০৭২. বাহুক বেশী নলের সংখ্যাবিদ্যালাভ

৭২তম অধ্যায়

বাহুক বেশী নলের সংখ্যাবিদ্যালাভ

বৃহদশ্ব কহিলেন, “মহারাজ! বাহুক গগনচারীর ন্যায় অনতিকালমধ্যে নদ, নদী, বন, পর্ব্বত ও সরোবর সমস্ত অতিক্রম করিয়া মহাবেগে আকাশমার্গে গমন করিতেছেন, এই অবসরে ঋতুপর্ণরাজের উত্তরীয়বস্ত্ৰ অঙ্গ হইতে স্বলিত ও অধঃপ্রদেশে নিপতিত হইল। তিনি তৎক্ষণাৎ তাহা গ্ৰহণ করিবার নিমিত্ত বাহুককে কহিলেন, “হে বাহুক! তুমি অশ্বের রশ্মি সংযত কর, আমার উত্তরীয়-বসন স্খলিত হইয়াছে; বার্ষ্ণেয় গিয়া উহা আনয়ন করিবে।” বাহুক কহিলেন, “হে মহারাজ! আপনার উত্তরীয়বস্ত্ৰ অঙ্গচ্যুত হইয়া এক যোজন [চারি ক্রোশ] অন্তরে নিপতিত হইয়াছে, এক্ষণে উহা আহরণ করা নিতান্ত সুকঠিন।”

“অনন্তর ঋতুপর্ণ-রাজ ফলপল্লবোপশোভিত এক বিভীতক বৃক্ষ [বয়ড়াগাছ] নিরীক্ষণ করিয়া শশব্যস্ত-চিত্তে বাহুককে কহিলেন, ‘হে বাহুক! গণনাবিষয়ে আমার উৎকৃষ্ট বল অবলোকন কর। সকলে সকল বিষয়ে পারদর্শী হইতে পারে না, এই সংসারে কাহারও সর্ব্বজ্ঞতা নাই; এক পুরুষে জ্ঞানের সম্যক সমাবেশ থাকা নিতান্ত অসম্ভব। এই বিভীতক-বৃক্ষে যে-সকল ফল ও পত্র বিদ্যমান রহিয়াছে এবং যাহা নিপতিত হইয়াছে, তন্মধ্যে একশত এক পত্ৰ ও একশত এক ফল ভূতলে পতিত রহিয়াছে; আর দুই শাখাতে পঞ্চকোটি পত্ৰ আছে। ঐ শাখাদ্বয় ও অন্যান্য প্রশাখা অনুসন্ধান কর, তাহাতেই দুই সহস্ৰ পঞ্চোনশত [পঁচানব্বই] ফল আছে দেখিতে পাইবে।”

“তখন বাহুক রথবেগ নিবারণপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! আপনি যেমন পরোক্ষ-বিষয়ে শ্লাঘা করিতেছেন, আমি এইক্ষণেই বৃক্ষচ্ছেদনপূর্ব্বক উহার ফল ও পত্র-সমুদয় গণনা করিলে তদ্বিষয়ে আর পরোক্ষতা থাকিবে না। আমি আপনার সমক্ষেই এই বৃক্ষ ছেদন করিব। আপনি ফল ও পত্রের যে-সংখ্যা নির্ণয় করিয়াছেন, তদ্বিষয়ে আমার সম্পূর্ণ সংশয় জন্মিয়াছে; এক্ষণে আপনার সম্মুখেই উহা গণনা করিয়া দেখিব। বার্ষ্ণেয় সারথি মুহুর্ত্তকালের নিমিত্ত অশ্বের রশ্মি গ্রহণ করুক।” ঋতুপর্ণ-রাজ কহিলেন, “হে বাহুক! এক্ষণে বিলম্বের আর অবসর নাই, সত্বরে বিদর্ভদেশে যাইতে হইবে।” বাহুক অতি যত্নপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! আপনি ক্ষণকাল প্রতীক্ষা করুন অথবা যদি নিতান্তই ব্যস্ত হইয়া থাকেন, তবে বার্ষ্ণেয় এই কল্যাণকর পথ অবলম্বন করিয়া আপনাকে বিদর্ভদেশে লইয়া যাউক।” রাজা কহিলেন, “হে বাহুক! তুমিই সারথি, এই পৃথিবীতে তোমা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট সারথি আর নাই। ফলতঃ তুমি সারথ্য-কর্ম্ম স্বীকার করিয়াছ বলিয়াই আমি বিদর্ভ-নগরীতে গমন করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছি। এক্ষণে আমি তোমার শরণাপন্ন হইলাম, তুমি আর প্রতিবন্ধকতাচরণ করিও না। যদি বিদর্ভদেশে উপস্থিত হইয়া আমাকে সূর্য্যোদয়দর্শন করাইতে পার, তাহা হইলে আমি তোমার সকল বাসনাই সম্পূর্ণ করিব।”

“বাহুক কহিলেন, “মহারাজ! আমি বৃক্ষের ফলপত্র সংখ্যা না করিয়া বিদৰ্ভদেশে গমন করিব না, আপনাকে আমার এই কথাটি রক্ষা করিতে হইবে।” তখন নৃপতি অনিচ্ছাপূর্ব্বক বাহুককে কহিলেন, “হে বাহুক! মৎসমাদিষ্ট শাখার একদেশমাত্র গণনা কর, তাহাতেই তুমি সম্পূর্ণ প্রীতিলাভ করিতে পরিবে।” রাজার আদেশনানুসারে বাহুক সত্বরে রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া বিভীতক-বৃক্ষচ্ছেদনপূর্ব্বক নৃপতিনির্দ্দিষ্ট ফল-পত্ৰ সংখ্যা করিয়া বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে কহিলেন, “মহারাজ! আমি এক্ষণে আপনার এই লোকাতীত ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করিলাম। আপনি যে বিদ্যাপ্রভাবে উহা জানিতে পারিয়াছেন, আমি তাহা শ্রবণ করিতে একান্ত অভিলাষযুক্ত হইয়াছি, অনুগ্রহ করিয়া বর্ণন করুন।” তখন দ্রুতগমনোৎসুক মহারাজ ঋতুপর্ণ কহিলেন, “হে বাহুক! আমি গণনাবিশারদ ও অক্ষহৃদয়জ্ঞ।” বাহুক কহিলেন, “মহারাজ! আপনি আমা হইতে অশ্ববিজ্ঞানবিদ্যা গ্রহণপূর্ব্বক তাহার বিনিময়স্বরূপ সংখ্যান-বিদ্যা প্ৰদান করুন।” রাজা ঋতুপর্ণ কাৰ্য্যগৌরব ও অশ্ববিজ্ঞান-বিদ্যালাভ-লোভে বাহুককে কহিলেন, ‘হে বাহুক! তুমি আমা হইতে এই বিদ্যা গ্রহণ কর, আমার অশ্ববিদ্যা এক্ষণে তোমাতেই নিক্ষিপ্ত থাকুক।’ এই বলিয়া বাহুককে সেই বিদ্যা প্ৰদান করিলেন।

অক্ষাবিদ্যাপ্রভাবে কলির নলদেহ হইতে নিষ্ক্রমণ

“সেই অক্ষবিদ্যাপ্রভাবে দেহান্তর্গত কলি অনবরত কর্কোটিক-বিষ উদগার করিয়া নিষ্ক্রান্ত হইল ও তৎক্ষণাৎ দময়ন্তীর শাপ হইতে মুক্ত হইয়া পরিশেষে পুনর্ব্বার পূর্ব্বকার প্রাপ্ত হইল। নলরাজ অতি দীর্ঘকাল কলিকর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া আত্মজ্ঞানশূন্য ও অচৈতন্যপ্ৰায় হইয়াছিলেন, এক্ষণে কলিকে সম্মুখে দেখিয়া রোষকষায়িতলোচনে শাপপ্রদানে উদ্যত হইলেন। কলি শঙ্কিত হইয়া কম্পিত্যকলেবরে ও কৃতাঞ্জলিপুটে নলরাজকে কহিল, ‘মহারাজ! ক্ৰোধ সংবরণ করুন, আমি আপনার এক মহীয়সী। কীর্ত্তি সংস্থাপন করিব। পূর্ব্বে যখন আপনি দময়ন্তীকে অরণ্যমধ্যে অকারণে পরিত্যাগ করেন, তৎকালে তিনি ক্রোধাবিষ্ট হইয়া আমাকে অভিশাপ প্ৰদান করেন, তদবধিই আমি একান্ত দুঃখিত ও ভুজঙ্গবিষে জর্জ্জরিত হইয়া আপনার দেহাভ্যন্তরে অধিবাস করিতেছিলাম। হে মহারাজ! এক্ষণে আমি আপনার শরণাপন্ন হইতেছি। যদি শরণাগত ও ভয়ার্ত্তকে অভিসম্পাত না করেন, তাহা হইলে এই জগতীতলে যে-সকল মনুষ্য আপনার নামকীর্ত্তন করিবে, তদবধি তাহাদিগের প্রতি আর আমার অধিকার থাকিবে না।” নলরাজ এইরূপ অভিহিত হইয়া ক্ৰোধ সংবরণ করিলেন। অনন্তর কলি নলের সহিত কথোপকথন করিতে করিতে অতিশয় ভীত ও অন্যকর্ত্তৃক অলক্ষিত হইয়া তৎক্ষণাৎ সেই বিভীতক-বৃক্ষে প্রবিষ্ট হইল। বিভীতক-তরু কলির আবেশ-প্রভাবে অপ্রশস্ত হইয়া গেল।

“অনন্তর কলিনির্মুক্ত ও বিগতজ্বর নল-মহারাজ বৃক্ষের ফল সংখ্যা করিয়া অলৌকিক তেজ ও মহতী প্রীতিলাভ করিয়া রথারোহণপূর্ব্বক বিদৰ্ভভিমুখে অশ্বগণকে বায়ুবেগে চালনা করিতে লাগিলেন। নল-নরপতি দৃষ্টির বহির্ভূত হইলে কলিও স্বস্থানে প্রস্থান করিল। নল কলিকর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া গতক্লেশ ও সুস্থকায় হইলেন, কিন্তু তাহার রূপ তদ্রূপই রহিল।”