৯৫তম অধ্যায়
জামদগ্ন্যবর্ণিত নরনারায়ণ-দম্ভোদ্ভবসংবাদ
বাক্যাবসান হইলে পর, সভ্যগণ স্তব্ধ হইয়া রোমাঞ্চিতকলেবরে চিন্তা করিতে লাগিলেন; কেহ কিছু প্ৰত্যুত্তর প্রদান করিতে সমর্থ হইলেন না। এইরূপে সমস্ত ভূমিপাল তৃষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলে জামদগ্ন্য সকলের সমক্ষে কহিতে লাগিলেন, “হে রাজন! অগ্ৰে আমার সদৃষ্টান্ত বাক্য শ্রবণ করুন, পশ্চাৎ যাহা কল্যাণকর বোধ হয়, তাহা সমাধান করিবেন। শ্রবণ করিয়াছি, পূর্ব্বকালে দম্ভোদ্ভবনামে এক সম্রাট এই অখণ্ড ভূমণ্ডল অধিকার করিয়াছিলেন। তিনি প্রতিদিন প্ৰভাতে গাত্ৰোত্থান করিয়া ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়প্রভৃতি সকলকে জিজ্ঞাসা করিতেন যে, কোন শূদ্র, বৈশ্য, ক্ষত্রিয়, কি ব্রাহ্মণ যুদ্ধে আমার অপেক্ষা উৎকৃষ্ট বা আমার সমান যোদ্ধা বিদ্যমান আছে? রাজা দম্ভোদ্ভব দম্ভোন্মত্ত হইয়া অন্য কোন যোদ্ধার অনুসন্ধানার্থ ঐ কথা বলিতে বলিতে সমস্ত পৃথিবী পর্য্যটন করিতেন। উদারস্বভাব বেদবিৎ ব্রাহ্মণগণ সেই শ্লাঘাপরায়ণ দম্ভকে পুনঃ পুনঃ নিষেধ করিয়াছিলেন; তথাপি সেই গর্ব্বিত সৌভাগ্যমত্ত মহীপাল দ্বিজগণকে বারংবার ঐরূপ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা ব্ৰাহ্মণগণ জাতক্ৰোধ হইয়া সেই উদ্ধতস্বভাব রাজাকে কহিলেন, “হে রাজন! যে দুই মহাপুরুষ সমরে অনেক বীরকে পরাজিত করিয়াছেন, আপনি কদাপি তাঁহাদিগের সমকক্ষ হইবেন না।”
“রাজা ব্ৰাহ্মণগণের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে দ্বিজগণ! সেই দুই বীর কোথায় অবস্থান করেন, কোথায় জন্মগ্রহণ করিয়াছেন এবং তাঁহাদিগের কর্ম্মই বা কি প্রকার?”
“ব্রাহ্মণগণ কহিলেন, নরনাথ! আমরা শ্রবণ করিয়াছি, সেই দুই মহাপুরুষ নর ও নারায়ণ; তাঁহারা মনুষ্যলোকে আগমন করিয়াছেন, আপনি তাঁহাদিগের সহিত যুদ্ধ করুন। এক্ষণে তাঁহারা গন্ধমাদনপর্ব্বতে কোন অনিৰ্দেশ্য [অনির্ব্বচনীয়-আবর্ণনীয়] তপস্যায় নিমগ্ন আছেন।”
দম্ভোদ্ভবসহ নরনারায়ণের যুদ্ধ
“অনন্তর সেই অপরাজিত নর ও নারায়ণ যে স্থানে তপস্যা করিতেছিলেন, অসহিষ্ণুস্বভাব রাজা দম্ভোদ্ভব ষড়ঙ্গিণী [রথ, হস্তী, অশ্ব, পদাতি, শকট ও উষ্ট্রযুক্ত] সেনা সংযোজনপূর্ব্বক সেই স্থানে গমন করিলেন। সেই বিষম ঘোর গন্ধমাদনপর্ব্বতে অনুসন্ধান করিতে করিতে ক্ষুৎপিপাসায় অতিমাত্ৰ কৃশ, বনবাসী, তপস্বী, শীর্ণকায় শীতবাতাতপে [শীত, বায়ু, রৌদ্র] একান্ত ক্লান্ত নর ও নারায়ণকে অবলোকন করিলেন। অনন্তর তাঁহাদের সমীপবর্ত্তী হইয়া নমস্কার ও অনাময় [কুশল] জিজ্ঞাসা করিলে তাঁহারা ফল মূল, আসন ও উদক [জল] দ্বারা তাঁহাকে অর্চ্চনা করিয়া কি কাৰ্য্য সম্পাদনা করিতে হইবে বলিয়া আমন্ত্রণ করিলেন।
“রাজা দম্ভোদ্ভব কহিলেন, হে বীরদ্বয়! আমি বাহুবলে সমস্ত পৃথিবী জয় করিয়াছি এবং সমস্ত শত্ৰুগণকে বিনষ্ট করিয়াছি; এক্ষণে আপনাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার অভিলাষে এই পর্ব্বত প্রদেশে আগমন করিয়াছি। আপনারা এই চিরাকাঙ্খিত [দীর্ঘকালের অভিলষিত] মনোরথ সফল করুন।”
“নরনারায়ণ কহিলেন, “হে রাজন! এই ক্ৰোধলোভাবিবর্জিত আশ্রমে শস্ত্রই বা কোথা, যুদ্ধই বা কোথা এবং কুটিলতাই বা কোথা? এই পৃথিবীতে অনেক ক্ষত্ৰিয় আছেন, তাঁহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিয়া এই আকাঙক্ষা চরিতার্থ কর।”
“নর ও নারায়ণ রাজা দম্ভোদ্ভবকে সান্ত্বনা করিবার নিমিত্ত পুনঃপুনঃ ঐরূপ কহিতে লাগিলেন, তথাপি তিনি ক্ষান্ত না হইয়া যুদ্ধাভিলাষে তাপসদ্ধয়কে আহ্বান করিতে লাগিলেন।
“অনন্তর নর এক মুষ্টি ইষিকা [শরতৃণ] গ্ৰহণ করিয়া তাহাকে কহিলেন, “হে যুদ্ধকাম [যুদ্ধাভিলাষী]! যুদ্ধ কর, সমুদয় অস্ত্ৰ গ্ৰহণ কর এবং সেনা সংযোজিত কর; আমি তোমার সমরানুরাগ অপনীত করিব।”
“দম্ভোদ্ভব কহিলেন, হে তাপস! যদি এইসকল অস্ত্ৰই আমাদিগের প্রতি নিক্ষেপ করা উপযুক্ত বোধ করিয়া থাকেন, নিক্ষেপ করুন। আমিও ইহাদ্বারা আপনার সহিত যুদ্ধ করিব, আমি যুদ্ধার্থী হইয়াই আগমন করিয়াছি।”
পরাজিত আশ্রয়প্রার্থী দম্ভের প্রতি অভয়দান
“রাজা দম্ভোদ্ভব এই কথা কহিয়া সেই তাপসকে সংহার করিবার নিমিত্তে সসৈন্যে তাঁহার চতুর্দ্দিকে শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন নিমিত্তবেধী [প্রতিপক্ষের লক্ষ্যে বাধাপ্রদানকারী] তপস্বী নির ইষিকাদ্বারা পরতনুচ্ছেদী [বিপক্ষদেহভেদকারী] দম্ভোদ্ভবনিক্ষিপ্ত অতি ভীষণ অস্ত্ৰসকল বিকল করিয়া তাঁহার প্রতি অপ্রতিসন্ধেয় [প্ৰতিকারের অযোগ্য] ঐষিক-অস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক অদ্ভুত ব্যাপার উপস্থিত করিলেন। তিনি মায়াপ্রভাবে ইষিকাসমূহদ্বারা দম্ভোদ্ভবের সৈন্যগণের চক্ষু, কর্ণ ও নাসিকা বিকৃত করিলে দম্ভোদ্ভব আকাশমণ্ডল ইষিকাকীর্ণ [ইষিকায় পরিব্যাপ্ত] ও শ্বেতবর্ণ অবলোকন করিয়া ‘আমার মঙ্গল করুন’ বলিয়া তাঁহার চরণে নিপতিত হইলেন।
“তখন শরণার্থিগণের শরণ্য ভগবান নর কহিলেন, “হে নৃপশার্দূল! অতঃপর ধর্ম্মাত্মা ও ব্ৰহ্মপরায়ণ হও; এমন কর্ম্ম পুনরায় করিও না। তোমার সদৃশ পুরুষ ক্ষত্ৰিয়ধর্ম্ম স্মরণ করিয়া কদাচ মনে মনেও ঈদৃশ ব্যবহারে সঙ্কল্প করে না। তুমি গর্ব্বিত হইয়া কি দুর্ব্বল, কি বলবান, কাহাকেও কখন আক্রমণ করিও না। এক্ষণে কৃতপ্ৰজ্ঞ [লব্ধ জ্ঞান], লোভহীন, নিরহঙ্কার, মহানুভব, দান্ত, ক্ষমাবান, মৃদু ও সৌম্য হইয়া প্ৰজাগণকে প্রতিপালন কর। বলাবল অবগত না হইয়া আর কাহাকেও আক্রমণ করিও না। ফলতঃ, কদাপি এরূপ আচরণে প্রবৃত্ত হইও না। এক্ষণে অনুজ্ঞা করিতেছি, পরমসুখে গমন কর, আমাদিগের বাক্যানুসারে ব্রাহ্মণগণকে কুশল জিজ্ঞাসা করিও ।” অনন্তর রাজা দম্ভোদ্ভব নর ও নারায়ণের চরণবন্দনপূর্ব্বক স্ব-নগরে গমন করিয়া ধর্ম্মাচরণ করিতে লাগিলেন।
পুনঃ পুরশুরামের উপদেশ
“মহারাজ! ভগবান নর যে কর্ম্ম সম্পাদন করিয়াছেন, তাহা সামান্য নয়; কিন্তু নারায়ণ নর অপেক্ষাও বহুগুণে শ্রেষ্ঠ; অতএব শরাসনশ্রেষ্ঠ গাণ্ডীবে অস্ত্ৰযোজনা না হইতেই আপনি সম্মানপ্রত্যাশা পরিত্যাগ করিয়া ধনঞ্জয়ের সমীপে গমন করুন। মানবগণ কাকুদীক [যে অস্ত্রের প্রভাবে সৈন্যগণ নিদ্রাভিভূত হইয়া, রথ ও অশ্বগজাদির উপর ঘুমাইয়া পড়ে], শুক [যাহা দ্বারা ভয়প্রাপ্ত হইয়া, রথাদির মধ্যে লুক্কায়িত হয়], নাক [স্বৰ্গ দর্শনের অযোগ্য হইলেও যাহার প্রভাবে উন্মাদবৎ মিথ্যা স্বৰ্গ দর্শন করে], অক্ষিসন্তর্জ্জন [যাহার প্রহারে ভীত হইয়া প্ৰস্ৰাববাহ্য করিয়া ফেলে], সন্তান [অবিচ্ছিন্ন বর্ষণ], নর্ত্তক [যাহার আঘাতে পিশাচের ন্যায় বিকট নৃত্য করে] ঘোর [যাহা নির্দয়ারূপে বিনাশ করে] ও আস্যমোদক [যাহা দ্বারা অবশ্যমৃত্যু হয়—যম-বদনের আনন্দবৰ্দ্ধক] এই আটটি অস্ত্ৰে বিদ্ধ হইলেই প্ৰাণ পরিত্যাগ করে। এই স্থলে কাম, ক্ৰোধ, লোভ, মোহ, মদ, মান, মাৎসৰ্য্য ও অহঙ্কার পূর্বোক্ত অস্ত্ৰ বলিয়া উদাহৃত হইয়াছে। মনুষ্যগণ ঐসকল অস্ত্রে আহত হইলে উন্মত্ত হয়, কখন অচেতন হইয়া কার্য্য করে, কখন শয়ন, কখন লম্ফন, কখন বমন, কখন মূত্ৰত্যাগ, কখন রোদন, কখন বা হাস্য করিতে থাকে।
“সকল লোকের নির্ম্মাতা ও ঈশ্বর সর্ব্বকৰ্মবিৎ নারায়ণ যাঁহার বন্ধু, ত্ৰিলোকীর মধ্যে কোন ব্যক্তি সেই রণদুঃসহ অর্জ্জুনকে পরাজিত করিতে সমর্থ হইবে? মহাবীর অর্জ্জুন যুদ্ধে অদ্বিতীয় ও অশেষগুণসম্পন্ন; আপনিও ধনঞ্জয়ের বিষয় বিলক্ষণ অবগত আছেন। জনাৰ্দন আবার তাঁহা অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। হে রাজন! পূর্ব্বে যে নর ও নারায়ণের কথা কীর্ত্তিত হইল, অর্জ্জুন ও কেশব সেই দুই মহাপুরুষ। যদি আমার বাক্যে আপনার সংশয় না হয়, যদি আমার বাক্য আপনার হৃদয়ঙ্গম হইয়া থাকে, তাহা হইলে আৰ্য্যবুদ্ধি [আস্তিক্যজ্ঞান-বিশ্বাস] অবলম্বন করিয়া পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধি করুন। যদি সুহৃদ্ভেদ [বন্ধুবিচ্ছেদ] না করা কল্যাণকর বোধ হইয়া থাকে, তবে শান্ত হউন; যুদ্ধে অভিলাষ করিবেন না। হে কুরুশ্রেষ্ঠ! আপনাদিগের কুল এই পৃথিবীমণ্ডলে সাতিশয় সম্মানিত, অতএব উহা সেইরূপই থাকুক, আপনার কল্যাণ হউক, এক্ষণে কেবল স্বার্থচিন্তায় মনোনিবেশ করুন।”