০৭৭. বেদহীন ব্রাহ্মণের ধনে রাজার অধিকার

৭৭তম অধ্যায়

বেদহীন ব্রাহ্মণের ধনে রাজার অধিকার

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! কোন কোন ব্যক্তির ধনে রাজার অধিকার আছে এবং ভূপতি কিরূপ বৃত্তি অবলম্বন করিয়া কালযাপন করিবেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! বেদপ্রমাণানুসারে ব্রাহ্মণ ভিন্ন জাতিদিগের এবং ব্রাহ্মণমধ্যে যাঁহারা বেদোক্ত ক্রিয়াকলা পবিবর্জ্জিত, তাঁহাদিগের অর্থে রাজার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। সাধুলোকেরা কহেন যে, ক্রিয়াবিহীন ব্রাহ্মণগণের ধনগ্রহণে ভূপতি কদাচ উপেক্ষা প্রদর্শন করিবেন না। রাজ্যমধ্যে ব্রাহ্মণ তস্করবৃত্তি অবলম্বন করিলে তদ্বিষয়ে রাজারই সম্পূর্ণ অপরাধ। বেদানুরক্ত ব্রাহ্মণকে প্রতিপালন না করিলে রাজাকে জনসমাজে নিন্দিত হইতে হয়। এই নিমিত্তই পূৰ্ব্বতন রাজর্ষিরা প্রযত্নসহকারে প্রতিনিয়ত ব্রাহ্মণগণকে প্রতিপালন করিতেন।

স্বধৰ্ম্মসেবীর রাক্ষসাদির ভয়নাশ

“পুৰ্ব্বে অরণ্যমধ্যে এক রাক্ষস স্বাধ্যায় সম্পন্ন কেকয়াধিপতিকে আক্রমণপূর্ব্বক হরণ করিতে প্রবৃত্ত হইলে তিনি যেরূপ কহিয়াছিলেন, তাহা শ্রবণ কর। কেকয়রাজ রাক্ষসকর্ত্তৃক আক্রান্ত, হইয়া তাহাকে কহিলেন, “নিশাচর! আমার রাজ্যমধ্যে চৌর্য্যের কিছুমাত্র প্রাদুর্ভাব নাই, কদর্য্য ও মদ্যপায়ী ব্যক্তিরা তথায় অবস্থান করিতে সমর্থ হয় না। ব্রাহ্মণমধ্যে কেহই মূর্খ, ব্রতবিহীন বা যাগযজ্ঞশূন্য নহেন, সকলেই যথাকালে অগ্নিসঞ্চয়, সোমপান, অভ্যাগত ব্যক্তিদিগকে স্ব স্ব ভোজ্যান্নের অংশ-প্রদান এবং যজন, যাজন, অধ্যয়ন, অধ্যাপন, দান ও প্রতিগ্ৰহ করিয়া থাকেন। উঁহারা সকলেই মৃদুস্বভাবসম্পন্ন, সত্যবাদী, ধৰ্ম্মপরায়ণ ও সকলের সম্মানভাজন। ক্ষত্রিয়েরা সকলেই স্বকৰ্ম্মনিরত, ব্রাহ্মণরক্ষক ও সমরে অপরাঙ্মুখ। তাঁহারা স্বেচ্ছানুসারে অর্থদান ও অধ্যয়ন ও যজ্ঞানুষ্ঠান করেন, কিন্তু কদাচ প্রতিগ্রহ, অধ্যাপন বা যাজনকার্য্যে প্রবৃত্ত হয়েন না। বৈশ্যেরা সকলেই শুচি, জিতেন্দ্রিয়, অপ্রমত্ত, ক্রিয়াবান, ব্রতপরায়ণ ও সত্যবাদী। তাহারা সকলেই পরস্পর সৌহার্দ্য অবলম্বনপূৰ্ব্বক কৃষি, গোরক্ষণ ও বাণিজ্যকাৰ্য্যদ্বারা জীবিকানির্ব্বাহ এবং অতিথিদিগকে স্ব স্ব ভোজ্যান্নের অংশ প্রদান করিয়া থাকে। শুদ্রেরা অসূয়াশূন্য হইয়া ব্রাহ্মণাদি বর্ণত্রয়ের আশ্রয়গ্রহণপূৰ্ব্বক জীবিকানির্ব্বাহ করে। আমি স্বয়ং যথানিয়মে কুলধৰ্ম্ম ও দেশধৰ্ম্ম রক্ষা এবং কৃপণ, অনাথ, বৃদ্ধ, দুৰ্ব্বল, আতুর ও স্ত্রীলোকদিগকে অর্থ দান করি। কদাপি ভোজ্যদ্রব্য বিভাগ না করিয়া ভোজন, পরস্ত্রীহরণ বা স্বেচ্ছানুসারে ক্রীড়া করি না। আমার জনপদমধ্যে তপস্বিগণ সৎকৃত ও সুপ্রণালীক্রমে প্রতিপালিত হইয়া অভ্যাগত ব্যক্তিদিগকে স্ব স্ব ভোজ্যান্নের অংশ প্রদান করিতেছেন। যিনি ব্রহ্মচারী নহেন, তিনি কদাচ ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেন না; যিনি ভিক্ষুক [সন্ন্যাসী], তিনি ব্রহ্মচর্য্যগ্রহণে প্রবৃত্ত হয়েন না এবং যিনি অযাজ্ঞিক [যজ্ঞানুষ্ঠানহীন], তিনি কোনক্রমে হুতাশনে আহুতি প্রদান করিতে পারেন না। রাজ্যস্থ সমস্ত লোকে নিদ্রিত হইলে আমি একাকী জাগরিত থাকি। বিদ্বান, বৃদ্ধ ও তপস্বিগণকে কখন অবজ্ঞা করি না এবং অর্থদানদ্বারা বিদ্যা, সত্যদ্বারা লোকসমুদয় ও শুশ্রূষাদ্বারা গুরুকে আয়ত্ত করিবার অভিলাষ করি। আমার পুরোহিত আত্মজ্ঞানসম্পন্ন, তপঃপরায়ণ, সৰ্ব্বধৰ্ম্মবেত্তা, বুদ্ধিমান ও সমুদয় রাষ্ট্রের নীতিপ্রণেতা। আমার রাজ্যে ব্রাহ্মণসকল সতত সুরক্ষিত হইতেছেন। তথায় বিধবা, অপকৃষ্ট ব্রাহ্মণ, ধূর্ত্ত ও অযাজ্যযাজী প্রভৃতি পাপাত্মার নামগন্ধও নাই। আমি ধর্ম্মানুসারে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া থাকি এবং আমার গাত্রে দুই অঙ্গুলিপ্রমাণ স্থানও অক্ষত লক্ষিত হয় না। আর আমার প্রজাবর্গ গো-ব্রাহ্মণরক্ষা ও যজ্ঞানুষ্ঠানের নিমিত্ত সতত আমার মঙ্গল প্রার্থনা করিয়া থাকে। সুতরাং রাক্ষস হইতে আমার অন্তঃকরণে কিছুমাত্র ভয় সঞ্চারিত হয় না। তুমি কি নিমিত্ত আমার শরীরমধ্যে প্রবেশ করিলে?

“তখন রাক্ষস কহিল, ‘মহারাজ! তুমি সকল অবস্থাতেই ধৰ্ম্মরক্ষার্থ যত্নবান হইয়াছ; অতএব আমি তোমাকে পরিত্যাগ করিয়া স্বস্থানে চলিলাম। তুমি স্বচ্ছন্দে আপনার আলয়ে গমন কর। সমস্ত মহীপাল গো, ব্রাহ্মণ ও প্রজাদিগকে সুনিয়মে রক্ষা করিয়া থাকেন, পাপাত্মাদিগের কথা দূরে থাকুক, রাক্ষসগণ হইতেও তাঁহাদিগের ভয় উপস্থিত হয় না। বিপ্রগণ যাঁহাদিগের পুরোবৰ্ত্তী[মন্ত্রণাৰ্থ সম্মুখে স্থাপিত], ব্রহ্মবলই যাঁহাদের প্রধান বল এবং যাঁহাদিগের প্রজারা অতিথিপ্রিয়, সেই সমস্ত মহীপাল অনায়াসে স্বর্গলাভ করিয়া থাকেন। রাক্ষস এই বলিয়া ভূপতিকে পরিত্যাগপুৰ্ব্বক প্রস্থান করিল। অতএব হে ধৰ্ম্মরাজ! স্বধৰ্ম্মস্থ ব্রাহ্মণের রক্ষাবিধান ও স্বকর্ম্মহীন ব্রাহ্মণের শাসনে যত্ন করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। বিপ্রগণ সুরক্ষিত হইলে সতত রাজাকে রক্ষা ও আশীর্ব্বাদ করিয়া থাকেন। যে রাজা নিয়মানুসারে গ্রাম ও নগরবাসীদিগকে রক্ষা করেন, তিনি ইহলোকে বিবিধ সুখ অনুভব ও চরমে ইন্দ্রের সালোক্য লাভ করিয়া থাকেন।”