০৫৩. যুধিষ্ঠিরাদির পুনরায় ভীষ্মসমীপে গমন

৫৩তম অধ্যায়

যুধিষ্ঠিরাদির পুনরায় ভীষ্মসমীপে গমন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর ভগবান বাসুদেব সুখে সুপ্ত ও যামিনী অর্দ্ধপ্রহরমাত্র অবশিষ্ট হইলে জাগরিত হইয়া ধ্যানে মনোনিবেশপূৰ্ব্বক জ্ঞানসমুদয় অবলোকন করিয়া সনাতন ব্রহ্মের চিন্তা করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে স্তুতিবাদকুশল মধুরকণ্ঠ সুশিক্ষিত বৈতালিকেরা তাঁহার স্তুতিবাদে প্রবৃত্ত হইল। গায়কেরা গান ও পাণিস্বনিকগণ [করতলশব্দদ্বারা তলদানকারিগণ] করতালিদ্বারা তাল প্রদান করিতে লাগিল। শঙ্খ ও মৃদঙ্গধ্বনিতে গৃহ পরিপূর্ণ হইল এবং বীণা, পণব ও বেণুর অতিমনোহর স্বর প্রাসাদের অট্টহাস্যের [উচ্চহাস্যের] ন্যায় শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল।

অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠিরের প্রবোধনার্থ মধুর স্তুতিবাদ ও গীতবাদ্য আরম্ভ হইল। তখন বাসুদেব শয্যা হইতে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক সলিলে অবগাহন করিলেন এবং পরমগুহ্য মন্ত্র জপ ও হুতাশনে আহুতি প্রদানপূর্ব্বক চতুর্ব্বেদী ব্রাহ্মণগণের প্রত্যেককে সহস্র গো দান করিয়া স্বস্তিবাচন করাইলেন। তৎপরে মাঙ্গল্য দ্রব্যজাত স্পর্শ ও নির্মল আদর্শে[আয়নায়] আপনার প্রতিকৃতি[অবয়ব-দেহ] দর্শন করিয়া সাত্যকিকে কহিলেন, “যুযুধান! তুমি রাজা যুধিষ্ঠিরের আবাসে গমন করিয়া, তিনি ভীষ্মদর্শনার্থ প্রস্তুত হইয়াছেন কি না, জানিয়া আইস।” তখন মহাত্মা সাত্যকি বাসুদেবকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া অবিলম্বে যুধিষ্ঠিরসন্নিধানে গমনপুৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! বাসুদেব মহাত্মা ভীষ্মের নিকট গমন করিবেন, তাঁহার রথ সুসজ্জিত হইয়াছে, এক্ষণে তিনি কেবল আপনারই অপেক্ষা করিতেছেন। অতএব আপনার যাহা কৰ্ত্তব্য হয়, অবধারণ করুন।”

তখন রাজা যুধিষ্ঠির সাত্যকির বাক্য শ্রবণ করিয়া অৰ্জ্জুনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “ধনঞ্জয়! তুমি অবিলম্বে আমার রথ যোজন কর। আমাদের সমভিব্যাহারে সৈন্যগণের গমন করিবার আবশ্যক নাই। অদ্য কেবল আমরা কয়েকজন মাত্র ভীষ্মদর্শনার্থ যাত্রা করিব। মহাত্মা ভীষ্মকে কষ্ট প্রদান করা আমার নিতান্ত অকর্ত্তব্য; অতএব আমাদিগের অগ্রবর্তী লোকসমুদয় যেন তথায় গমন না করে। আজ অবধি মহাত্মা ভীষ্ম আমাদিগকে পরম গোপনীয় বিষয়ে উপদেশ প্রদান করিবেন; অতএব সামান্য লোকের সহিত তাঁহার নিকটে গমন করিতে কিছুতেই আমার অভিরুচি হইতেছে না।” মহাত্মা ধৰ্ম্মনন্দন এইরূপ আদেশ করিলে মহাবীর ধনঞ্জয় তাঁহার আজ্ঞা শিরোধার্য্য করিয়া অবিলম্বে রথযোজনপূর্ব্বক তাঁহাকে বিজ্ঞাপিত করিলেন।

অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেব সকলে রথারোহণপূর্ব্বক পঞ্চভূতের ন্যায় কৃষ্ণের আবাসে গমন করিলেন। তাঁহারা উপস্থিত হইবামাত্র মহাত্মা বাসুদেব সাত্যকির সহিত রথে আরূঢ় হইলেন। অনন্তর তাঁহারা সকলে রথোপরি অবস্থান করিয়াই পরস্পরকে সম্ভাষণ ও সুখশয়নসংবাদ জিজ্ঞাসা করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের রথসমুদয় মহাবেগে ও মেঘগম্ভীরনির্ঘোষে গমন করিতে লাগিল। শৈব্য, সুগ্রীব, মেঘপুষ্প ও বলাহকনামক অশ্বচতুষ্টয় দারুকের প্রযত্নে মহাবেগে সঞ্চালিত হইয়া খুরাগ্রদ্বারা ভূতল বিদীর্ণ করিয়া মহাবেগে গমন করিতে আরম্ভ করিল। কিয়ৎক্ষণ পরে মহামতি বাসুদেব ও যুধিষ্ঠির প্রভৃতি মহাত্মারা ধর্ম্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে সমুপস্থিত হইয়া, যে স্থানে মহাবীর ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ন করিয়া মহর্ষিগণের সহিত অবস্থান করিতেছিলেন, অবিলম্বে তথায় উপস্থিত হইলেন। তৎপরে তাঁহারা সত্বর রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া দক্ষিণহস্ত উত্তোলনপূর্ব্বক মহর্ষিগণকে অর্চ্চনা করিতে লাগিলেন। অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির নক্ষত্রপরিবৃত শশধরের ন্যায় ভ্রাতৃবর্গ, বাসুদেব ও সাত্যকিকর্ত্তৃক পরিবেষ্টিত হইয়া, ইন্দ্র যেমন ব্রহ্মার নিকট গমন করিয়াছিলেন, তদ্রূপ মহাত্মা ভীষ্মের নিকট গমন করিলেন এবং তাঁহাকে নভোমণ্ডলপরিভ্রষ্ট সূৰ্য্যের ন্যায় নিরীক্ষণ করিয়া ভীতচিত্তে দণ্ডায়মান রহিলেন।