০৭৩. ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়-সম্বন্ধ—ঐলকশ্যপ-সংবাদ

৭৩তম অধ্যায়

ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়-সম্বন্ধ—ঐলকশ্যপ-সংবাদ

ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! মহীপাল ধর্ম্মর্থ পৰ্য্যালোচনা করিয়া অতিসত্বর একজন বহুদর্শী পুরোহিতকে নিযুক্ত করিবেন। রাজপুরোহিত ধৰ্ম্ম ও মন্ত্রনিপুণ এবং রাজা ধার্ম্মিক ও মন্ত্রবেত্তা হইলে প্রজাগণের সর্ব্বতোভাবে মঙ্গললাভ হয়। রাজা ও পুরোহিত উভয়েই দেবতা ও পিতৃগণকে পরিতৃপ্ত এবং প্রজাসমুদয়কে পরিবর্দ্ধিত করিয়া থাকেন। উঁহারা পরস্পর পরস্পরের অভিন্নহৃদয় সুহৃদ হইয়া জন্মগ্রহণ করেন। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় উভয়ের সদ্ভাব থাকিলে প্রজারা সুখী হয় এবং ঐ উভয়ের পরস্পর অসদ্ভাব হইলে তাহারা বিনষ্ট হইয়া যায়। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় অন্যান্য বর্ণের মূলস্বরূপ। এই স্থলে ঐলকশ্যপ-সংবাদ নামক প্রাচীন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

“একদা ঐলতনয় মহারাজ পুরূরবা কশ্যপকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ভগবন্! যদি ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় পরস্পর পরস্পরকে পরিত্যাগ করেন, তাহা হইলে উহাদের মধ্যে কোন্ পক্ষকে প্রধান বলিয়া গণ্য করা যায় এবং প্রজারাই বা কোন পক্ষ অবলম্বনপূৰ্ব্বক কালযাপন করিয়া থাকে’ কশ্যপ কহিলেন, ‘ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়কে পরিত্যাগ করিলে ক্ষত্রিয়ের রাজ্য উচ্ছিন্ন হইয়া যায় এবং ম্লেচ্ছজাতিয়েরা যাহাকে ইচ্ছা হয়, তাহাকেই রাজা অঙ্গীকার করে। যেসমস্ত ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণগণকে পরিত্যাগ করে, তাহাদিগের বেদজ্ঞানলাভ, পুত্রোৎপত্তি, দধিমন্থন ও যাগযজ্ঞাদির অনুষ্ঠান বিলুপ্ত হইয়া যায়; আর সেই ব্রাহ্মণত্যাগী ক্ষত্রিয়েরও পুত্রপৌত্রেরা বেদাধ্যয়নবিমুখ হইয়া উঠে ও তাহার গৃহে অর্থ কদাচ পরিবর্দ্ধিত হয় না এবং তাহার বংশীয় লোকেরা সঙ্করসমুৎপন্ন ও দাস্যভাবাপন্ন হয়। অতএব ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের পরস্পর পরস্পরকে রক্ষা করা কর্ত্তব্য। উহারা পরস্পর পরস্পরের প্রাদুর্ভাবের হেতুভূত। যদি উহারা সদ্ভাবসম্পন্ন হয়, তাহা হইলে উহাদের গৌরব পরিবর্দ্ধিত হয়, আর যদি উহাদিগের সদ্ভাব না থাকে, তাহা হইলে সকলেই মোহে একান্ত অভিভূত হইয়া পড়ে। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের পরস্পর বিরোধ উপস্থিত হইলে অগাধ সাগরে নিপতিত নৌকার ন্যায় কেহই আর এই সংসার সাগর পার হইতে সমর্থ হয় না; প্রজাবর্গ এককালে উচ্ছিন্ন হইয়া যায়। ব্রাহ্মণরূপ বৃক্ষ সুরক্ষিত হইলে সুখ ও সুবর্ণ বর্ষণ করে, অরক্ষিত হইলে নিরন্তর পাপাশ্রু নিক্ষেপ করিতে থাকে। যে প্রদেশে ব্রাহ্মণ দস্যু প্রভৃতির প্রভাবে বেদবিবর্জ্জিত হইয়া বেদদ্বারা পরিত্রাণ-বাসনা করেন, তথায় কিছুমাত্র বৃষ্টিপাত হয় না এবং নিরন্তর মৃত্যুভয় ও দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হইয়া থাকে। যেসময় পাপাত্মারা স্ত্রীহত্যা ও ব্রহ্মহত্যা করিয়া জনসমাজে সাধুবাদ লাভ করে এবং নরপতিগোচরে[রাজা হইতে] কিছুমাত্র শঙ্কিত হয় না, সেই সময় রাজার মহাভয় উপস্থিত হয়। দুরাত্মাদিগের পাপানুষ্ঠাননিবন্ধন রুদ্রদেব [ভগবানের প্রলয়মূর্ত্তি] সম্ভূত হইয়া এককালে সৎ ও অসৎ সকলকেই নিপাতিত করেন।

“পুরূরবা কহিলেন, ‘ভগবন্! জীবগণকে জীবের বধ সাধন করিতে দেখা যায়। রুদ্রদেব ত’ কাহারও নেত্রগোচর হয়েন না। উনি কে, কিরূপ আকারসম্পন্ন এবং কোথা হইতেই বা জন্মপরিগ্রহ করেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।’

“কশ্যপ কহিলেন, ‘যে মহাত্মা মানবের হৃদয়ে অবস্থানপূৰ্ব্বক আপনার ও অন্যের দেহ ধ্বংস করেন, সেই আত্মাই রুদ্রদেব। উঁহার আকার উৎপাতবায়ু [বাত্যা বৃক্ষাদির উৎপাটনকারী] ও মেঘের ন্যায়।’

“পুরূরবা কহিলেন, ‘ভগবন্! বায়ু চতুর্দ্দিকে আক্রমণ ও মেঘ বারিবর্ষণ করিয়া ত’ প্রায়ই মনুষ্যের প্রাণসংহার করে না। মনুষ্যগণকে কামদ্বেষের বশীভূত হইয়াই প্রাণপরিত্যাগ করিতে দেখা যায়।’

“কশ্যপ কহিলেন, ‘মহারাজ! হুতাশন যেমন এক গৃহে লগ্ন হইয়া সমুদয় গ্রাম ও চত্বর ভস্মসাৎ করিয়া ফেলেন, তদ্রূপ রুদ্রদেব পাপাত্মার পাপপ্রভাবে উৎপন্ন হইয়া এককালে সকলকে বিমোহিত ও কামদ্বেষের বশীভূত করেন।’

“পুরূরবা কহিলেন, ‘ভগবন্! দুরাত্মাদিগের পাপাচরণনিবন্ধন যদি পুণ্যাত্মা ও পাপাত্মা সকলেই দণ্ডনীয় হয়, তাহা হইলে কি নিমিত্ত লোকে দুষ্কর্ম্মের পরিহার ও সৎকার্য্যের অনুষ্ঠান করিবে?’

“কশ্যপ কহিলেন, ‘যেমন শুষ্ক বস্তুর সংস্রবে আর্জ্য পদার্থও ভস্মসাৎ হইয়া যায়, তদ্রূপ পাপপরিশূন্য মানবগণ পাপাত্মাদিগের সংস্রবনিবন্ধন তাহাদের সমান দণ্ডভাগী হইয়া থাকে, অতএব পাপাত্মার সহিত সংস্রব রাখাও কদাপি বিধেয় নহে।’

“পুরূরবা কহিলেন, ‘ভগবন্! বসুন্ধরা সকলকেই ধারণ, সূৰ্য্য সকলকেই তাপপ্রদান, সলিল সকলেরই পবিত্রতাসাধন এবং সমীরণ সর্ব্বত্ৰই সঞ্চরণ করিতেছেন। ইঁহাদিগের নিকট সাধু ও ও অসাধুর কিছুমাত্র ইতরবিশেষ নাই।’

“কশ্যপ কহিলেন, ‘নৃপনন্দন! ইহলোকে ঐরূপই হইয়া থাকে; কিন্তু যাহারা পুণ্যানুষ্ঠান করে ও যাহারা পাপাচরণে প্রবৃত্ত হয়, পরলোকেই তাহাদিগের ইতরবিশেষ লক্ষিত হইয়া থাকে। পুণ্যলোকসমুদয় সুখের আকর ও অমৃতের নাভি[মূল–উৎপত্তিস্থান]স্বরূপ, উহার জ্যোতিঃ হিরণ্যবর্ণ, তথায় জরা, মৃত্যু বা দুঃখের কিছুমাত্র প্রাদুর্ভাব নাই। ব্রহ্মচারিগণ ঐ লোকে গমনপূৰ্ব্বক অসীম আনন্দ লাভ করিয়া থাকেন। পাপলোক নরকের আবাস, উহা নিরন্তর গাঢ়তর তিমিরে সমাচ্ছন্ন রহিয়াছে। শোক ও দুঃখ তথায় নিরন্তর সঞ্চরণ করিতেছে। পাপাত্মারা ঐ লোকে বহুকাল নিতান্ত সন্তপ্ত হইয়া শোক প্রকাশ করিয়া থাকে।

“ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের অসদ্ভাব উপস্থিত হইলে প্রজারা দুর্ব্বিষহ দুঃখ ভোগ করে। মহীপাল এই বিষয় সবিশেষ পৰ্য্যালোচনা করিয়া বহুদর্শী পুরোহিতকে কার্য্যে নিযুক্ত করিবেন। অর্থে পুরোহিতবরণ করিয়া পশ্চাৎ স্বয়ং রাজ্যে অভিষিক্ত হওয়া ভূপতির উচিত। ধর্ম্মানুসারে ব্রাহ্মণ সকলের শ্রেষ্ঠ। ব্রহ্মবিৎ পণ্ডিতেরা কহিয়া থাকেন, সর্ব্বাগ্রে ব্রাহ্মণের সৃষ্টি হইয়াছে; অতএব ব্রাহ্মণ সৰ্ব্ববর্ণের জ্যেষ্ঠ, সম্মানভাজন ও পূজনীয়। বলবান নরপতিও সমুদয় উৎকৃষ্ট বস্তু ধৰ্ম্মানুসারে ব্রাহ্মণকে সমর্পণ করিবেন। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় পরস্পর পরস্পরের উন্নতির কারণ।”