০৭৩. ঋতুপর্ণরাজের বিদর্ভপুরে প্রবেশ

৭৩তম অধ্যায়

ঋতুপর্ণরাজের বিদর্ভপুরে প্রবেশ

“অনন্তর ঋতুপর্ণরাজ সয়ংকালে বিদর্ভনগরীতে উত্তীর্ণ হইলে দূতের ভীম-রাজের সন্নিধানে তাঁহার উপস্থিতিসংবাদ নিবেদন করিল। ভীম নরপতি পরম-সমাদরে তাঁহাকে আনয়ন করিতে আদেশ প্রদান করিলে তিনি তখন রথনির্ঘোষে দিঙ্মণ্ডল প্রতিধ্বনিত করিয়া কুণ্ডিনপুরে প্রবেশ করিলেন। পূর্ব্বে নৈষধের অশ্বগণ তাঁহার সমাগমে যেরূপ হর্ষপ্ৰকাশ করিত, এক্ষণে তদীয় সেইরূপ রথনির্ঘোষ শ্রবণ করিয়া হর্ষপ্ৰকাশ করিতে লাগিল। দময়ন্তী জলদকালীন গভীর মেঘগর্জ্জনতুল্য রথনির্ঘোষ শ্রবণ করিয়া চিন্তা করিলেন, ‘পূর্ব্বে অশ্বগণ নলরাজকর্ত্তৃক সংগৃহীত হইয়া রথে যোজিত হইলে যেরূপ রথনির্ঘোষ হইত, ইহাও তদ্রূপ বোধ হইতেছে।” অনন্তর প্রাসাদস্থ ময়ুর, মাতঙ্গ ও তুরঙ্গমগণ সেই গভীর রথঘোষ শ্রবণপূর্ব্বক উন্মুখ ও উৎসুক হইয়া আনন্দনাদ করিতে লাগিল।

রথশব্দে দময়ন্তীর নলাগমন অনুমান

“এই অবসরে দময়ন্তী কহিলেন, “এই রথনিৰ্ঘোষ ভূমণ্ডল পরিপূর্ণ করিয়া যেন আমাকে আহ্লাদিত করিতেছে, ইহাতে নিশ্চয় বোধ হইতেছে, মহাত্মা নল নরপতি আসিয়া থাকিবেন। আমি আজ যদি সেই অসংখ্য-গুণধর বীরবর। নলরাজের নির্ম্মল মুখচন্দ্র নিরীক্ষণ করিতে না পারি, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আত্মঘাতী হইব। আমি যদি তাহার সেই সুখস্পর্শ ভুজযুগলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে না পারি, তাহা হইলে নিশ্চয়ই প্ৰাণবিসর্জ্জন করিব। যদি সেই গভীরস্বর নিষধাধিপতি নল আমাকে সম্ভাষণ না করেন, তাহা হইলে আমি অবশ্যই আত্মহত্যাপাপে লিপ্ত হইব। যদি মত্তকুঞ্জার-বিক্রান্ত নলরাজ আমার সন্নিধানে সমাগত না হয়েন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই প্ৰজ্বলিত হুতাশনে প্রবেশ করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই। আমি তাঁহার নিকট কখনই মিথ্যা কহি নাই, কখন তাঁহার অপকার বা স্বেচ্ছাক্রমে প্রতিকূল বাক্যপ্রয়োগ করি নাই। তিনি প্ৰভু, ক্ষমাশীল, বীর, বদান্য ও পরস্ত্রীপরাঙ্মুখ। এক্ষণে আমি তদেকান্ত-চিত্ত হইয়া নিরবচ্ছিন্ন তাহারই গুণচিন্তা করিতেছি। প্রিয়বিচ্ছেদজনিত শোক আমার হৃদয় বিদীর্ণ করিতেছে।”

“দময়ন্তী বিনষ্টসংজ্ঞা-প্ৰায় হইয়া বারংবার এইরূপ বিলাপ ও পরিতাপ করিয়া পরিশেষে প্ৰিয়দৰ্শন-মানসে প্রাসাদে আরোহণ করিবামাত্ৰ বার্ষ্ণেয় ও বাহুক-সমভিব্যাহারী অযোধ্যাধিপতি মহারাজ ঋতুপর্ণকে রাজভবনের মধ্যম কক্ষায় নিরীক্ষণ করিলেন।

‘অনন্তর বার্ষ্ণেয় ও বাহুক রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া অশ্বগণকে উন্মোচনপূর্ব্বক একান্তে রথ স্থাপন করিলে অযোধ্যাধিপতি ঋতুপর্ণ রথগর্ভ হইতে অবতীর্ণ হইয়া ভীমপরাক্রম ভীমের নিকট উপস্থিত হইলেন। ভীম সমুচিত সৎকারদ্বারা তাহাকে প্রতিগ্ৰহ করিলে, ঋতুপর্ণও তৎকৃত পূজাগ্রহণপূর্ব্বক বিচিত্র আসনে উপবেশন করিলেন, কিন্তু বারংবার অনুসন্ধান করিয়াও স্বয়ংবরের কোন উদযোগ দেখিতে পাইলেন না। ফলতঃ দময়ন্তী জননী-সমভিব্যাহারে নির্জ্জনে পরামর্শ করিয়া ভীমের অগোচরে যে দূত প্রেরণ করিয়াছিলেন, তৎকালে তিনি ইহার বিন্দুবিসর্গও অনুধাবন করিতে পারেন নাই।

স্বয়ংবরসংবাদাকৃষ্ট ঋতুপর্ণের অপ্রতিভতা

“এদিকে বিদৰ্ভাধিপতি ভীমও তদীয় অভিসন্ধি বোধ করিতে না পারিয়া স্বাগত-প্রশ্নপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ! আপনি কি নিমিত্ত আগমন করিয়াছেন? রাজা ঋতুপর্ণ, এক্ষণে কি প্রত্যুত্তর দিব, চিন্তা করিলেন, ইনি ত’ স্বয়ংবরের কোন কথারই উল্লেখ করিলেন না। আমিও রাজা এবং রাজপুত্ৰদিগকে এস্থানে আগমন করিতে দেখিতেছি না; ব্রাহ্মণগণের সমাগম নাই, এক্ষণে কি বলি? মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিয়া কহিলেন, ‘মহারাজ! আমি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি।” এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র ভীম-নরপতি বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া চিন্তা করিলেন, ‘ইনি শতাধিক যোজন পথ অতিক্রম করিয়া কি কারণে আগমন করিয়াছেন? অনেকানেক রাজ্য ও বহুসংখ্যক গ্রাম নগর উল্লঙ্ঘন করিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন, ইহা নিতান্ত অসম্ভব। ফলতঃ আগমনকারণেরও অতি সামান্য কাৰ্য্যই নির্দেশ করিলেন; কিন্তু ইহার যাথার্থ্যপক্ষে আমার বিলক্ষণ সংশয় জন্মিতেছে; যাহা হউক, পশ্চাৎ ইহার কারণ অবগত হওয়া যাইবে।”

“ভীম-নরপতি মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিয়া কহিলেন, “মহাশয়! আপনি সাতিশয় পরিশ্রান্ত হইয়াছেন, এক্ষণে বিশ্রাম করুন।’ এই বলিয়া তাঁহাকে সমুচিত সৎকারপূর্ব্বক বিদায় করিলেন। ঋতুপর্ণ সৎকৃত ও রাজভৃত্যবর্গে অনুগত হইয়া প্রীত ও প্ৰসন্নমনে তন্নির্দ্দিষ্ট ভবনে প্রবেশ করিলেন। তখন বার্ষ্ণেয় ও রাজা ঋতুপর্ণ ইঁহারা সকলে গমন করিলে, রথবাহক বাহুক রথ লইয়া, রথশালায় প্রবিষ্ট হইলেন। তথায় অশ্বদিগের যথাবিধি পরিচর্য্যা করিয়া স্বয়ং রথগর্ভে উপবেশনপূর্ব্বক বিশ্রাম করিতে লাগিলেন।

“এদিকে দময়ন্তী ঋতুপর্ণ-নৃপতি, সূতপুত্ৰ বার্ষ্ণেয় ও বিরূপ বাহুককে সন্দর্শন করিয়া শোকাকুলিতচিত্তে চিন্তা করিতে লাগিলেন, ‘পূর্ব্বে নালরাজের এইরূপ রথশব্দ শ্রবণ করিতাম, কিন্তু এক্ষণে নলকে অবলোকন করিতেছি না, তবে এ কাহার রথশব্দ? বোধ হয়, বার্ষ্ণেয় অশ্ববিজ্ঞানবিদ্যা শিক্ষা করিয়াছে, সেহেতু নলরাজের রথের ন্যায় এই রথেরও গভীর শব্দ হইতেছিল; অথবা অযোধ্যাধিপতি ঋতুপর্ণই নলরাজের তুল্য; সেই নিমিত্ত তাঁহার রথের ন্যায় এই রথেরও গভীর শব্দ সমুত্থিত হইতেছিল।” দময়ন্তী মনে মনে এইরূপ নানাপ্রকার তর্ক-বিতর্ক করিয়া নলরাজের অন্বেষণার্থ এক দূতীকে প্রেরণ করিলেন।”