০৭৬. স্বয়ং পরীক্ষার্থ বাহুককে দময়ন্তী সমীপে প্রেরণ

৭৬তম অধ্যায়

স্বয়ং পরীক্ষার্থ বাহুককে দময়ন্তী সমীপে প্রেরণ

বৃহদশ্ব কহিলেন, “মহারাজ! কেশিনী পুণ্যশ্লোকের এই সমস্ত বিকার নয়নগোচর করিয়া দময়ন্তীর সমীপে আগমনপূর্ব্বক সমুদয় নিবেদন করিল। পতিবিয়োগদূঃখিনী দময়ন্তী নলের সহিত সাক্ষাৎ করিবার অভিলাষে কেশিনীকে আদেশ করিলেন, “তুমি জননীর সমীপে উপস্থিত হইয়া এই সকল কথা কহিবে যে, দেবি! ভর্ত্তৃদারিকা দময়ন্তী নল-বিবেচনায় বাহুককে বহুবিধ কৌশলদ্বারা পরীক্ষা করিয়া নিঃসন্দেহ হইয়াছেন; কেবল রূপবিষয়ে একমাত্ৰ সংশয় আছে। এক্ষণে তিনি একবার স্বয়ং পরীক্ষা করিতে অভিলাষ করেন; অতএব আপনি মহারাজের জ্ঞাতসারে হউক বা অজ্ঞাতসারেই হউক, নলরাজকে এ স্থানে আনয়ন করিতে অনুমতি প্ৰদান করুন। তাহার এই প্রার্থনা আপনাকে পরিপূর্ণ করিতে হইবে।”

“রাজমহিষী দময়ন্তীর প্রার্থনা শ্রবণ করিয়া ভীমভূপতিকে অবগত করাইলেন। তখন রাজা নিজ নন্দিনীর অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া তদীয় বাক্য অনুমোদন করিলে দময়ন্তী আপন কক্ষায় নলকে আনয়ন করিলেন। নলরাজ সহসা ধর্ম্মপত্নী দময়ন্তীকে নয়নগোচরপূর্ব্বক শোকদুঃখে অভিভূত হইয়া অজস্র অশ্রু-বিসর্জ্জন করিতে লাগিলেন; দময়ন্তীও নলকে তাদৃশ দুরবস্থাগ্রস্ত অবলোকন করিয়া তীব্রতর শোকে একান্ত অভিভূত হইয়া উঠিলেন।

দময়ন্তীকর্ত্তৃক নল-নিকটে স্মারক উক্তি

“অনন্তর কাষায়বসনাবৃতা, জটিলকেশা, মলিনাঙ্গী দময়ন্তী বাহুককে কহিলেন, “হে বাহুক! তুমি কি পূর্ব্বে এমন কোন ধর্ম্মজ্ঞ পুরুষকে দৃষ্টিগোচর করিয়াছ, যিনি অরণ্যে নিদ্রিতা রমণীকে একাকিনী পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিয়াছেন? পুণ্যশ্লোক নলরাজ ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তি আলস্যপরতন্ত্রা প্রিয়তমা ভাৰ্য্যাকে নিরপরাধে অরণ্যমধ্যে পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছেন? আমি বাল্যাবধি তাহার নিকটে এমন কোন অপরাধে অপরাধিনী হইয়াছিলাম যে, তিনি অরণ্যে নিদ্রিত—দশায় আমাকে পরিত্যাগ করিলেন? আমি পূর্ব্বে সাক্ষাৎ দেবগণকে উপেক্ষা করিয়া যাঁহাকে বরণ করিয়াছিলাম, তিনি আমাকে সাতিশয় অনুরক্তা ও পুত্ৰবতী দেখিয়াও কি প্রকারে পরিত্যাগ করিলেন? তিনি হুতাশন-সমীপে দেবগণের সমক্ষে,“আমি তোমারই হইব” বলিয়া প্রতিজ্ঞাপূর্ব্বক আমার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন; এখন সেই সত্য কোথায় রহিল?” এই প্রকার কহিতে কহিতে দময়ন্তীর শ্যামতারক, লোহিতোপান্ত নয়নযুগল হইতে অবিরধারে শোকসলিল বিগলিত হইতে লাগিল।

নল-দময়ন্তীর পুনর্ম্মিলন

“বিষধরাজ দময়ন্তীকে বিরহ-বেশধারিণী অবলোকন করিয়া কহিলেন, “ভীরু! আমি যে রাজ্যভ্ৰষ্ট হইয়াছি ও তোমাকে পরিত্যাগ করিয়াছি, তাহা আমার নিজদোষে নহে; কেবল কলি প্রভাবেই এই ঘটনা উপস্থিত হইয়াছে। তুমি সেই বিষম সঙ্কটে বনবাসিনী হইয়া আমার নিমিত্ত দিনযামিনী কেবল শোক করিতে করিতে যাহাকে শাপ প্ৰদান করিয়াছিলেন, সেই কলি তোমার শাপানলে দগ্ধ হইয়া অগ্নিনিহিত অগ্নির ন্যায় আমার শরীরে বাস করিয়াছিল। হে শুভে! সেই পাপাত্মা কলি আমার ব্যবসায় ও তপস্যাদ্বারা পরাভূত হইয়া আমাকে পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছে; অতএব আমাদের দুঃখের অন্ত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। আমি কেবল তোমার নিমিত্তই এস্থানে আগমন করিয়াছি; আমার আর অন্য কোন প্রয়োজন নাই। অয়ি ভীরু! তোমার ন্যায় কামিনীগণ কি অনুরক্ত একান্ত বশংবদ পতিকে পরিত্যাগ করিয়া কদাচ অন্যকে বরণ করে? ভূপতির আদেশানুসারে সমস্ত ধরামণ্ডলে এই কথা প্রচারিত হইয়াছে যে, ভীমসূতা দময়ন্তী স্বৈরিণীর ন্যায় আপনার অনুরূপ দ্বিতীয় ভর্ত্তাকে বরণ করিবেন। রাজা ঋতুপর্ণ এই কথা শ্রবণমাত্র অতিমাত্র ব্যগ্র হইয়া তোমার ভবনে উপস্থিত হইয়াছেন।”

“দময়ন্তী নলের-এইরূপ পরিবেদন শ্রবণ করিয়া ভীত হইয়া কম্পিত্যকলেবরে কৃতাঞ্জলিপুটে কহিতে লাগিলেন, “হে মহাভাগ! আমি যখন দেবগণকে পরিত্যাগ করিয়া আপনাকে বরণ করিয়াছি, তখন আমার প্রতি দোষারোপ করিয়া সন্দিহান হওয়া কোনক্রমেই উচিত নয়। ব্রাহ্মণগণ আপনাকে আনয়ন করিবার নিমিত্ত আমার গাথা গান করিয়া চতুর্দ্দিকে গমন করিয়াছিলেন। তন্মধ্যে পর্ণাদনামে এক বিদ্বান ব্রাহ্মণ অযোধ্যায় ঋতুপর্ণ-রাজের ভবনে আপনাকে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তিনি আপনার সমক্ষে আমার কথা কহিলে আপনি তাহাকে যে প্ৰত্যুত্তর প্রদান করিয়াছিলেন, তিনি তৎক্ষণাৎ আমার নিকট আসিয়া তাহা ব্যক্ত করিলে, আমি আপনাকে আনয়ন করিবার নিমিত্ত এই উপায় অবধারণ করিলাম; কারণ, আপনা ব্যতীত আর কেহই একদিনে বাজিগণসাহায্যে শতযোজন পথ অতিক্রম করিতে সমর্থ নহে। এক্ষণে আমি আপনার পাদস্পর্শ পূর্ব্বক শপথ করিতেছি, আমি মনে মনেও কিঞ্চিম্মাত্ৰ অসৎকর্ম্মের অনুষ্ঠান করি নাই। যিনি সর্ব্বভূতসাক্ষী সদাগতি এই সমুদয় পৃথিবীতে সঞ্চরণ করিতেছেন, যদি আমি পাপাচরণ করিয়া থাকি, সেই জগৎপ্ৰাণ আমার প্রাণসংহার করুন। যিনি সর্ব্বদা সকল লোকে আলোকবিস্তার করিয়া বিচরণ করিতেছেন, যদি আমি পাপাচরণ করিয়া থাকি, সেই ভূতভাবন ভগবান সহস্ৰদীধিতি আমার প্রাণসংহার করুন। যিনি সাক্ষিস্বরূপ হইয়া সকল ভূতের মধ্যে বিচরণ করিতেছেন, যদি আমি পাপাচরণ করিয়া থাকি, সেই নিশানাথ আমার প্রাণসংহার করুন। এই ত্ৰিলোকধারী দেবত্ৰয় যথার্থ বলুন, আমি অধর্ম্মাচরণ করিয়াছি কি না।”

“দময়ন্তীর বাক্যাবসান হইলে সমীরণ অন্তরীক্ষ হইতে কহিলেন, “হে নল! আমি সত্য কহিতেছি, দময়ন্তী কখন পাপাচরণ করেন নাই; ইনি স্বীয় অসীম শীলরত্ন সুন্দরীরূপে রক্ষা করিয়াছেন। আমরা ক্ৰমাগত তিন বৎসর ইহার রক্ষণাবেক্ষণ করিয়াছি এবং এক্ষণেও সাক্ষ্য প্ৰদান করিতে প্ৰস্তুত আছি। দময়ন্তী কেবল তোমাকে আনয়ন করিবার নিমিত্ত এই উপায় বিধান করিয়াছেন; কারণ, তোমা ভিন্ন অন্য কোন পুরুষই অশ্বদ্বারা একদিনে শতযোজন পথ অতিবর্ত্তন করিতে সমর্থ হয় না। এক্ষণে তোমরা উভয়ে মিলিত হইয়াছ; অতএব সংশয় পরিত্যাগ করিয়া একত্র সহবাসসুখে কালাতিপাত কর।” সর্ব্বত্রগামী সমীরণ এইরূপ কহিতেছেন, এমত সময়ে পুষ্পবৃষ্টি ও দেবগণের দুন্দুভিধ্বনি হইতে লাগিল এবং সুশীতল গন্ধবহ মন্দ মন্দ বহিতে আরম্ভ করিল।

নলের পূর্ব্বরূপ প্ৰাপ্তি

“নলরাজ এই বিস্ময়কর ব্যাপার অবলোকনপূর্ব্বক দময়ন্তীর চরিত্রবিষয়ে নিঃসংশয় হইয়া তাঁহার হস্তধারণপূর্ব্বক গ্ৰহণ করিলেন। অনন্তর তিনি নাগরাজদত্ত পরিশুদ্ধবসন পরিধান করিয়া তাহাকে স্মরণপূর্ব্বক স্বীয় রূপ লাভ করিলেন। ভীমসূতা দময়ন্তী স্বীয় কান্তকে পূর্ব্ববৎ কান্তিমান অবলোকন করিয়া আলিঙ্গনপূর্ব্বক উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। নলনৃপতিও দময়ন্তী এবং সন্তানদ্বয়কে আলিঙ্গন করিয়া অপার আনন্দসাগরে মগ্ন হইলেন। আয়তলোচনা সুরবদনা দময়ন্তী স্বীয় বক্ষঃস্থলে প্রিয়তমের বদন মণ্ডল বিন্যাস্ত করিয়া পূর্ব্বতন দুঃখসকল স্মরণপূর্ব্বক দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন নিষধরাজ নল মলিনকলেবরা স্মেরমুখী দময়ন্তীকে আলিঙ্গন করিয়া শোকভারে জড়ীভূত ও স্তব্ধ হইয়া রহিলেন।

‘অনন্তর বিদর্ভরাজমহিষী নৃপতিকে দময়ন্তী ও নলের সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিলে তিনি কহিলেন, “আমি কল্য প্রাতঃকালে দময়ন্তীর সহিত সুখাসীন কৃত বেশ নলনৃপতির সহিত সাক্ষাৎ করিব; তাহারা আজ যথাসুখে কালাতিপাত করুক।”

“অনন্তর দময়ন্তী ও নীলরাজ যামিনীযোগে রাজনিবেশনে প্রবেশপূর্ব্বক আপনাদের পুরাতন বনবাসবৃত্তান্ত লইয়া কথোপকথন করিতে করিতে সময় অতিবাহিত করিলেন। নলরাজ বর্ষত্ৰয়ব্যাপী বিরহানলে দহ্যমান হইতেছিলেন, এক্ষণে প্রিয়তমাকে প্রাপ্ত হইয়া আনন্দের পরাকাষ্ঠা লাভ করিলেন। যেমন অৰ্দ্ধসঞ্জাতশষ্যা বসুন্ধরা সলিলপরিপ্লুত হইলে আপ্যায়িত হয়, সেইরূপ দময়ন্তীও নিষধনৃপতিকে লাভ করিয়া আনন্দের উচ্চতর সীমায় আরোহণ করিলেন। যেমন পূৰ্ণমণ্ডল-কুসুদিনীনাথসনাথা যামিনী সাতিশয় শোভা বিস্তার করে, সেইরূপ বিগততন্দ্ৰা, গলিতসন্তাপা, হৰ্ষোৎফুল্লনয়না, পূর্ণকামা নৃপতনয়া অধিকতর শোভমানা হইতে লাগিলেন।”