০৯৭. অগস্ত্যের লোপামুদ্রার পাণিগ্রহণ

৯৭তম অধ্যায়

অগস্ত্যের লোপামুদ্রার পাণিগ্রহণ

লোমশ কহিলেন, “মহারাজ! মহর্ষি অগস্ত্য লোপামুদ্রাকে গাৰ্হস্থ্যব্যাপারে দক্ষ দেখিয়া বৈদর্ভসন্নিধানে কহিলেন, “মহারাজ! আমি পুত্রার্থে দারপরিগ্রহ করার মানস করিয়াছি; এই নিমিত্ত আপনার নিকট প্রার্থনা করিতেছি, আপনি আমাকে স্বীয় কন্যা সম্প্রদান করুন।” মহারাজ বৈদর্ভ এই কথা শুনিবা মাত্র বিচেতন্যপ্রায় হইয়া রহিলেন, কিন্তু তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান বা লোপামুদ্রাদান উভয় বিষয়েই নিতান্ত অসম্মত হইলেন। অনন্তর তিনি অন্তঃপুরে গমন করিয়া মহিষীর নিকট এই বৃত্তান্ত বিজ্ঞাপনপূর্ব্বক কহিলেন, “প্রিয়ে! মহর্ষি অগস্ত্য সাতিশয় উগ্ৰস্বভাবসম্পন্ন; তিনি ক্রুদ্ধ হইলে শাপানলে আমাকে ভস্মসাৎ করিবেন, সন্দেহ নাই।” তখন লোপামুদ্রা জনক ও জননীকে নিতান্ত দুঃখিত নিরীক্ষণ করিয়া অবসরক্রমে পিতৃসন্নিধানে উপনীত হইয়া কহিলেন, “হে পিতঃ! আপনি আমার নিমিত্ত কোনক্রমেই উদ্বিগ্ন হইবেন না, আমাকে অগস্ত্যহস্তে সমর্পণ করিয়া আপনি নিরাপদ হউন।”

“অনন্তর রাজা মহাত্মা অগস্তাকে বিধিপূর্ব্বক কন্যাসম্প্রদান করিলে অগস্ত্য লোপামুদ্রাকে ভাৰ্য্যাত্বে প্রতিগ্ৰহ করিয়া কহিলেন, “প্রিয়ে! তুমি এক্ষণে মহার্হ আভরণ ও বিচিত্ৰ সূক্ষ্মবাসন পরিত্যাগ কর।” লোপামুদ্রা ভর্ত্তৃনিদেশানুসারে তৎক্ষণাৎ মহামূল্য বসনভূষণ পরিত্যাগপূর্ব্বক চীরবল্কল ও অজিন পরিধান করিয়া স্বামীর সমান-ব্ৰতচারিণী হইলেন। অনন্তর ভগবান অগস্ত্য গঙ্গাদ্বার-তীর্থে উপস্থিত হইয়া পতিপরায়ণা সহধর্ম্মিণীর সহিত অতি কঠোর তপস্যা আরম্ভ করিলেন। লোপামুদ্রা প্রীতমনে বহুমানপূর্ব্বক পতির পরিচর্য্যা করিতে লাগিলেন; মহর্ষিও পত্নীর প্রতি যথোচিত প্রীতি ও প্রণয়ানুগত হইলেন।

“এইরূপে কিয়ৎকাল অতীত হইলে ভগবান অগস্ত্য তপঃপ্রভাবসম্পন্না লোপামুদ্রাকে ঋতুস্নাতা দেখিয়া এবং তদীয় পরিচর্য্যা, দম, শৌচ ও সৌন্দৰ্য্যে নিতান্ত প্রীত ও একান্ত আকৃষ্ট হইয়া সহযোগবাসনায় আহ্বান করিলেন। তখন লোপামুদ্রা লজ্জাবনতমুখী হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে প্রণয়সম্ভাষণপূর্ব্বক তাঁহাকে কহিলেন, “হে তপোধন! আপনি অপত্যলাভের নিমিত্তই আমার পাণিপীড়ন করিয়াছেন। আপনার প্রতি আমার যেরূপ প্রীতি আছে, আপনি এক্ষণে তদনুযায়ী ব্যবহার করিতে পারেন; কিন্তু আমার পিতৃগৃহে প্রাসাদে যাদৃশ শয্যা প্রস্তুত থাকিত, এই স্থলেও তদুপ শয্যায় শয়ন করিতে ইচ্ছা করি; আপনিও মাল্য ও বসনভূষণ পরিধান করুন। আমি অভিলাষানুরূপ দিব্য-অলঙ্কারে অলঙ্কৃত হইয়া আপনার নিকট গমন করিব; অন্যথা আমি চীরকাষায়-বসন পরিধানপূর্ব্বক এ স্থানে উপস্থিত হইতে পারিব না। তপস্বিগণের কাষায়-বসন প্রভৃতি পবিত্ৰ ভূষণ-সামগ্ৰী-সকল কদাচি দূষিত করা কর্ত্তব্য নহে।” অগস্ত্য কহিলেন, “প্রিয়ে! তোমার পিতার যেরূপ প্রচুর ধনসম্পত্তি আছে, আমাদিগের সেরূপ সম্পত্তি নাই।” লোপামুদ্রা কহিলেন, “হে তপোধন! এই জীবলোকে যে-কিছু ধন বিদ্যমান আছে, আপনি তপঃপ্রভাবে ক্ষণকালমধ্যেই তৎসমুদয় আহরণ করিতে পারেন।” অগস্ত্য কহিলেন, “হে কমললোচনে! তুমি যেরূপ কহিলে, তাহা কোনমতেই অমূলক নহে; কিন্তু অর্থ আহরণ করিতে হইলে তপঃক্ষয় হইবে; অতএব যাহাতে তপঃক্ষয় না হয়, এইরূপ উপদেশ প্রদান কর।” লোপামুদ্রা কহিলেন, “হে তপোধন! আমার ঋতুকাল অল্পমাত্ৰাবশিষ্ট আছে, উহা অতীত হইলে আপনার সহিত সহবাস করিব না, এবং যে কর্ম্মে আপনার ধর্ম্ম লুপ্ত হয়, তাহাও আমার উদ্দেশ্য নহে। এক্ষণে আপনার যেরূপ অভিরুচি হয় করুন।” অগস্ত্য কহিলেন, “হে সুভগে! যদি তোমার অন্তঃকরণে এইরূপ অভিলাষ জন্মিয়া থাকে, তাহা হইলে আমি অর্থহরণ করিতে প্ৰস্থান করিলাম; তুমি এই স্থানে অবস্থিতি করিয়া অভিলাষানুসারে কালযাপন কর।”