০৬৯. ঋতুপর্ণরাজপত্নীর নিকট নল-দময়ন্তীর পরিচয়-প্রকাশ

৬৯তম অধ্যায়

ঋতুপর্ণরাজপত্নীর নিকট নল-দময়ন্তীর পরিচয়-প্রকাশ

‘সুদেব কহিলেন, “হে ভদ্রে! এই কামিনী বিদর্ভদেশাধিপতি ধর্ম্মাত্মা মহারাজ ভীমের দুহিতা; ইহার নাম দময়ন্তী। ইনি মহীপতি বীরসেনের পুত্র পুণ্যশ্লোক নলরাজের ভাৰ্য্যা। নরপতি নল ভ্রাতার সহিত দ্যূতক্রীড়ায় সমুদয় রাজ্য পরাজিত হইয়া দময়ন্তী-সমভিব্যাহারে যে কোথায় প্রস্থান করিয়াছেন, কেহই জানে না। আমরা এই দময়ন্তীকে অন্বেষণ করিয়া সমুদয় পৃথিবী পৰ্যটনপূর্ব্বক পরিশেষে আপনার পুত্রের ভবনে ইহার সন্দর্শন পাইলাম। মনুষ্যলোকে ইঁহার তুল্য রূপবতী কামিনী আর কেহই নাই। এই বরবর্ণিনীর ভ্রূদ্বয়ের মধ্যস্থিত পদ্মসন্নিভ স্বাভাবিক জটুলচিহ্ন মলসংবৃত হইয়া ঘনঘটাসমাচ্ছন্ন চন্দ্ৰমার ন্যায় অন্তর্হিত রহিয়াছে। বিধাতা ইঁহাকে অতুল ঐশ্বৰ্য্যের অধিকারিণী করিবার নিমিত্ত ভ্রূমধ্যে ঐ জটুলচিহ্ন নির্ম্মাণ করিয়াছেন। এই কামিনীর রূপ প্রতিপদের চন্দ্রকলার ন্যায় অদৃশ্যপ্রায় রহিয়াছে। ইহার কলেবর সাতিশয় মলসমাবৃত ও অসংস্কৃত হইয়াও কাঞ্চনের ন্যায় দীপ্তি পাইতেছে। যেমন ভস্মরাশিসমাচ্ছন্ন অনল উষ্মা[তাপ]দ্বারা অনুমিত হয়, তদ্রূপ ইঁহার মলসমাবৃত শরীরকান্তি ও জটুলচিহ্নসন্দর্শনে ইঁহাকে দময়ন্তী বলিয়াই আমার প্রত্যভিজ্ঞা [সবিশ্বস্ত জ্ঞান—নিশ্চয় ধারণা] জন্মিয়াছে।”

“সুনন্দা সুদেবের বাক্যশ্রবণানন্তর দময়ন্তীর ভ্রমধ্যের মলসকল অপনীত করিলে তৎক্ষণাৎ তাঁহার ভূমধ্যস্থ জটুলচিহ্ন নির্ম্মল নভস্তলস্থিত শশাঙ্কের ন্যায় শোভমান হইতে লাগিল। সুনন্দা ও রাজমাতা সেই জটুলচিহ্ন-সন্দশূনে সাতিশয় কাতরা হইয়া রোদন করিতে করিতে দময়ন্তীকে আলিঙ্গন করিলেন। তখন রাজমাতা বাষ্পগদগদ বচনে ভৈমীকে কহিলেন, “বৎসে! এই জটুলচিহ্ন দেখিয়া স্পষ্টই বোধ হইতেছে, তুমি আমার ভগিনীর দুহিতা। তোমার মাতা এবং আমি দশার্ণ-দেশাধিপতি মহাত্মা সুদামা মহীপতির তনয়া। দশর্ণরাজ তোমার মাতাকে ভীমের হস্তে ও আমাকে বীরবাহুর হস্তে সমর্পণ করেন। আমি তোমাকে দশার্ণনগরে আমার পিতার গৃহে জন্মগ্রহণ করিতে দেখিয়াছি। হে ভাবিনি! আমার ভবন তোমার পিতৃগৃহের তুল্য এবং আমার ঐশ্বৰ্য্য তোমার স্বীয় ধনসম্পত্তির সদৃশ।”

দময়ন্তীর পিতৃভবনে আগমন

“তখন দময়ন্তী প্ৰহৃষ্টমনে মাতৃস্বসার চরণে প্ৰণিপাতপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, ‘মাতঃ! যদিও এতাবৎকােল আপনি আমাকে জানিতেন না, আমিও আপনাকে বিশেষরূপে চিনিতে পারি নাই, তথাপি আপনার গৃহে সর্ব্বপ্রকার ভোগ্যবস্তু উপযোগ করিয়া পরমসুখে কালযাপন করিয়াছি; আপনিও আমাকে সাবধানে রক্ষা করিয়াছেন। এক্ষণে এস্থানে বাস করিলে সর্ব্বাপেক্ষা সমধিক সুখসম্ভোগে কালব্যাপন করিতে পারিব, সন্দেহ নাই; কিন্তু আমি বহুদিন হইল প্রবাসে রহিয়াছি, এই নিমিত্ত আমাকে পিতৃভবনগমনে অনুমতি করুন। আমার তনয় ও তনয়া একে বালক, তাহাতে আবার পিতৃমাতৃবিরহে নিতান্ত শোকার্ত্ত হইয়া তথায় রহিয়াছে; অতএব যদি আপনি আমার কিছুমাত্র প্রিয়ানুষ্ঠান করিতে বাঞ্ছা করেন, তবে ত্বরায় আমাকে বিদর্ভনগরে প্রেরণ করুন।’

“রাজমাতা দময়ন্তীর বাক্য-শ্রবণে পরম পরিতুষ্ট ও সম্মত হইয়া স্বীয় পুত্রের মতানুসারে মহতী সেনা-সমভিব্যাহারে বহুবিধ ভক্ষ্য, পানীয় ও পরিচ্ছদ-প্রদানপূর্ব্বক মনুষ্যবাহ্য যানে আরোহণ করাইয়া ভৈমীকে তদীয় পিতৃভবনে প্রেরণ করিলেন। দময়ন্তী অচিরকালমধ্যে বিদর্ভদেশে সমুপস্থিত হইলেন। তাঁহার বন্ধুগণ তাঁহাকে দেখিয়া পরমপরিতুষ্টচিত্তে তাঁহার যথােচিত সম্মান করিলেন। তখন ভীমতনয়া দময়ন্তী আপনার তনয়-তনয়া, মাতাপিতা ও সমস্ত সখীগণকে কুশলী দেখিয়া যথাবিধানে দেবতা ও ব্ৰাহ্মণগণকে পূজা করিতে লাগিলেন। ভীমনরপতি স্বীয় তনয়াসন্দর্শনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া সুদেবকে সহস্ৰসংখ্যক গো, গ্রাম ও প্রচুর-পরিমাণ ধন প্ৰদান করিলেন।

“দময়ন্তী পিতৃগৃহে সেই রাত্রি বিশ্রাম করিয়া স্বীয় জননীকে কহিতে লাগিলেন, “মাতঃ! যদি আপনি আমাকে জীবিত রাখিতে অভিলাষ করেন, তবে শীঘ্র নরবীর নলের আনয়নে সচেষ্ট হউন।” রাজ্ঞী দময়ন্তীর সেই বাক্যশ্রবণে অতিমাত্র দুঃখিত হইয়া কেবল রোদন করিতে লাগিলেন, কিছুই প্ৰত্যুত্তর প্রদান করিতে পারিলেন না। তাঁহার তাদৃশী অবস্থা অবলোকনে অন্তঃপুরস্থ সমস্ত যোষাগণ [নারীসমূহ] হাহাকারশব্দে ক্ৰন্দন করিতে লাগিলেন। তখন রাজ্ঞী মহারাজ ভীমের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, ‘মহারাজ! তোমার তনয়া দময়ন্তী স্বীয় ভর্ত্তার নিমিত্ত অনুশোচন করিতেছে। সেই বালা লজ্জা পরিত্যাগপূর্ব্বক আমাকে সমুদয় বৃত্তান্ত কহিয়াছে। অতএব তোমার কিঙ্করগণ শীঘ্র নলের অন্বেষণে গমন করুক।’

ভীম-নৃপতির নলান্বেষণে ব্ৰাহ্মণ নিয়োগ

“মহারাজ ভীম রাজ্ঞীর বচন শ্রবণে যৎপরোনাস্তি ব্যগ্র হইয়া নলের অন্বেষণ নিমিত্ত আপনার অধিকারস্থ ব্রাহ্মণগণকে চতুর্দ্দিকে গমন করিতে আদেশ করিলেন। ব্ৰাহ্মণগণ রাজনিয়োগশ্রবণানন্তর দময়ন্তীর নিকট গমনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘রাজপুত্র! আমরা নালান্বেষণে গমন করিতে প্ৰস্তুত হইয়াছি।’ তখন দময়ন্তী তাঁহাদিগকে কহিয়া দিলেন, “হে বিপ্ৰগণ! আপনারা সমুদয় রাজ্যে সকল সভামধ্যে পুনঃ পুনঃ এই কথা কহিবেন যে, “হে শঠ! ত্বদীয় প্রণয়িনী তোমাতে নিতান্ত অনুরক্ত, তুমি অরণ্যমধ্যে নিদ্রাবস্থায় তাহার বস্ত্ৰাৰ্দ্ধ ছেদনপূর্ব্বক তাহাকে একাকিনী পরিত্যাগ করিয়া কোথায় পলায়ন করিয়াছ? তুমি তাহাকে যাহা আদেশ করিয়াছিলে, সে তাঁহাই প্রতিপালনপূর্ব্বক তোমার প্রতীক্ষায় কালব্যাপন করিতেছে। সেই কামিনী অৰ্দ্ধবন্ত্র পরিধানপূর্ব্বক দিনযামিনী কেবল শোকসন্তপ্ত-চিত্তে রোদন করিতেছে; অতএব তুমি প্রসন্ন হইয়া তাঁহার বাক্যের প্রত্যুত্তর প্ৰদান কর।” হে ব্ৰাহ্মণগণ! আপনারা এই কথা এবং এইরূপ অন্য অন্য কথাও কহিবেন, তাহা হইলে আমার প্রতি তাঁহার অনুকম্পার উদয় হইতে পারে; যেহেতু, অনল সমীরণকর্ত্তৃক সমুত্তেজিত হইয়াই প্রবলবেগে অরণ্য দগ্ধ করে। আপনারা আরও কহিবেন যে, “পত্নীকে সতত রক্ষা ও প্রতিপালন করা পরিণেতার অবশ্য কর্ত্তব্য; তুমি ধর্ম্মজ্ঞ হইয়া কেন তাহার বিপরীতচরণ করিলে? তুমি সর্ব্বত্ৰবিশ্রুত, প্রাজ্ঞ, কুলীন ও সদয়চিত্ত হইয়াও এক্ষণে কেবল আমারই দুর্ভাগ্যবশতঃ দয়াশূন্য হইয়োছ; হে নাথ! আমার প্রতি সদয় হও; তুমি স্বয়ং আমাকে কহিয়াছ যে, অনৃশংসতা প্রধান ধর্ম্ম।” হে বিপ্ৰগণ! আপনাদিগের এই সমস্ত বাক্য শ্রবণ করিয়া যিনি কোন প্রত্যুত্তর প্রদান করিবেন, আপনারা তিনি কে, কোথায় থাকেন, সমৃদ্ধ কি নিধন, সমর্থ বা অসমৰ্থ এবং কি কর্ম্ম করেন, এই সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হইয়া এবং তাঁহার প্রত্যুত্তরবাক্য উত্তমরূপে স্মরণ করিয়া আমার নিকট আগমন করিয়া সমুদয় কহিবেন। হে বিপ্ৰগণ! আপনারা যে আমার নির্দেশক্রমে ঐ কথা কহিতেছেন, ইহা যেন অন্যে না বুঝিতে পারে এবং আপনারা সাবধানে অতি সত্বরে কাৰ্য্য সাধন করিয়া এ স্থানে প্রত্যাগমন করিবেন।”

“তখন ব্রাহ্মণগণ দময়ন্তীর বাক্য শ্রবণ করিয়া তদ্রূপ ব্যসনাপন্ন ভূপতি নলের অন্বেষণার্থ চতুর্দ্দিকে গমন করিলেন। তাঁহারা পুর, রাজ্য, গ্রাম, ঘোষ ও আশ্রম প্রভৃতি অনেকানেক প্রদেশে দময়ন্তীর এই বাক্য ঘোষণা করিয়া নলকে অন্বেষণ করিতে লাগিলেন, কিন্তু কুত্ৰাপি তাঁহার অনুসন্ধান প্রাপ্ত হইলেন না।