৭৯তম অধ্যায়
নলের স্বপুরে আগমনে প্ৰজাগণের উৎসব
বৃহদশ্ব কহিলেন, “মহারাজ! নিষধাধিপতির আগমনে তদীয় নগর একান্ত প্রশান্ত ও মহোৎসবময় হইয়া উঠিল; প্রজাপুঞ্জের আহ্লাদের আর পরিসীমা রহিল না। রাজা দময়ন্তীকে পিতৃগৃহ হইতে আনয়ন করিবার নিমিত্ত বিদর্ভদেশে সৈন্যসামন্তসকল প্রেরণ করিলেন। বিদর্ভরাজ অবিলম্বে মহাসমাদরপূর্ব্বক কন্যাকে পাঠাইয়া দিলেন। দময়ন্তী সৎকৃত হইয়া পিতাকে অভিবাদন ও তৎকালোচিত অন্যান্য কর্ত্তব্যকর্ম্ম সম্পাদনপূর্ব্বক কন্যা-পুত্ৰ লইয়া পতিগৃহে যাত্রা করিলেন। মহারাজ নল তাঁহাকে কন্যা-পুত্র-সমভিব্যাহারে আগত দেখিয়া আহ্লাদসাগরে নিমগ্ন হইলেন। অনন্তর প্রকাশ্য রাজ্যশাসন, প্রচুর দক্ষিণা, বহুবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান ও অবিনশ্বর যশোরাশি বিস্তার করিয়া সাতিশয় বিরাজমান হইয়া অতি বিত্তীর্ণ জম্বুদ্বীপের একাধিপত্য করিতে লাগিলেন।”
বৃহদশ্বকর্ত্তৃক পাণ্ডবগণকে আশ্বাসপ্রদান
“হে পাণ্ডুবংশাবতংস রাজেন্দ্ৰ! সেই প্রকার আপনিও অচিরকালমধ্যে বন্ধুবান্ধবগণে পরিবৃত হইয়া দেদীপ্যমান হইবেন। অতএব আর চিন্তা করিবেন না। সুখ-দুঃখ অতীব অকিঞ্চিৎকর; বিবেচনা করিয়া দেখুন, যে নলরাজ দ্যূতক্ৰীড়ায় যথাসর্ব্বস্বে জলাঞ্জলি প্রদান করিয়া ভাৰ্য্যার সহিত তাদৃশ দারুণ দুঃসহ দুঃখ ভোগ করিয়াছিলেন, তিনিই পুনর্ব্বার আপনি রাজ্যপদপ্রাপ্ত ও অভ্যুদয়শালী হইলেন। আপনি ভ্রাতৃবর্গ ও দ্রৌপদীর সহিত নিরন্তর ধর্ম্মচিন্তা করিয়া এই মহারণ্যে পরমসুখে কালব্যাপন করিতেছেন, বেদ-বেদাঙ্গপারগ ব্রাহ্মণের সর্ব্বদাই আপনাকে সেবা করিতেছেন, অতএব আপনার বিলাপের বিষয় কি? কর্কোটিক নাগ, নল-দময়ন্তী ও রাজর্ষি ঋতুপর্ণের ইতিহাস শ্রবণ করিলে কলির ভয় একেবারে সুদূরপরাহত হয়; এক্ষণে সেই সমস্ত বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া ভবাদৃশ ব্যক্তির হতাশ্বাস হওয়া কোনক্রমেই উচিত নহে। মহারাজ! পুরুষার্থের অস্থিরত্ব জানিয়া তাহার অভ্যুদয় বা নাশের বিষয়ে চিন্তিত হওয়া অনুচিত। আপনি এক্ষণে আশ্বাসিত হউন, আর শোক করিবেন না। বিপৎপাতে বিমোহিত হওয়া কাপুরুষের লক্ষণ; দৈবের প্রতিকূলতাপ্রযুক্ত পুরুষকার-সকল নিষ্ফল হইয়া থাকে, কিন্তু তাহাতে জ্ঞানী ব্যক্তির অন্তঃকরণ কদাচ বিষণ্ন বা অভিভূত হয় না।
“যাঁহারা অনন্যমানঃ হইয়া অনুক্ষণ এই মহাফিলোপধায়ক নলচরিত কীর্ত্তন বা শ্রবণ করেন, অলক্ষ্মী তাঁহাদিগকে কদাপি আশ্রয় করিতে পারে না, তাঁহার বিপুল ঐশ্বৰ্য্যশালী, ধন্য ও সকলের অগ্রগণ্য হইয়া উঠেন এবং পুত্র-পৌত্র ও গো, অশ্ব প্রভৃতি পশুবথ লাভ করিয়া অয়োগী হইয়া প্রীতি-প্রফুল্লচিত্তে সুখে কালব্যাপন করিতে পারেন, সন্দেহ নাই। মহারাজ! এক্ষণে বিদায় হই, পুনরায় এইরূপ ভয়ের বিষয় উপস্থিত হইলে আমাকে আহ্বান করিবেন; আমি অক্ষাবিদ্যাপ্রভাবে তৎক্ষণাৎ তাহার নির্য্যাকরণ করিব। হে কৌন্তেয়! আমি নিখিল অক্ষাবিদ্যায় পারদর্শী, সম্প্রতি আপনার প্রতি প্ৰসন্ন হইয়া বলিতেছি, আপনি তৎসমুদয় গ্রহণ করুন।”
বৃহদশ্বের নিকট যুধিষ্ঠিরের অক্ষ-অশ্ববিদ্যালাভ
রাজা বিনয়নম্রবচনে বৃহদশ্বকে কহিলেন, “ভগবন! আপনার নিকট অক্ষাবিদ্যা শিক্ষা করিতে আমার একান্ত বাসনা হইয়াছে, অতএব অনুকম্পাপূর্ব্বক উহা প্ৰদান করুন।” অনন্তর বৃহদশ্ব মহাত্মা পাণ্ডবরাজকে অক্ষাবিদ্যা ও অশ্ববিদ্যা প্ৰদানপূর্ব্বক স্নানার্থ গমন করিলেন। তিনি প্রস্থান করিলে পর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সেই সেই শৈল, তীর্থ ও বন হইতে সমাগত ব্ৰাহ্মণ ও তপস্বিগণের নিকট শ্রবণ করিলেন যে, অর্জ্জুন কেবল বায়ুভক্ষণ করিয়া অতি কঠোর তপস্যা করিতেছেন; তাহার ন্যায় উগ্ৰতপাঃ তপস্বী কেহ কখন দৃষ্টিগোচর করে নাই। দেখিলে বোধ হয় যেন, মূর্ত্তিমান ধর্ম্ম নিয়তীব্রত হইয়া তপস্যা করিতেছেন। যুধিষ্ঠির ধনঞ্জয়ের সেইরূপ কঠোর তপানুষ্ঠান শ্রবণ করিয়া শোকে নিতান্ত কাতর হইলেন। আহা! প্ৰিয়তম পার্থ আমাদিগের নিমিত্ত কতই কষ্ট পাইতেছে, এই চিন্তা করিয়া তাঁহার হৃদয় দুঃখানলে দগ্ধ হইতে লাগল। তখন তিনি বহুবিষয়ভিজ্ঞ ব্ৰাহ্মণগণের শরণাপন্ন হইয়া নানাপ্রকার অর্জ্জুনবিষয়িণী কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন।
নলোপাখ্যানপৰ্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।