০৮৯. ভোগর তিরস্কার ও ত্যাগীর পুরস্কার

৮৯তম অধ্যায়

ভোগর তিরস্কার ও ত্যাগীর পুরস্কার

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! পণ্ডিতেরা বৃক্ষের ফলকে ব্রাহ্মণগণের ধর্ম্মমূল বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন; অতএব ফলবান্ বৃক্ষ ছেদন করা কোনমতেই কৰ্ত্তব্য নহে। ব্রাহ্মণগণকে প্রতিপালন করিয়া যে ধন উদ্বৃত্ত হইবে, তদ্বারা অন্য লোককে প্রতিপালন করা রাজার আবশ্যক। ব্রাহ্মণ যদি ধনহীন হইয়া আত্মরক্ষাৰ্থ রাজ্য পরিত্যাগ করিতে ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে নরপতি তাঁহার ও তাঁহার পত্নীর নিমিত্ত বৃত্তিবিধান করিয়া দিবেন। ব্রাহ্মণ তাহাতেও নিবৃত্ত না হইলে রাজা ব্রাহ্মণসমাজে গমনপূৰ্ব্বক তাঁহাকে কহিবেন, মহাশয়! আপনি এস্থান হইতে গমন করিলে আমার রাজ্যস্থ ব্যক্তিগণ আর কাহাকে আশ্রয় করিয়া জীবনধারণ করিবে? এক্ষণে আপনি আমার প্রতি ক্ষমাপ্রদর্শন করুন। ব্রাহ্মণ ভোগার্থী হইয়া রাজ্য পরিত্যাগ করিলে নরপতি তাঁহাকে ভোগ্যবস্তু প্রদান করা কর্ত্তব্য বলিয়া স্বীকার করেন, কিন্তু আমার এ বিষয়ে মত নাই। কৃষিবাণিজ্য ও গোরক্ষণাদিদ্বারা লোকদিগের জীবিকানির্ব্বাহ হইয়া থাকে, কিন্তু বেদত্রয় মানবগণকে নিৰ্ব্বিকার জগদীশ্বরের উপাসনায় অনুরক্ত করে; অতএব যাহারা বৈদিক কার্য্যের ব্যাঘাত করে, তাহারা দস্যু। ভগবান্ ব্রহ্মা সেই দস্যুগণের বিনাশার্থ ক্ষত্রিয়ের সৃষ্টি করিয়াছেন। এক্ষণে শত্রুক্ষয়, প্রজাপালন, যজ্ঞানুষ্ঠান ও সমরে বিপুল বিক্ৰম প্ৰকাশপূৰ্ব্বক ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্ম রক্ষা করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। যাঁহারা পরমযত্নসহকারে প্রজাপালন করেন, তাঁহারাই ভূপতিগণের অগ্রগণ্য; আর যাঁহারা প্রজাপালনে পরাঙ্মুখ হয়েন, তাঁহাদের জীবিত থাকিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। লোকের কার্য্যাকাৰ্য্য সবিশেষ অবগত হওয়া ভূপতির নিতান্ত আবশ্যক। অতএব তিনি সতত জনসমাজে চর প্রয়োগ করিবেন। আত্মীয়গণকে আত্মীয় হইতে ও অন্যান্য ব্যক্তিদিগকে অন্যান্য ব্যক্তি হইতে রক্ষা করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। আত্মরক্ষায় বিশেষরূপে অনুরক্ত থাকিয়া পৃথিবী শাসন করা উচিত। পণ্ডিতেরা আত্মাকেই সমুদয় সুখের মূল বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। সৰ্ব্বদা আপনার ছিদ্র, ব্যসন, পতন ও অপরাধের বিষয় চিন্তা করা নরপতির অবশ্য কর্ত্তব্য। মানবগণ গতবাসরীয় [পূৰ্ব্বদিবসের অতীত কালের] কার্য্যের প্রশংসা করে কি না, ইহা জানিবার নিমিত্ত নরপতি রাজ্যমধ্যে সতত চর প্রয়োগ করিবেন। যাহারা সংগ্রামে পরাঙ্মুখ, ধৰ্ম্মজ্ঞ, ধৃতিমান্ [ধীর—ধৈৰ্য্যশীল] নরপতি রাজ্যে বাস না করে; যাহারা রাজা, অমাত্য বা অন্য কাহাকেও আশ্রয় করিয়া জীবনযাপন করে এবং যাহারা তোমার সুখ্যাতি বা নিন্দা করে, তাহাদিগের মধ্যে কাহাকেও অনাদর করা কর্ত্তব্য নহে। কোন ব্যক্তিই সকলের প্রশংসাভাজন হয় না। সকলেরই শত্ৰু, মিত্র ও উদাসীন [উপেক্ষাকারী—মধ্যস্থ] আছে।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! রাজা ও প্রজা উভয়েই তুল্যবল ও তুল্যগুণসম্পন্ন, সুতরাং তন্মধ্যে এক ব্যক্তির কিরূপে প্রাধান্যলাভের সম্ভাবনা থাকিতে পারে?”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! রাজা প্রজাগণের তুল্যবল হইয়াও কৌশলক্রমে তাহাদিগের হস্ত হইতে সতত আত্মরক্ষা ও তাহাদিগের অপেক্ষা প্রাধান্য লাভ করেন। মহাবিষ আশীবিষ যেমন অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র সর্পকে, অস্থাবর স্থাবরকে ও বিশালদশনসম্পন্ন জন্তু যেমন দন্তহীন জন্তুকে ভক্ষণ করে, তদ্রূপ বলবান্ ব্যক্তি সতত দুর্ব্বলকে আক্রমণ করিয়া থাকে। অতএব প্রবল শত্রু হইতে সতত আত্মরক্ষা করা রাজার কর্ত্তব্য। শত্রু রন্ধ্র প্রাপ্ত হইলে গৃধ্রের ন্যায় রাজ্যমধ্যে নিপতিত হইয়া থাকে। বণিকেরা যেন রাজকরে নিপীড়িত না হইয়া অল্পমূল্যে বহু বস্তু ক্রয় করিতে সমর্থ হয়; কৃষকেরা যেন পীড়িত হইয়া রাজ্য পরিত্যাগ না করে। যাহারা রাজার কাৰ্য্যভার বহন করিয়া থাকে, তাহারা, যেন প্রজাবর্গের দুঃখনিরাকরণে সম্যক্ প্রবৃত্ত হয়, তাহাদিগের হইতে [দ্বারা] যেন প্রজারা অকারণ কষ্ট স্বীকার [স্বীকারে বাধ্য না হয়] না করে। রাজা ইহলোকে যেসমস্ত বস্তু দান করিয়া থাকেন, তদ্দারা দেবতা, পিতৃগণ, মনুষ্য, উরগ, রাক্ষস ও পশুপক্ষিগণ সকলেরই তৃপ্তিলাভ হয়। বৎস! আমি রাজবৃত্তি ও রাজ্যপালনের নিয়মসমুদয় কীৰ্ত্তন করিলাম, এক্ষণে পুনৰ্ব্বার এই বিষয় বিশেষরূপে কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।”