০৭৫. প্রজার পাপ-পুণ্যে রাজার পাপপুণ্য

৭৫তম অধ্যায়

প্রজার পাপ-পুণ্যে রাজার পাপপুণ্য

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! নরপতি কিরূপ বৃত্তি অবলম্বন করিলে মানবগণের উন্নতিসাধন এবং পুণ্যলোকসমুদয় পরাজয় করিতে পারেন?”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! রাজা নিয়ত দানশীল, যজ্ঞশীল, উপবাসনিরত ও তপানুষ্ঠানপরায়ণ হইয়া ধৰ্ম্মানুসারে প্রজাবর্গের প্রতিপালন এবং পাত্রোত্থান[কালোচিত উদ্যম-প্রকাশ] ও ধনপ্রদানদ্বারা ধার্ম্মিকদিগের সম্মান রক্ষা করিবেন। রাজা ধৰ্ম্মের গৌরব করিলে সৰ্ব্বত্রই ধৰ্ম্মের গৌরবরক্ষা হয়। নরপতি যেরূপ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করেন, প্রজাদিগের তাহাতেই অভিরুচি হইয়া থাকে। অন্তকের ন্যায় নিরন্তর অরাতিগণের প্রতি দণ্ড সমুদ্যত ও দস্যুগণকে সমূলে উন্মুলিত করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। অনুরাগনিবন্ধন কাহাকেও ক্ষমা করা বিধেয় নহে। প্রজাগণ সুন্দররূপে প্রতিপালিত হইয়া বেদাধ্যয়ন, অর্থদান, হোম ও দেবার্চ্চনা প্রভৃতি যা কিছু ধর্ম্মকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করে, রাজা তাহার চতুর্থাংশের অধিকারী হয়েন। আর প্রজারা উত্তমরূপে প্রতিপালিত না হওয়াতে রাজ্যমধ্যে যেসকল পাপসঞ্চয় হইতে থাকে, নরপতিকে তাহারও চতুর্থাংশ গ্রহণ করিতে হয়। রাজা নৃশংস ও মিথ্যাবাদী হইয়া যে কাৰ্য্যের অনুষ্ঠানপূর্ব্বক যে পাপ উৎপাদন করেন, কাহার কাহার মতে তাঁহাকে সেই পাপের অর্ধেক ও কাহার কাহার মতে তৎসমুদয়ই ভোগ করিতে হয়।

“এক্ষণে নরপতি যাহাতে ঐ সকল পাপ হইতে বিমুক্ত হইতে পারেন, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। তস্করেরা কোন প্রজার, ধন অপহরণ করিলে রাজা যদি তাহা প্রত্যাহরণ করিতে অসমর্থ হয়েন, তাহা হইলে স্বীয় ধনাগার হইতে বা বণিকদিগের নিকট হইতে অর্থ গ্রহণ করিয়া ক্ষতিগ্রস্ত প্রজার ক্ষতিপূরণ করিয়া দিবেন। সৰ্ব্বদা ব্রাহ্মণের ন্যায় ব্রহ্মস্ব রক্ষা করা সকল বর্ণেরই অবশ্য কর্ত্তব্য। যে ব্রাহ্মণের অপকার করে, তাহাকে রাজ্য হইতে নিৰ্ব্বাসিত করাই উচিত। ব্রহ্মস্ব রক্ষা করিলে সমস্ত বিষয়ই রক্ষিত হয়। অতএব ব্রাহ্মণদিগকে প্রসন্ন করাই রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। জীবগণ যেমন মেঘমণ্ডল ও পক্ষীসমুদয় যেমন উন্নত বনস্পতির আশ্রয়গ্রহণ করিয়া জীবিত থাকে, তদ্রূপ মানবগণ সর্ব্বার্থসাধক নরপতিকে আশ্রয় করিয়া কালযাপন করে। কামাত্মা, নৃশংস ও ধনলুব্ধ নরপতি কখনই প্রজাপালনে সমর্থ হয়েন না।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আমি সুখলাভার্থ ক্ষণকালও রাজ্যভোগ করিতে বাসনা করি না। আপনি পূর্বে আমাকে কহিয়াছিলেন, ধর্ম্মলাভার্থে রাজ্যগ্রহণ করা কর্ত্তব্য; কিন্তু আমি এক্ষণে বিশেষ পর্য্যালোচনা করিয়া দেখিলাম যে, রাজ্যপালনদ্বারা অধিক ধৰ্ম্ম লাভ করা অতি সুকঠিন। উহাতে সমধিক পাপ জন্মিবারই বিলক্ষণ সম্ভাবনা। অতএব অতঃপর আমি পরমপবিত্র অরণ্যমধ্যে গমনপূৰ্ব্বক জিতেন্দ্রিয় ফলমূলাহারী তপস্বী হইয়া। ধৰ্ম্মের আরাধনা করিব।”

প্রজারক্ষায় রাজার ধৰ্ম্মরক্ষা

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! তোমার বুদ্ধি যে নিতান্ত নৃশংসতাশূন্য, তাহা আমি সবিশেষ অবগত আছি; কিন্তু কেবল অনৃশংসতা অবলম্বন করিলে রাজ্যরক্ষা করা যায় না। তুমি নিতান্ত ধর্ম্মপরায়ণ, মৃদু, কৃপালু ও উৎসাহশূন্য বলিয়া লোকে তোমার গৌরব করে না। যাহা হউক, এক্ষণে তুমি তোমার পিতৃপিতামহাচরিত ব্যবহার পর্য্যালোচনা করিয়া দেখ। তুমি যেরূপে কালযাপন করিতে বাসনা করিতেছ, ভূপালগণের সেরূপ করা বিধেয় নহে। তুমি কদাপি মৃদুত্ব অবলম্বনপূর্ব্বক নিষ্ঠুরতায় এককালে পরাঙ্মুখ হইও না। প্রজাপালন করিলেই তোমার অনায়াসে ধৰ্ম্মফললাভ হইবে। তুমি স্বীয় প্রজ্ঞা ও ধীশক্তিপ্রভাবে যেরূপ আচারপরায়ণ হইবার ইচ্ছা করিতেছ, পাণ্ডুরাজ ও কুন্তীদেবী তুমি ওরূপ হইবে বলিয়া আকাঙক্ষা করেন নাই।

তাঁহারা সৰ্ব্বদাই তোমার শৌর্য্য, বল, সত্য, মাহাত্ম্য ও ঔদার্য্য প্রার্থনা করিতেন। দেবলোক ও পিতৃলোক মনুষ্যের নিকট নিরন্তর যজ্ঞ ও শ্রাদ্ধ-তর্পণাদির প্রত্যাশা করিয়া থাকেন। দান, অধ্যয়ন, যজ্ঞ ও প্রজাপ্রতিপালন ধৰ্ম্মই হউক আর অধৰ্ম্মই হউক, তুমি এই সকলের অনুষ্ঠান করিতেই জন্মগ্রহণ করিয়াছ। যাহারা যথাকালে উপযুক্ত ভারবহনে নিযুক্ত থাকে, তাহারা বিনষ্ট হইলেও তাহাদিগের কীৰ্ত্তি বিনষ্ট হয় না। মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক, অশ্বও সম্যকরূপে শিক্ষিত হইলে অনায়াসে ভার বহন করিতে পারে। কি গৃহী, কি রাজা, কি ব্রহ্মচারী কেহই নির্দোষে ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিতে সমর্থ নহেন; অতএব যাহাতে পুণ্যের অংশ অধিক ও পাপের ভাগ অল্প, সেইরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করা দোষাবহ নহে। এককালে পুণ্যকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান পরিত্যাগ অপেক্ষা অল্পপরিমাণেও উহা করা শ্রেয়স্কর। কৰ্ম্মবিহীন ব্যক্তি অপেক্ষা পাপী আর কেহই নাই। সৎকুলসম্ভূত ধার্ম্মিক ব্যক্তি উৎকৃষ্ট ঐশ্বর্য্যের অধীশ্বর হইলে রাজার রাজ্যবৃদ্ধি ও রক্ষাবিষয়ে বিশেষ আনুকুল্য করিয়া থাকেন। ধর্ম্মপরায়ণ নরপতি রাজ্য অধিকার করিয়া দান, বলপ্রকাশ ও মিষ্টবাক্য প্রয়োগদ্বারা প্রজাগণকে বশীভূত করিবেন। সৎকুলসম্ভূত বিদ্বান ব্যক্তিরা বৃত্তিলোপভয়ে কাতর হইয়া যাঁহার আশ্রয়গ্রহণপূর্ব্বক নিশ্চিন্ত ও পরিতুষ্ট হয়েন, তাহা অপেক্ষা ধার্ম্মিক আর কেহই নাই।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! যদি আপনি বিশেষ জ্ঞাত থাকেন, তাহা হইলে লোকে কোন কাৰ্য্যদ্বারা স্বর্গ, উৎকৃষ্ট প্রীতি ও পরম ঐশ্বৰ্য্যলাভ করিতে পারে, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! ভয়ার্ত্ত ব্যক্তি যাহার আশ্রয় গ্রহণপূর্ব্বক ক্ষণকালও সুখলাভ করে, আমার মতে সেই ব্যক্তি স্বর্গলাভে সম্যক অধিকারী হয়; অতএব তুমি আহ্লাদিতচিত্তে কৌরবকুলের অধীশ্বর হইয়া সাধুগণের রক্ষা ও অসাধুদিগকে পরাজিত করিয়া স্বর্গলাভের অধিকারী হও। জীবগণ যেমন জলধরের এবং পক্ষিগণ যেমন বৃহৎ পাদপের আশ্রয়গ্রহণ করিয়া জীবিত থাকে, তদ্রূপ সুহৃদগণ সাধুদিগের সহিত একত্র হইয়া তোমাকে আশ্রয় করিয়া কালাতিপাত করুন। যে ব্যক্তি প্রগল্‌ভ, শর ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া অসভ্যের প্রতি দণ্ডবিধান ও সাধুলোকদিগকে অর্থ প্রদান করেন, মানবগণ তাহাকেই আশ্রয় করিয়া থাকে।”