০৮৮. ধনাগমের সুগম পথ

৮৮তম অধ্যায়

ধনাগমের সুগম পথ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! যখন নরপতি প্রচুর শক্তিশালী হইয়াও সমধিক ধনলাভের প্রত্যাশা করিবেন, তখন তাঁহার কিরূপ ব্যবহার করা বিধেয়, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! ধর্ম্মার্থী নরপতি সতত প্রজার হিতসাধনে তৎপর হইয়া দেশ, কাল, বুদ্ধি ও বীর্য্য অনুসারে প্রজাবর্গের প্রতিপালন এবং তাহাদের ও আপনার মঙ্গলজনক কাৰ্য্যানুষ্ঠান করিবেন। ভ্রমর যেমন বৃক্ষে আঘাত না করিয়া তাহা হইতে মধু সংগ্রহ করে, লোকে যেমন গাভীর স্তনচ্ছেদন ও বসকে নিতান্ত কষ্ট প্রদান না করিয়া দুগ্ধ দোহন করে, জলৌকা [জোঁক] যেমন লোকের গাত্র হইতে শনৈঃ শনৈঃ রুধির পান করে, ব্যাঘ্র যেমন শাবকগণকে নিপীড়িত না করিয়া দশনদ্বারা গ্রহণ করে এবং মূষিক যেমন অলক্ষিতভাবে নিদ্রিত ব্যক্তির পদতলস্থ মাংস ভক্ষণ করে, তদ্রূপ ধনাকাঙ্ক্ষী নরপতি প্রজাগণকে সমূলে উম্মলিত বা নিতান্ত নিপীড়িত না করিয়া অলক্ষিতভাবে তাহাদের নিকট হইতে কর গ্রহণ করিবেন। অভ্যুদয়োন্মুখ ব্যক্তির নিকট হইতে ক্রমে ক্রমে সমধিক কর গ্রহণ করা কর্ত্তব্য। গোপাল যেমন বৎসগণের উপর ক্রমে ক্রমে গুরুতর ভার নিহিত ও তাহাদিগকে পাশবদ্ধ করে, তদ্রূপ রাজা প্রজাগণের নিকট হইতে ক্রমে ক্রমে অধিক কর গ্রহণ করিবেন। এককালে লোকের নিকট হইতে অধিক কর গ্রহণ করিলে তাহাকে যারপরনাই নিপীড়িত ও বিরক্ত করা হয়। সকলের প্রতি সমান ব্যবহার করা নিতান্ত সুকঠিন; অতএব প্রধান প্রধান ব্যক্তিদিগকে সান্ত্বনা করিয়া তাঁহাদের দ্বারা ইতরলোকদিগকে দমন করা উচিত। এইরূপ ব্যবহার করিলে অনায়াসে সুখলাভ হয়। অকালে বা অযোগ্য কার্য্যনির্ব্বার্থ প্রজাদিগের নিকট কর গ্রহণ করা বিধেয় নহে।

দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন

“হে ধৰ্ম্মজ্ঞ! আমি তোমার নিকট এক্ষণে যাহা যাহা কীৰ্ত্তন করিলাম, তৎসমুদয় রাজ্যপালনের উপায়; মায়া নহে। উপায় অবলম্বন না করিয়া শাসন করিলে প্রজাগণ অশ্বের ন্যায় ক্রুদ্ধ হইয়া থাকে। মদ্যবিক্রয়ী, বারবনিতা [বেশ্যা], কুট্টিনী [দূতী—যে কুৎসিত কার্য্যের দূতীগিরি করে], বিট [লম্পট—কামুক] ও দ্যূতব্যবসায়ী [জুয়াখেলোয়াড়] প্রভৃতি রাজ্যের অনিষ্টসাধকগণকে সতত শাসন করা কর্ত্তব্য। রাজ্যমধ্যে উহাদের প্রাদুর্ভাব হইলে ভদ্রলোকদিগের অশেষ অনিষ্ট হইয়া থাকে। মনু পূর্বেই এই নিয়ম নির্দিষ্ট করিয়াছিলেন যে, যেকোন বিপদ উপস্থিত হউক না কেন, লোকে কদাচ অন্যকে শাসন করিবে না। যদি সকলেই ঐ নিয়মের অনুসরণ করিত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই এত দিন এই সংসার বিলুপ্ত হইয়া যাইত। শ্রুতি অনুসারে প্রজাদিগের শাসনে নরপতির সম্পূর্ণ অধিকার আছে। যে রাজা প্রজাশাসনে পরাঙ্মুখ হয়েন, তাঁহাকে প্রজাদিগের পাপের চতুর্থাংশ ভোগ করিতে হয়। পাপাত্মাদিগের প্রতি সতত দণ্ডবিধান করা ভূপতির অবশ্য কর্ত্তব্য। যিনি তাহা না করেন, তাঁহাকে নিতান্ত পাপাত্মা বলিয়া গণনা করা যায়। মদ্যাদিতে আসক্ত হইলে ঐশ্বৰ্য্যহানি হইয়া থাকে। কামাত্মাদিগকে প্রশ্রয় প্রদান করা নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। উহাদিগের কোন কাৰ্য্যই অকাৰ্য্য বলিয়া বোধ থাকে না। উহারা কেবল স্বয়ং মদ্যমাংসভক্ষণ, পদারাভিমৰ্ষণ [পরনারীধর্ষণ] ও পরধন হরণ করিয়া ক্ষান্ত থাকে না, অন্যকেও তদ্বিষয়ে প্রবর্ত্তিত করে। যাহারা কদাচ পরিগ্রহ করে না, তাহারা বিপদগ্রস্ত হইয়া প্রার্থনা করিলে তাহাদিগকে দয়া করিয়া দান করা অবশ্য কর্ত্তব্য। তোমার রাজ্যে যেন দস্যু ও কপট যাচকের প্রসঙ্গও না থাকে। দস্যুরাই প্রজাদিগের সর্ব্বনাশ করিয়া কপট যাচকদিগকে ধনদান করে। যাহারা প্রজাবর্গের উপকারক ও উন্নতিসাধক, তাহাদিগকেই রাজ্যমধ্যে স্থান দান করা আবশ্যক। প্রজাপীড়কদিগকে রাজ্যমধ্যে রাখা নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। ধনগ্রহণতৎপর অসাধু ব্যক্তিদিগের দণ্ডবিধান করা উচিত। কৃষি, বাণিজ্য ও গোরক্ষা প্রভৃতি কাৰ্য্যসমুদয় একের সাধ্যায়ত্ত নহে; অতএব অনেক ব্যক্তিদ্বারা ঐ সকল কাৰ্য্য সাধন করাই বিধেয়। কৃষিবাণিজ্যাদি কার্য্যে নিযুক্ত ব্যক্তিরা রাজা বা তস্কর হইতে ভীত হইলে ভুপতিকে অতিশয় নিন্দাভাজন হইতে হয়। রাজা গ্রাসাচ্ছাদনাদি[অন্নবস্ত্রাদি]দ্বারা ধনীদিগের গৌরব রক্ষা করিয়া তাহাদিগকে কহিবেন যে, তোমরা আমার ও প্রজাবর্গের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ কর। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা রাজ্যের প্রধান অঙ্গ ও সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, তাহাতে সন্দেহ নাই। ধনবান, প্রাজ্ঞ, শূর, ধার্ম্মিক, তপস্বী, সত্যবাদী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিদিগের দ্বারাই প্রজাদিগের রক্ষা হইয়া থাকে।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! এক্ষণে তুমি সকল প্রাণীর প্রতি প্রীতি প্রকাশ এবং সত্য, সরলতা ও ক্ষমাগুণ অবলম্বন কর; তাহা হইলেই অনায়াসে ধন, মিত্র ও ভূমি লাভ করিতে সমর্থ হইবে।”