০৫২. কৃষ্ণবরে ভীষ্মের দৈহিক অবসাদের অবসান

৫২ম অধ্যায়

কৃষ্ণবরে ভীষ্মের দৈহিক অবসাদের অবসান

বৈশম্পায়ন কহিলেন, তখন শান্তনুনন্দন মহাত্মা ভীষ্ম বাসুদেবের সেই ধৰ্মার্থযুক্ত হিতবাক্য শ্রবণ করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “লোকনাথ! আজ তোমার বাক্য শ্রবণ করিয়া আমার অন্তঃকরণ আহ্লাদসাগরে নিমগ্ন হইল। আমি তোমার নিকট কি কীৰ্ত্তন করিব? সকল বাক্যই তোমাতে বিদ্যমান রহিয়াছে। ইহলোকে তুমিই বুদ্ধিমানদিগের অগ্রগণ্য। মনুষ্যগণ যে সমস্ত কর্ত্তব্যকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছে বা করিতেছে, তৎসমুদয়ই তোমা হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। যে ব্যক্তি দেবরাজসমীপে সমুদয় দেবলোকের কথা কহিতে পারে সেই ব্যক্তিই তোমার নিকট ধর্ম্মার্থকামমোক্ষের অর্থ কীৰ্ত্তন করিতে সমর্থ। এক্ষণে শরাঘাতনিবন্ধন আমার অন্তঃকরণ নিতান্ত ব্যথিত, গাত্র অবসন্ন ও বুদ্ধি কলুষিত হইয়া গিয়াছে। আমি বিষাগ্নিসদৃশ শরজালে নিপীড়িত হইয়া এককালে বক্তৃতাশক্তিবিহীন হইয়াছি। এখন আমার কিছুমাত্র বল নাই। প্রাণ দেহ হইতে বহির্গত হইবার চেষ্টা করিতেছে। দৌৰ্ব্বল্যপ্রযুক্ত উত্তমরূপে বাক্যস্ফূৰ্ত্তি হইতেছে না। এক্ষণে কিরূপে তোমার আজ্ঞা প্রতিপালন করিব? অতএব তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া ক্ষমা কর। সুরগুরু বৃহস্পতিও তোমার নিকট ধর্ম্মাধর্ম্ম কীৰ্ত্তন করিতে অবসন্ন হয়েন। আমি কিরূপে উহা কীৰ্ত্তন করিব? বিশেষতঃ এক্ষণে আমি পৃথিবী, আকাশ ও দিক্‌সকল নির্ণয় করিতে পারিতেছি না। কেবল তোমারই বীৰ্য্যপ্রভাবে এতাবৎকাল জীবিত রহিয়াছি। অতএব তুমি স্বয়ং ধৰ্ম্মরাজকে হিতোপদেশ প্রদান কর। তুমি সমুদয় শাস্ত্রের আকর, লোকর্তা ও নিত্য পদার্থ। তুমি বিদ্যমান থাকিতে আমার মত ক্ষুদ্র লোক কিরূপে অন্যকে উপদেশ প্রদান করিবে? গুরু বিদ্যমান। থাকিতে শিষ্য কি উপদেশ প্রদান করিতে পারে?”

বাসুদেব কহিলেন, “গাঙ্গেয় [গঙ্গানন্দন]! আপনি সর্ব্বার্থদর্শী, মহাবীর ও কৌরবগণের ধুরন্ধর[শ্রেষ্ঠ]; সুতরাং আপনি এরূপ বিনীতবাক্য প্রয়োগ করিবেন, ইহা বিচিত্র নহে। আপনি শরনিপীড়িত হইয়া নিতান্ত কাতর হইয়াছেন, অতএব আমি প্রীত হইয়া আপনাকে এই বর প্রদান করিতেছি যে, আপনার শরাঘাতনিবন্ধন গ্লানি, মুর্চ্ছা, দাহ ও ক্ষুৎপিপাসা প্রভৃতি কোনপ্রকার ক্লেশ থাকিবে না। আপনার অন্তঃকরণ জ্ঞানালোকে সমুজ্জ্বল হইবে এবং বুদ্ধির কোনপ্রকার ব্যতিক্রম ঘটিবে না। আপনার মন রজোগুণ ও তমোগুণ পরিহারপূর্ব্বক সত্ত্বগুণ আশ্রয় করিয়া মেঘনির্ম্মুক্ত শশাঙ্কের ন্যায় নিৰ্ম্মল হইবে এবং আপনার বুদ্ধিবৃত্তি কেবল ধর্ম্মার্থযুক্ত বিষয়ে আসক্ত থাকিবে। মীন যেমন নিৰ্ম্মল জলমধ্যে সমুদয় দেখিতে পায়, তদ্রূপ আপনি দিব্যচক্ষুপ্রভাবেই এই চতুর্ব্বিধ ভূতগ্রাম অনায়াসে প্রত্যক্ষ করিতে পারিবেন।”

হে মহারাজ! মধুসূদন এই কথা কহিলে বেদব্যাস প্রভৃতি মহর্ষিগণ বিবিধ বেদবাক্যদ্বারা তাঁহার স্তব করিতে লাগিলেন। ঐ সময় নভোমণ্ডল হইতে বাসুদেব, ভীষ্মদেব ও পাণ্ডবগণের মস্তকে সৰ্ব্বকালসম্ভূত পুষ্প নিপতিত হইতে লাগিল। অপ্সরাগণ বিবিধ বাদ্যধ্বনিসহকারে সঙ্গীত করিতে আরম্ভ করিল। কোনপ্রকার অহিতসূচক দুর্নিমিত্ত লক্ষিত হইল না। সুগন্ধি শীতল সমীরণ মন্দ মন্দ প্রবাহিত, দিক্‌সমুদয় প্রশান্ত এবং কুরঙ্গ ও বিহঙ্গমগণ ইতস্ততঃ ধাবমান হইতে লাগিল। ইত্যবসরে ভগবান্ মরীচিমালী সমুদয় কানন দগ্ধ করিয়াই যেন অস্তাচলচূড়াবলম্বী হইলেন। তখন মহর্ষিগণ স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিবার মানসে গাত্রোত্থান পূৰ্ব্বক ভগবান বাসুদেব, ভীষ্মদেব ও রাজা যুধিষ্ঠিরকে আমন্ত্রণ করিলেন। মহাত্মা মধুসূদন, পাণ্ডবগণ, সাত্যকি, সঞ্জয় ও কৃপাচার্য্য তাঁহাদিগকে অভিবাদন করিতে লাগিলেন। ধর্ম্মনিরত মহর্ষিগণ তাঁহাদিগের কর্ত্তৃক সুচারুরূপে পূজিত হইয়া ‘কল্য পুনরায় সকলেই এই স্থানে মিলিত হইব’ বলিয়া সত্বর স্ব স্ব নিকেতনে প্রস্থান করিলেন; মহাত্মা বাসুদেবও পাণ্ডবগণসমভিব্যাহারে ভীষ্মকে আমন্ত্রণ ও প্রদক্ষিণ করিয়া রথারূঢ় হইলেন। তখন কাঞ্চনকূবরযুক্ত ভূধরতুল্য রথ, মদমত্ত মাতঙ্গ, গরুড়ের ন্যায় বেগবান অশ্ব ও শরশরাসনধারী পদাতিগণ মহাবেগে ধাবমান হইল। মহানদী নর্ম্মদা যেমন ঋক্ষবান্‌গিরির অগ্রে ও পশ্চাদ্ভাগে প্রবাহিত হইয়া থাকে, তদ্রূপ সেই বিপুল সেনা পাণ্ডবগণের রথের অগ্রে ও পশ্চাদ্ভাগে গমন করিতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে ভগবান নিশাকর সমুদিত হইয়া সেই সৈন্যগণকে পুলকিত ও মার্ত্তণ্ডের প্রখরকরজালে শুষ্কপ্রায় ওষধিসমুদয়কে পুনরায় রসসম্পন্ন করিতে লাগিলেন। অনন্তর মহাত্মা বাসুদেব ও পণ্ডিবগণ, পরিশ্রান্ত সিংহগণ যেমন গুহায় প্রবেশ করে, তদ্রূপ সেই সুরপুরতুল্য ভবনমধ্যে প্রবেশ করিয়া স্ব স্ব আবাসে গমন। করিলেন।