০৯৬. অগস্ত্যতীৰ্থ-ইল্বল-বাতাপি উপাখ্যান

৯৬তম অধ্যায়

অগস্ত্যতীৰ্থ-ইল্বল-বাতাপি উপাখ্যান

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! অনন্তর কুন্তীনন্দন রাজা যুধিষ্ঠির দুর্জ্জয়া-তীর্থে উপস্থিত হইয়া অগস্ত্যাশ্রমে বাস করিলেন। তথায় মহর্ষি লোমশকে জিজ্ঞাসিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! এই স্থলে মহর্ষি অগস্ত্য কি কারণে বাতাপি দানবকে জীর্ণ করিয়াছিলেন। আর ঐ মানবান্তক দৈত্য কিরূপ প্রভাবসম্পন্ন ছিল এবং কি কারণেই বা তখন মহামুনি অগস্ত্যের ক্রোধানল সন্ধুক্ষিত [প্রজ্বলিত] হইয়াছিল, আপনি আনুপূর্ব্বিক এই সমস্ত বিষয় কীর্ত্তন করুন।”

লোমশ কহিলেন, “মহারাজ! পূর্ব্বকালে মণিমতী পুরীতে ইল্বলনামে এক দৈত্য বাস করিত, তাহার অনুজের নাম বাতাপি। একদা ইল্বল তপঃপ্রভাবসম্পন্ন এক ব্ৰাহ্মণকে কহিল, ভগবান! আমাকে দেবরাজতুল্য এক পুত্ৰ প্ৰদান করুন।” ব্ৰাহ্মণ তদীয় অভিলষিত-সংসাধনে অসম্মত হইলে ইল্বল তখন ক্ৰোধে একান্ত অধীর হইয়া উঠিল, তদবধি জাতক্ৰোধ হইয়া স্বীয় অনুজবাতাপিকে ছাগরূপী করিয়া তাহার মাংস পাক করিয়া আগন্তুক ব্রাহ্মণের জীবন-সংহারার্থ তাঁহাকে উপযোগ [আহার] করিতে প্রদান করিত। যেহেতু, ইল্বলের বিশেষ ক্ষমতা ছিল যে, সে মৃত প্রাণীকে আহ্বান করিলে সে তৎক্ষণাৎ তাহার নিকট উপস্থিত হইত।

“অনন্তর ইল্বল ছাগরূপী বাতাপিকে সুসংস্কৃত করিয়া ঐ ব্ৰাহ্মণকে ভোজন করিতে প্ৰদান করিল। ব্ৰাহ্মণ আহারান্তে বিশ্রাম করিতেছেন, এই অবসরে ইল্বল তারস্বরে বাতাপিকে আহ্বান করাতে সে সত্বরে ব্রাহ্মণের পাশ্বদেশ বিদীর্ণ করিয়া সহাস্য-আস্যে নিষ্ক্রান্ত হইল। এইরূপে ইল্বল আগন্তুক ব্রাহ্মণগণকে ছাগমাংস ভোজন করাইয়া সংহার করিত।

অগস্ত্যের প্রতি তদীয় পিতৃগণের আদেশ

“এই সময়ে ভগবান অগস্ত্য এক গর্তে অধোমুখ লম্বমান পিতৃগণকে সন্দর্শন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনারা কি কারণে অধোমুখে গর্তে লম্বমান হইয়া রহিয়াছেন?” তাহারা কম্পিত্যকলেবরে কহিলেন, “বৎস! আমরা সন্তানার্থ এই গর্তে লম্বমান হইয়া রহিয়াছি, আমরা তোমারই পূর্ব্বপুরুষ; এক্ষণে কেবল ত্বদীয় সন্তানের নিমিত্ত এইরূপ দুর্ব্বিসহ দুঃখভোগ করিতেছি। যদি তুমি সন্তান উৎপাদন কর তাহা হইলে আমরা এই ঘোরতর নরক-যন্ত্রণা হইতে মুক্ত হইব এবং তুমিও চরমে পরম-গতি প্ৰাপ্ত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।” সত্যপরায়ণ মুনিবার অগস্ত্য কহিলেন, “হে পিতৃগণ! আমি আপনাদিগের এই মনোরথ পূর্ণ করিব; এক্ষণে আপনারা এই উৎকণ্ঠা পরিত্যাগ করুন।”

লোপামুদ্রা-উপাখ্যান

“অনন্তর ভগবান অগস্ত্য স্বীয় সন্তানপরম্পরা বিস্তার করিবার নিমিত্ত চিন্তা করিতে লাগিলেন, কিন্তু কুত্ৰাপি যোগ্যা ও ঈদৃশী ভাৰ্য্যা প্রাপ্ত হইলেন না। পরে যে সমস্ত প্রাণীর যে যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অতিশয় উৎকৃষ্ট, তিনি সেই সকল সংগ্ৰহ করিয়া তদনুরূপ অপূর্ব্ব একটি স্ত্রীরত্ন নির্ম্মাণ করিয়া পুত্রের নিমিত্ত দুরূহ তপস্যায় প্রবৃত্ত বিদৰ্ভরাজকে আত্মার্থে নির্ম্মিতা সেই কন্যা প্ৰদান করিলেন। সৌদামিনীর ন্যায় রূপলাবণ্যসম্পন্না সেই কন্যা বিদৰ্ভরাজগৃহে জন্মপরিগ্রহ করিলেন। অনন্তর মহীপাল বিদৰ্ভ কন্যা ভূমিষ্ঠ হইবামাত্র হর্ষভরে ব্রাহ্মণগণকে নিবেদন করিলে ব্রাহ্মণের তৎক্ষণাৎ কন্যাকে অভিনন্দনপূর্ব্বক তাঁহার নাম লোপামুদ্রা রাখিলেন। সুরূপা লোপামুদ্রা কমলিনীর ন্যায়, হুতাশনশিখার ন্যায় দিনে দিনে পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিলেন।

“তিনি ক্রমে ক্ৰমে যৌবনসীমায় পদার্পণ করিলে একশত অলঙ্কৃতা কন্যা ও একশত অভিলাষানুরূপ কিঙ্করী তাঁহার পরিচর্য্যায় নিযুক্ত হইল। লোপামুদ্রা দাসীশত-পরিবৃতা ও কন্যাগণমধ্যবর্ত্তিনী হইয়া তেজস্বিনী রোহিণীর ন্যায় বিরাজমান হইলে মহাত্মা অগস্ত্যের ভয়ে ভীত ও শঙ্কিত হইয়া কেহই ঐ রূপলাবণ্যবতী যুবতীকে প্রার্থনা করিল না। তখন বিদর্ভরাজ কন্যাকে যৌবনসম্পন্ন দেখিয়া ‘কাহাকে সম্প্রদান করিব’, মনে মনে এই চিন্তা করিতে লাগিলেন। লোকাতিগ-রূপসম্পন্না, সত্যপরায়ণা লোপামুদ্রার বিশুদ্ধ ব্যবহারে পিতা ও অন্যান্য স্বজনবর্গ সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন।”