৰ্ব্বহ রাজ্যভার বহন করা নিতান্ত সহজ নহে। যে রাজা প্রজ্ঞাবান ও মহাবলপরাক্রান্ত এবং যিনি দণ্ডনীতির বিলক্ষণ অনুশীলন করিয়াছেন, তিনিই কেবল রাজ্যভার বহন করিতে পারেন। আর যিনি নিতান্ত হীনবীৰ্য্য, অল্পবুদ্ধি ও দণ্ডনীতিবিষয়ে অনভিজ্ঞ, তিনি কিছুতেই তদ্বিষয়ে সমর্থ হয়েন না। রাজা ৎসকুলসম্ভূত, একান্ত অনুরক্ত, শাস্ত্রজ্ঞ, বৃদ্ধ অমাত্যগণসমভিব্যাহারে আশ্রমবাসী তপস্বিগণেরও কাৰ্য্য পরীক্ষা করিবেন।

‘এক্ষণে তুমি সর্ব্বসাধারণ ধর্ম্ম অবগত হইলে। তোমার ধর্ম্ম যেন কি স্বদেশ, কি বিদেশ কুত্রাপি বিলুপ্ত না হয়। শাস্ত্রে কথিত আছে, ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কাম এই তিনের মধ্যে ধর্ম্মই সমধিক উৎকৃষ্ট। ধর্ম্মপরায়ণ ব্যক্তি ইহলোকে পবিত্র সুখ অনুভব করিয়া থাকেন। মনুষ্যকে মধুরবাক্যে সমাদর করিলে সে পুত্ৰকলত্র ও প্রাণ পৰ্য্যন্ত পরিত্যাগ করিতেও অসম্মত হয় না; অতএব তুমি সকলকেই সমাদর করিবে। লোকসংগ্রহ, দান, মধুরবাক্যপ্রয়োগ, শৌচ ও সাবধানতা এই কয়টি বিষয়ে কদাচ অমনোযোগ করিও না। রাজা সতত শত্রুর রন্ধ্রান্বেষণপূর্ব্বক তাহাকে আক্রমণ করিবেন এবং এরূপ সাবধান হইয়া চলিবেন যে, যেন অন্য কোন ব্যক্তি তাঁহার ছিদ্রসন্দর্শনে সমর্থ না হয়। দেবরাজ ইন্দ্র, যম ও বরুণ ঐরূপ অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন এবং পূর্ব্বতন রাজর্ষিগণও ঐরূপ ব্যবহার করিতেন। এক্ষণে তুমি তাঁহাদিগের অনুকরণ কর। রাজা। ধর্ম্মপরায়ণ হইলে দেবর্ষি, গন্ধৰ্ব্ব ও পিতৃগণ ইহলোক ও পরলোকে তাঁহার গুণকীর্ত্তন করিয়া থাকেন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! মহারাজ মান্ধাতা মহর্ষি উতথ্য কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া অশঙ্কিতমনে তদনুসারে কার্য্যানুষ্ঠানপুৰ্ব্বক অচিরাৎ পৃথিবী আপনার আয়ত্ত করিয়া লইলেন। অতএব তুমি রাজা মান্ধাতার ন্যায় সাধ্যানুসারে পৃথিবী পালন কর, তাহা হইলে অনায়াসেই দেবলোকে স্থানলাভে সমর্থ হইবে।”