৮৩তম অধ্যায়
পথিমধ্যে অশুভসঙঘটন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নরাধিপ! দেবকীনন্দনের গমনকালে দশজন শত্রুসৈন্যনাশক শাস্ত্রপাণি মহাবলপরাক্রান্ত মহারথী, সহস্র পদাতি, সহস্ৰ অশ্বারোহী ও বিপুল ভক্ষ্যদ্রব্য সহিত শত শত কিঙ্কর তাঁহার অনুগমন করিয়াছিল।
জনমেজয় কহিলেন, হে তপোধন! মহাত্মা মধুসূদন কিরূপে গমন করিয়াছিলেন? আর তাঁহার গমনকালে কি কি নৈমিত্তিক ঘটনা হইয়াছিল?
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! মহাত্মা বাসুদেবের প্ৰয়াণসময়ে যেসকল দৈব ও ঔৎপাতিক নিমিত্ত ঘটিয়াছিল, তৎসমুদয় শ্রবণ করুন। বিনা মেঘে বজ্ৰাঘাত, বিদ্যুৎ ও বৃষ্টি আরম্ভ হইল। নদীসমুদয় প্রতিকূলবেগে প্রবাহিত হইতে লাগিল; সপ্ত সমুদ্র পূর্ব্বদিকে ধাবমান হইল। অকস্মাৎ লোকের মনে দিগভ্ৰম জন্মিল; অগ্নি প্রজ্বলিত হইতে লাগিল; পৃথিবীমণ্ডল কম্পিত হইয়া উঠিল; কৃপ ও কুম্ভ হইতে জল উচ্ছলিত হইতে লাগিল; সমুদয় জগৎ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইল; সমুখিত পার্থিব ধূলিপটল-প্রভাবে দিগবিদিক-সকল বিলুপ্তপ্রায় হইল; আকাশমণ্ডলে তুমুল শব্দ সমুখিত হইয়া উঠিল; কিন্তু কে শব্দ করিতেছে, তাহার নির্ণয় হইল না এবং বজ্রনিস্বন নৈর্ঋত বায়ু অসংখ্য পাদপ ভগ্ন করিয়া হস্তিনানগর মথিত করিল। কিন্তু এই সমুদয় উপদ্রব। ভগবান বাসুদেবকে স্পর্শ করিতে পারিল না। তিনি যে যে পথে গমন করিতে লাগিলেন, সেই সেই স্থানে বায়ু সুখস্পর্শ হইল; পদ্ম প্রভৃতি বিবিধ সুগন্ধ পুষ্প বৰ্ষিত হইতে লাগিল; পথসকল সমতল ও কুশকণ্টকরহিত হইল; সহস্ৰ সহস্ৰ ব্ৰাহ্মণ বেদবাক্যে কৃষ্ণের স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন; ব্রাহ্মণগণ মধুপর্ক ও ধনদ্বারা তাঁহাকে পূজা করিতে লাগিলেন। কামিনীগণ পথিমধ্যে আগমনপূর্ব্বক তাঁহার মস্তকে সুগন্ধ বন্যপুষ্প বর্ষণ করিতে লাগিল।
দেবকীনন্দন সর্ব্বশিষ্যপরিপূর্ণ অতিরম্য, সুখাস্পদ, পরমপবিত্র শালিভবন [ধান্যক্ষেত্র] এবং অতিমনোহর ও হৃদয়তোষণ [চিত্তরঞ্জন] বহুবিধ গ্রাম্য পশু সন্দর্শন করিয়া বিবিধ পুর ও রাজ্য অতিক্ৰম করিলেন। কুরুকুলসংরক্ষিত, নিত্যপ্ৰহৃষ্ট, অনুদ্বিগ্ন, ব্যাসনরহিত [আলস্যাদি দোষশূন্য] পুরবাসিগণ কৃষ্ণকে দর্শন করিবার মানসে উপপ্লব্য নগর হইতে পথিমধ্যে আগমন করিয়া তাঁহার পথ প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে মহাত্মা বাসুদেব সমাগত হইলে তাহারা বিধানানুসারে তাঁহার পূজা করিতে লাগিল।
গ্ৰাম্য প্রধানগণের আতিথ্যগ্ৰহণ
এ দিকে ভগবান মরীচিমালী [সূৰ্য্য] স্বীয় কিরণজাল পরিত্যাগ করিয়া লোহিত কলেবর ধারণ করিলে অরতিনিপাতন মধুসূদন বৃক[ক্ষত্ৰিয়বাসবহুল গ্রামপ্রান্ত]স্থলে সমুপস্থিত হইয়া সত্বর রথ হইতে অবতরণপূর্ব্বক যথাবিধি শৌচসমাপন্যান্তে রথাশ্বমোচনে আদেশ করিয়া সন্ধ্যার উপাসনা করিতে লাগিলেন। দারুক কৃষ্ণের আজ্ঞানুসারে অশ্বগণকে রথ হইতে মুক্ত করিয়া শাস্ত্রানুসারে তাহাদের পরিচর্য্যা ও গাত্ৰ হইতে সমুদয় যোক্ত্রাদি [বন্ধনরজ্জু] মোচন করিয়া তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিল। মহাত্মা মধুসূদন সন্ধ্যাসমাপনন্তে স্বীয় সমভিব্যাহারী জনগণকে কহিলেন, “হে পরিচারিকবর্গ। আদ্য যুধিষ্ঠিরের কার্য্যানুরোধে এই স্থানে রজনী অতিবাহিত করিতে হইবে।” তখন পরিচারকগণ তাঁহার অভিপ্ৰায় অবগত হইয়া ক্ষণকালমধ্যে পাটমণ্ডপ [বস্ত্ৰনির্মিত গৃহ-তাম্বু] নির্ম্মাণ ও বিবিধ সুমিষ্ট অন্নপান প্রস্তুত করিল।
অনন্তর সেই গ্রামস্থ স্বধর্ম্মাবলম্বী আৰ্য্য কুলীন ব্রাহ্মণসমুদয় অরাতিকুলকালান্তক [শক্রসংহতাঁ] মহাত্মা হৃষীকেশের সমীপে আগমনপূর্ব্বক বিধানানুসারে তাঁহাকে পূজা ও আশীর্ব্বাদ করিয়া স্ব স্ব ভবনে আনয়ন করিতে বাসনা করিলেন। ভগবান মধুসূদন তাঁহাদের অভিপ্ৰায়ে সম্মত হইলেন এবং তাঁহাদিগকে যথাবিধি অর্চ্চনপূর্ব্বক তাঁহাদের ভবনে গমন করিয়া তাঁহাদিগের সমভিব্যাহারে পুনরায় স্বীয় পটমণ্ডপে আগমন করিলেন। পরে সেই সমুদয় ব্রাহ্মণগণের সমভিব্যাহারে সুমষ্টি দ্রব্যজাত ভোজন করিয়া পরমসুখে যামিনী-যাপন করিলেন।