৮৫তম অধ্যায়
ভীমকরে নিষঙ্গিপ্রমুখ বীরগণ বধ—কর্ণভীতি
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর দুঃশাসন নিহত হইলে নিষঙ্গী, কবচী, পাশী, দণ্ডধার, ধনুগ্ৰহ, অলুলোপ, সহ, ষণ্ড, বাতবেগ ও সুবৰ্চা আপনার এই দশ পুত্র ভ্রাতৃশোকে, নিতান্ত কাতর হইয়া ক্রোধভরে শরনিকরে মহাবীর ভীমসেনকে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। বীরবরাগ্রগণ্য বৃকোদর সেই ক্রোধনস্বভাব, সমরে অপরাঙ্মুখ মহারথগণের বিশিখজালে বিদ্ধ ও রোষে লোহিতনেত্র হইয়া ক্রুদ্ধ কালান্তক যমের ন্যায় শোভা ধারণপূর্ব্বক সুবর্ণপুঙ্খ বেগবান দশভঙ্গে তাঁহাদের দশজনকে নিপাতিত করিলেন। কৌরবসৈন্যগণ তদ্দর্শনে ভীমভয়ে একান্ত ভীত হইয়া সূতপুত্রের সমক্ষেই পলায়ন করিতে লাগিল।
“ঐ সময় মহাবীর কর্ণ প্রজানাশক কৃতান্তের ন্যায় ভীমসেনের ভীষণ পরাক্রম দেখিয়া নিতান্ত ভীত হইলেন। তখন মহামতি শল্য তাঁহার শরীরদর্শনে মনের বিকার বুঝিতে পারিয়া তাঁহাকে তৎকালোচিত বাক্যে কহিতে লাগিলেন, ‘হে কর্ণ! ঐ দেখ, ভূপতিগণ ভীমসেনের ভয়ে ইতস্ততঃ পলায়ন করিতেছেন। মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন দুঃশাসনের রুধিরপান করাতে দুর্য্যোধন ভ্রাতৃশোকে নিতান্ত কাতর ও বিমোহিত হইয়াছেন। তাঁহার হতাবশিষ্ট সহোদরগণ তাঁহার চতুর্দ্দিকে উপবেশনপূর্ব্বক শুশ্রুষা করিতেছেন। মহাত্মা কৃপ নিতান্ত শোকসন্তপ্ত ও বিষন্ন হইয়া তাঁহার নিকট উপবিষ্ট রহিয়াছেন। ধনঞ্জয় প্রমুখ মহাবলপরাক্রান্ত পাণ্ডবগণ অন্যান্য বীরগণকে পরাজিত করিয়া তোমার অভিমুখেই সমাগত হইতেছে। অতএব এ সময় ব্যথিত বা বিষন্ন হওয়া তোমার উচিত নহে। তুমি ক্ষাত্রধর্ম্মানুসারে পৌরুষ প্রকাশ করিয়া অবিলম্বে ধনঞ্জয়ের প্রতি গমন কর। দুৰ্য্যোধন তোমার প্রতি সমুদয় ভার অর্পণ করিয়াছেন; তুমি আপনার সাধ্যানুসারে সেই ভার বহন কর। সংগ্রামে জয়লাভ করিলে বিপুল কীৰ্ত্তি এবং পরাজিত হইয়া নিহত হইলে স্বর্গলাভ হয়, সন্দেহ নাই। ঐ দেখ, তুমি বিমোহিত হওয়াতে তোমার পুত্র বৃষসেন কোপাবিষ্ট হইয়া পাণ্ডবগণের প্রতি ধাবমান হইতেছে।
“হে মহারাজ! মহাতেজস্বী মদ্ররাজ এই কথা কহিলে মহাবীর কর্ণ মনে মনে যুদ্ধ অবশ্য কর্ত্তব্য বলিয়া স্থির করিলেন।
কর্ণপুত্র বৃষসেনসহ যুদ্ধে নকুলপরাজয়
“অনন্তর কর্ণপুত্র বৃষসেন কোপাবিষ্ট হইয়া গৃহীতদণ্ড কালান্তক যমের ন্যায় সংগ্রামনিরত গদাদণ্ড বৃকোদরের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর নকুল তদর্শনে ক্রোধভরে কর্ণপুত্রের উপর শরনিকর বর্ষণ করিয়া জম্ভাসুরাভিমুখে ধাবমান পুরন্দরের ন্যায় তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন এবং অবিলম্বে ক্ষুরদ্বারা তাঁহার স্ফটিকবিন্দুশোভিত ধ্বজ ও ভল্লদ্বারা সুবর্ণভূষিত বিচিত্র শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন কর্ণতনয় দুঃশাসনের ঋণ হইতে মুক্ত হইবার মানসে অবিলম্বে অন্য শরাসন গ্রহণ করিয়া দিব্যমহাস্ত্রদ্বারা নকুলকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। মহাত্মা নকুল বৃষসেনের অস্ত্রাঘাতে কোপান্বিত হইয়া মহোল্কাসদৃশ শরনিকরে তাহাকে বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন; শিক্ষিতাস্ত্র বৃষসেনও নকুলের প্রতি দিব্যাস্ত্রনিচয় বর্ষণ করিতে লাগিলেন। অনন্তর কর্ণপুত্র শরাভিঘাতজনিত ক্রোধ এবং স্বীয় দীপ্তি ও অস্ত্রপ্রভাবে হুতহুতাশনের ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া উৎকৃষ্ট অস্ত্রদ্বারা নকুলের সুবর্ণজালজড়িত বনায়ুদেশীয় শুভ্রবর্ণ অশ্বগণকে নিপাতিত করিলেন। তখন বিচিত্র যোদ্ধা নকুল সেই হতাশ্ব রথ হইতে অবরোহণপূর্ব্বক সুবর্ণময় চন্দ্ৰপরিশোভিত চন্দ্র ও আকাশসবর্ণ অসি ধারণ করিয়া বিহঙ্গমের ন্যায় বিচরণপূর্ব্বক অন্তরীক্ষে লম্ফপ্রদান করিয়া বৃষসেনের হস্তী, অশ্ব ও রথসমুদয় ছেদন করিতে লাগিলেন। কর্ণপুত্রের সেই ত্রিবিধ সৈন্য নকুলের খঘাতে যাজ্ঞিকর্ত্তৃক নিকৃত্ত পশুর ন্যায় ছিন্নভিন্ন হইয়া ভূতলে নিপাতিত হইল। ঐ সময় সমরবিশারদ, সত্যপ্ৰতিজ্ঞ, চন্দনচর্চিত, নানাদেশসস্তৃত দুইসহস্র বীর বিজয়াভিলাষী একমাত্র মহাবীর নকুলের অসিপ্রহারে নিহত হইয়া ধরাশয্যা গ্রহণ করিলেন।
“তখন মহাবীর বৃষসেন মহাবেগে নকুলের সম্মুখীন হইয়া তাঁহাকে শরনিকরে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন; নকুলও তাঁহাকে অনবরত শরজালে বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। বৃষসেন নকুলশরে গাঢ়তর বিদ্ধ হইয়া ক্রোধে একান্ত অধীর হইলেন। হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর নকুল ভ্রাতা ভীমসেনপ্রভাবে সেই তুমুল রণস্থলে রক্ষিত হইয়া অতি ভয়ঙ্কর কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিতে লাগিলেন।
“অনন্তর কর্ণের আত্মজ বৃষসেন মহারথ নকুলকে রথী, অশ্ব, মাতঙ্গ ও মনুষ্যগণকে শরনিকরে নিরন্তর বিদ্ধ করিতে দেখিয়া ক্রোধভরে তাঁহাকে অষ্টাদশশরে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর নকুল সেই কর্ণসুত-নিক্ষিপ্ত শরনিকরে গাঢ়তর বিদ্ধ হইয়া তাঁহার বিনাশবাসনায় মহাবেগে ধাবমান হইলেন। বৃষসেন বিস্তীর্ণপক্ষ আমিষলুব্ধ শ্যেনপক্ষীর ন্যায় নকুলকে সহসা আগমন করিতে দেখিয়া তাহার প্রতি নিশিত শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর নকুল বৃষসেন-নিক্ষিপ্ত শরনিকর নিতান্ত নিষ্ফল করিয়া বিচিত্ৰগতি প্রদর্শনপূর্ব্বক রণস্থলে সঞ্চরণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। অনন্তর কর্ণসুত বৃষসেন শরজালদ্বারা নকুলের সহস্র তারকাসমলঙ্কৃত চর্ম্ম খণ্ড খণ্ড করিয়া নিশিত ছয়শরে তাঁহার গুরুভারসাধন, শত্রুগণের প্রাণনাশক, সর্পবিষের ন্যায় নিতান্ত উগ্র, কোষনিষ্কাশিত, সুতীক্ষ্ণ অসি ছেদনপূর্ব্বক শাণিত শরনিকরে তাঁহার বক্ষঃস্থল সাতিশয় বিদ্ধ করিলেন। এইরূপে মহাবীর নকুল বৃষসেনের শরনিকরে বিরথ, খড়্গহীন ও সাতিশয় সন্তপ্ত হইয়া অবিলম্বে ধনঞ্জয়ের সমক্ষে সিংহ যেমন অচলশিখরে আরোহণ করে, তদ্রূপ ভীমসেনের রথে আরোহণ করিলেন।
“অনন্তর মহাবীর বৃষসেন সেই দুই মহারথকে একরথে অবস্থান করিতে দেখিয়া ক্রোধাবিষ্টচিত্তে তাঁহাদিগকে বিদ্ধ করিবার অভিলাষে অনবরত শরবৃষ্টি করিতে লাগিলেন; তৎপরে অন্যান্য কৌরবগণও সমবেত হইয়া তাঁহাদের প্রতি শরনিকর বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন মহাবীর ভীম ও অর্জ্জুন রোষপ্রভাবে হুতহুতাশনের ন্যায় সাতিশয় প্রদীপ্ত বৃষসেনের প্রতি অনবরত শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাবীর ভীম অর্জ্জুনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়! এই দেখ, নকুল কর্ণাত্মজনিক্ষিপ্ত শরনিকরে নিতান্ত নিপীড়িত হইতেছে। মহাবীর বৃষসেন আমাদিগের উপরও শরবর্ষণ করিতেছে; অতএব তুমি অবিলম্বে উহার প্রতি গমন কর। ’হে মহারাজ! মহাবীর ধনঞ্জয় বৃকোদরের বাক্য শ্রবণ করিবামাত্র তৎক্ষণাৎ তাঁহার রথসন্নিধানে সমুপস্থিত হইলেন। মাদ্ৰীতনয় নকুল তাঁহাকে তথায় সমাগত দেখিয়া কহিলেন, ‘হে বীর! আপনি শীঘ্র বৃষসেনকে বিনাশ করুন।’ তখন মহাবীর ধনঞ্জয় ভ্রাতা নকুলের বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া কেশবকে অবিলম্বে বৃষসেনের অভিমুখে অসঞ্চালন করিতে কহিলেন।”