০৮০. তীর্থযাত্ৰাপর্ব্বাধ্যায়

৮০তম অধ্যায়

তীর্থযাত্ৰাপর্ব্বাধ্যায়

জনমেজয় বৈশম্পয়নকে জিজ্ঞাসা করিলেন, হে ভগবন! আমার প্রপিতামহ মহাবলপরাক্রান্ত অর্জ্জুন কাম্যকবন হইতে গমন করিলে পর অপর পাণ্ডবচতুষ্টয় তাঁহার বিরহে কি করিয়াছিলেন? যেমন বিষ্ণু দেবগণের প্রধান সহায়, তদুপ বিপক্ষপক্ষক্ষয়কারী মহাধনুৰ্দ্ধর অর্জ্জুন আমার মতে পাণ্ডবগণের একমাত্র গতি ছিলেন; সুতরাং মহাবীর পাণ্ডবগণ সেই শক্রসম শৌৰ্য্যশালী, সংগ্রামে অপ্রতিনিবৃত্ত, মহাতেজঃ ধনঞ্জয় বিনা কিরূপে বনে বাস করিয়াছিলেন?

অর্জ্জুনবিরহে পাণ্ডবপরিতাপ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! সত্যবিক্রম মহাতেজাঃ অর্জ্জুন কাম্যকবন হইতে গমন করিলে যুধিষ্ঠির প্রভৃতি ভ্ৰাতৃচতুষ্টয় শোক ও দুঃখে নিতান্ত অভিভূত হইয়া সাতিশয় অপ্ৰসন্ন-মনে সূত্ৰচ্যুত মণিসমূদয়ের ন্যায়, ছিন্নপক্ষ পক্ষিগণের ন্যায় হইয়া রহিলেন। এক্ষণে কাম্যাকবন অর্জ্জুনবিরহে কুবেরবিহীন চৈত্ররথকাননের ন্যায় শোভাবিহীন হইয়াছে। অর্জ্জুনবিহীন পাণ্ডবগণ অতি অপ্রশস্তমনে সেই কাম্যাকবনে বাস করিয়া ব্ৰাহ্মণগণের নিমিত্ত প্রতিদিন বিশুদ্ধ বাণদ্বারা বহুবিধ পবিত্র মৃগসমূহ সংহার করিয়া ও অন্যান্য প্রকার বন্য আহার আহরণপূর্ব্বক ব্ৰাহ্মণগণকে প্রদান করিতেন। অর্জ্জুনবিরহে সকলেই সাতিশয় উৎকণ্ঠিত ও অসন্তুষ্টচিত্তে তথায় বাস করিতে লাগিলেন। বিশেষতঃ পতিপরায়ণা পাঞ্চালী মহাবলপরাক্রান্ত মধ্যমপতিকে স্মরণ করিয়া একবারে অধীরার ন্যায় হইলেন।

একদা পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির অর্জ্জুনচিন্তায় একান্ত উদ্বিগ্নচিত্ত হইয়া আছেন, এমত সময়ে যজ্ঞসেনী তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিতে লাগিলেন, “হে মহারাজ! যে অর্জ্জুন দ্বিবাহু হইয়াও বহুবাহু কাৰ্ত্তবীৰ্য্য অর্জ্জুনের ন্যায় প্রতাপশালী, তাহার বিরহে এই বন আমার প্রীতিকর হইতেছে না। আমি এ প্রদেশ শূন্যপ্রায় দেখিতেছি। সেই কমললোচন, নীলাম্বুদশ্যামকলেবর সব্যসাচী ব্যতিরেকে এই বহুবিধ আশ্চৰ্য্য বস্তু ও কুসুমিত-দ্রুমসমূদয়ে পরিপূর্ণ কাম্যাকবনের আর সেরূপ রমণীয়তা নাই। যে মহাবল পরাক্রান্ত মহেন্দ্ৰনন্দনের শরাসনধ্বনি অশনিনির্ঘোষের ন্যায় অনবরত কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইত, সেই সব্যসাচী ধনঞ্জয়কে স্মরণ করিয়া আমি এক মুহুর্তের নিমিত্তও সুখানুভব করিতে সমর্থ হইতেছি না।”

অরাতিকুলনিসূদন ভীমপরাক্রম ভীমসেন দ্রৌপদীর এইরূপ বিলাপ-বাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে কহিতে লাগিলেন, “হে নিতস্বিনি! তুমি যাহা কহিলে, তাহা আমার মনের নিতান্ত প্রীতিকর, উহা আমার হৃদয়ে যেন অমৃত বর্ষণ করিল। দেখ, যে মহাবীরের পঞ্চশীর্ষ ভুজগদ্বয়ের ন্যায়, পরিঘযুগের ন্যায় সুদীর্ঘ পীন ভুজযুগল মৌর্বীঘর্ষণজনিত কিণে অঙ্কিত, খড়গ, আয়ুধ ও শরাসনে সুশোভিত এবং নিষ্ক, অঙ্গদ প্রভৃতি অলঙ্কারে নিরন্তর অলঙ্কৃত থাকে, সেই ধনঞ্জয় বিনা এই কাম্যকবন সূৰ্য্যবিহীন অন্তরীক্ষের ন্যায় শোভাশূন্য হইয়াছে। পাঞ্চল ও কুরুবংশীয়গণ যে মহাবীরকে আশ্রয় করিয়া সুরসৈন্যসমূহের সহিতও সংগ্রাম করিতে সন্ত্রস্ত হয় না এবং যাহার বাহুবলমাত্র অবলম্বন করিয়া আমরা যুদ্ধে শক্রগণকে পরাজিত ও সমুদয় মেদিনীমণ্ডল পুনঃপ্রাপ্ত বোধ করি, সেই অর্জ্জুনবিরহে আমি এই কাম্যাকবনে ক্ষণকালের নিমিত্তও সুখী হইতেছি না এবং চতুর্দ্দিক শূন্য ও তিমিরাচ্ছন্নের ন্যায় নিরীক্ষণ করিতেছি।”

তখন পাণ্ডুনন্দন নকুল বাষ্পগদগদম্বরে কহিতে লাগিলেন, “দেবগণও সমরাঙ্গনে যাঁহার দিব্যকর্ম্মের প্রশংসা করিয়া থাকেন, যিনি রাজসূয়-যজ্ঞের উত্তদিকে গমনপূর্ব্বক মহাবলপরাক্রান্ত শত শত গন্ধর্ব্বদণকে যুদ্ধে পরাজয় করিয়া তিত্তির পক্ষীর ন্যায় চিত্রবিচিত্র, সমীরণের ন্যায় শীঘ্রগামী অশ্বসকল আনয়ন করিয়া প্রীতি-প্রসন্নমনে জ্যেষ্ঠভ্রাতা মহারাজ ধর্ম্মরাজকে প্রদান করিয়াছিলেন সেই ভীমধন্বা ভীমানুজ ব্যতিরেকে এক্ষণে ক্ষণকালও এই কাম্যাকবনে বাস করিতে আমার অভিলাষ নাই।”

তখন সহদেব ধর্ম্মরাজকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে রাজন। যে মহারথ অর্জ্জুন মহাক্ৰতু রাজসূয়-যজ্ঞের সময় সংগ্রামে জয়লাভপূর্ব্বক বহুবিধ ধন ও কন্যাগণ আনয়ন করিয়াছিলেন, যিনি একাকী সংগ্রামে বহুসংখ্যক যাদবগণকে পরাজয় করিয়া বাসুদেবের সম্মতিক্রমে সুভদ্রাকে হরণ করিয়াছিলেন, আজি গৃহমধ্যে সেই জিষ্ণুর আসন শূন্য দেখিয়া আমার মন কোনমতেই শান্ত হইতেছে না। মহাবীর অর্জ্জুন ব্যতিরেকে এই বনের রমণীয়তা একেবারে তিরোহিত হইয়াছে। আমার মতে এই বন হইতে অন্যত্র গমন করাই শ্ৰেয়ঃ।”