০৯৮. যুদ্ধমৃত ক্ষত্রিয়েরগতি–ইন্দ্র-অম্বরীষ-সংবাদ

৯৮তম অধ্যায়

যুদ্ধমৃত ক্ষত্রিয়েরগতি–ইন্দ্র-অম্বরীষ-সংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! সমরে অপরাঙ্মুখ বীরগণ রণনিহত হইয়া কোন কোন লোকে গমন করিয়া থাকেন, তাহা কীর্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! এই বিষয় উপলক্ষে ইন্দ্র ও অম্বরীষসংবাদনামে এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তিত হইয়াছে, কহিতেছি, শ্রবণ কর। নাগপুত্র মহাত্মা অম্বরীষ দুর্লভ স্বর্গলোকে গমন করিয়া দেখিলেন যে, তাঁহার সেনাপতি সুদেব ইন্দ্রের সহিত তেজোময় দিব্যবিমানে আরোহণ করিয়া গমন করিতেছে। নাভাগনন্দন সেনাপতির সমৃদ্ধিদর্শনে সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া ইন্দ্রকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “দেবরাজ! আমি সসাগরা পৃথিবী বশবর্ত্তী করিয়া ধৰ্ম্মকামনায় শাস্ত্রানুসারে চারিবর্ণ প্রতিপালন, সমরাঙ্গনে সৈন্যগণকে পরাজয়, ঘোরতর ব্রহ্মচর্য্যের অনুষ্ঠান, গুরুজনসেবা, বেদ ও রাজনীতি অধ্যয়ন এবং অন্নদানদ্বারা অতিথি, স্বাধ্যায়দ্বারা পিতৃলোক, স্বাধ্যায়দ্বারা ঋষি ও যজ্ঞানুষ্ঠানদ্বারা দেবগণের তৃপ্তিসাধন করিয়াছি। এই সুদেব পূৰ্ব্বে আমার সেনাপতি ছিলেন। উনি কোন্ পুণ্যের ফলে এক্ষণে আমাকে অতিক্রম করিয়া গমন করিতেছেন?’

“ইন্দ্র কহিলেন, ‘রাজন্‌! সুদেব অতি বিস্তীর্ণ সংগ্ৰামযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট যজ্ঞ নাই। যোধগণ কবচধারণপূৰ্ব্বক সৈন্যসাগরে অবতীর্ণ হইলেই যুদ্ধযজ্ঞে অধিকারী হইয়া থাকে।

“অম্বরীষ কহিলেন, ‘দেবরাজ! যুদ্ধযজ্ঞের হবিঃ, আজ্য ও দক্ষিণা কি এবং ঋত্বিক্‌ই বা কে, তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করুন।

‘ইন্দ্র কহিলেন, ‘রাজন্‌! কুঞ্জরগণ ঐ যজ্ঞের ঋত্বিক, অশ্বগণ। অধ্বর্ষু, অরাতির মাংস হবিঃ, শোণিত আজ্য এবং শৃগাল, গৃধ্র ও কাকগণ উহার সদস্য। ঐ সদস্যগণ যজ্ঞের আজ্যশেষ পান ও হবিঃ ভক্ষণ করিয়া থাকে। শাণিত প্রাস, তোমর, খড়্গ, শক্তি ও পরশু ঐ যজ্ঞের স্রূক্‌ এবং শত্ৰুশরীরভেদী নিশিত সায়ক উহার স্রূব্‌। হস্তিচর্ম্মাবৃত, গজদন্তনিৰ্ম্মিত, মুষ্টিসম্পন্ন খড়্গ উহার স্ফিক্‌[স্ফ-স্থণ্ডিলে রেখা অঙ্কিত করার খড়্গাকৃতি যজ্ঞীয় কাষ্ঠ]। লৌহময় সুতীক্ষ্ণ প্রাস, শক্তি, ঋষ্টি ও পরশুর আঘাত উহার ধনসম্পত্তি। বীরগণের পরস্পর আক্রমণ ও প্রহারনিবন্ধন যে রুধিরধারা নির্গত হয়, তাহাই ঐ যজ্ঞের সর্ব্বকামপ্রদ পূর্ণাহুতি। সৈন্যগণমধ্যে ‘ছিন্দি, ভিন্দি [ছেদ কর, ভেদ কর]’ প্রভৃতি যেসকল শব্দ শ্রবণগোচর হইয়া থাকে, উহা সামগানস্বরূপ। শত্রুপক্ষীয়দিগের সেনামুখ উহার আজ্যস্থালী [যজ্ঞীয় ঘৃত রাখিবার পাত্র]। হস্তী, অশ্ব এবং বর্ম্মধারী মনুষ্যসমুদয় উহার শ্যেনচিত বহ্নি [শ্যেনযাগাদিতে পূজ্য তন্নামক অগ্নি]। একসহস্র সৈন্য নিহত হইলে যে কবন্ধ উত্থিত হয়, উহা ঐ যজ্ঞের অষ্টকোণবিশিষ্ট খাদির যূপ [খদিরকাষ্ঠের যূপ] আর তলদান [বীরত্বসূচক স্পৰ্ধাপ্রদর্শক করতলশব্দ] উহার বষট্‌কার এবং দুন্দুভি উহার উদ্‌গাতাস্বরূপ। অপহৃত ব্রহ্মস্ব[ব্রাহ্মণের ধনসম্পত্তি] উদ্ধার করিবার নিমিত্ত বিক্রমপ্রকাশপূৰ্ব্বক প্রাণপণে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে অনন্তদক্ষিণ যজ্ঞের ফললাভ হয়। যে বীর প্রভুর হিতার্থ প্রবৃত্ত হইয়া ভয়প্রযুক্ত উহা হইতে বিরত না হয়েন, যিনি নীলচর্ম্মাবৃত খড়্গ ও পরিঘাকার বাহুদ্বারা সমরাঙ্গন সমাকীর্ণ করেন এবং যিনি সহায়নিরপেক্ষ হইয়া একান্তমনে সৈন্যসাগরে প্রবিষ্ট হয়েন, তিনি আমার সারবাক্য লাভ করিয়া থাকেন।

‘যে মহাবীর ভেরী, মৃদঙ্গ প্রভৃতি বাদ্যসমুদয়স্বরূপ মণ্ডুক ও কচ্ছপ, বীরগণের অস্তিস্বরূপ কৰ্কর [জল], মাংস ও শোণিতস্বরূপ কর্ম্ম, খড়্গ চৰ্ম্ম গৃধ্র কঙ্ক ও বায়সস্বরূপ ভেলা, কেশকলাপস্বরূপ শৈবাল[শেওলা] ও শাল[তৃণময় স্থান], অশ্ব ও হস্তিস্বরূপ সেতু, পতাকা ও ধ্বজস্বরূপ বেতসলতা[বেত], নিহত কুঞ্জরস্বরূপ মহানক্র এবং ঋষ্টি ও খড়্গস্বরূপ নৌকাসমাকীর্ণ রাক্ষসবহুল ভীরুজনভয়াবহ শোণিতনদী প্রবাহিত করিতে পারেন, তিনি ঐ যজ্ঞের অবভৃতস্নানের [যজ্ঞান্ত স্নানের] উপযুক্ত পাত্র। শত্রুগণের সেনামুখ যাঁহার পত্নীশালা [পত্নীগণের আমোদ-প্রমোদ গৃহ], যোধগণ যাঁহার দক্ষিণ সদস্য, উত্তরদিক্‌ যজ্ঞকুণ্ড, শত্রুসেনা যাঁহার কলত্র ও উভয় ব্যূহমধ্যস্থান যাঁহার যজ্ঞবেদীস্বরূপ হয় এবং বিপক্ষগণের মস্তক ও হস্তী এবং অশ্বদ্বারা যিনি ঐ বেদী সমাচ্ছন্ন করেন, তিনিই আমার সালোক্য[ইন্দ্রলোক]লাভ করিতে পারেন। যে যোদ্ধা ভীতচিত্তে সমরপরাঙ্মুখ হইয়া বিপক্ষশরে নিহত হয়, সে নিঃসন্দেহ নরকে গমন করে। যে মহাবীরের শোণিতধারা এবং কেশ, মাংস ও অস্থিসমূহদ্বারা সমরাঙ্গন সমাচ্ছন্ন হয়, তিনি উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিয়া থাকেন। যিনি বিপক্ষপক্ষীয় সেনাপতিকে বিনষ্ট করিয়া তাহার যানে আরোহণ করেন, সেই মহাবীর বিষ্ণুর ন্যায় বিক্রমসম্পন্ন ও বৃহস্পতির তুল্য বুদ্ধিমান হয়েন। যিনি রণস্থলে সেনানায়ক ও তাহার পুত্র অথবা যে-কোন, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে বিনষ্ট করিয়া আপনার বশীভূত করিতে পারেন, তিনি আমার সালোক্যলাভের উপযুক্ত পাত্র।

‘যে ব্যক্তি যুদ্ধে বিনষ্ট হইয়াছে, তাহার নিমিত্ত শোকপ্রকাশ করা কর্ত্তব্য নহে। সমরনিহত বীরপুরুষ নিশ্চয়ই স্বর্গে গমন করিয়া থাকেন। তাঁহার ঔর্দ্ধদেহিক কার্য্যের নিমিত্ত অন্ন-জল প্রদান ও অশৌচ গ্রহণ করিবার বিশেষ আবশ্যকতা নাই। বীরপুরুষ ক্ষাত্ৰধৰ্ম্মানুসারে সংগ্রামনিহত হইলে অপ্সরাসকল তাঁহাকে পতিত্বে বরণ করিবার নিমিত্ত সত্বর ধাবমান হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি ধৰ্ম্মযুদ্ধ প্রতিপালন করেন, তাঁহার তপস্যা শাশ্বত ধৰ্ম্ম এবং চারি-আশ্রমের ফললাভ হইয়া থাকে। বৃদ্ধ, বালক ও স্ত্রীলোককে এবং যে ব্যক্তি তৃণ মুখে লইয়া [শরণাগতির লক্ষণস্বরূপ দন্তে তৃণ ধারণ করিয়া] শরণাপন্ন হয়, তাহাকে বিনাশ করা কদাচ কর্ত্তব্য নহে। আমি জম্ভ, বৃত্ৰ, বল, বিরোচন, দুর্নিবার নমুচি, মায়াবী শম্বর, বিপ্রচিত্তি, প্রহ্লাদ ও অন্যান্য দানবগণকে বিনাশ করিয়া ইন্দ্ৰত্বলাভ করিয়াছি।”