০৬৭. নলের ঋতুপর্ণ নৃপতির অশ্বাধ্যক্ষতাগ্রহণ

৬৭তম অধ্যায়

নলের ঋতুপর্ণ নৃপতির অশ্বাধ্যক্ষতাগ্রহণ

বৃহদশ্ব কহিলেন, “মহারাজ! এইরূপে কর্কোটিক নাগ অন্তর্হিত হইলে নিষধরাজ নল মহারাজ ঋতুপর্ণের নগরাভিমুখে যাত্রা করিলেন। তিনি দশম দিবসে তথায় উপস্থিত হইয়া রাজার নিকট গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে মহারাজ! আমার নাম বাহুক; এই ভূমণ্ডলে অশ্বচালনায় আমার সদৃশ ব্যক্তি কখন কাহারও দৃষ্টিগােচর হয় নাই। আমি সকল বিষয়েই বিলক্ষণ নিপুণ, অর্থকৃচ্ছ্র সমুপস্থিত হইলে আমি তাহার প্রতিবিধানের সৎপরামর্শ প্ৰদান এবং অন্য অপেক্ষা বিশেষরূপে অন্ন সংস্কার করিতে পারি। হে মহারাজ! এই লোকে যাবতীয় শিল্প ও অন্যান্য সুদুষ্কর কর্ম্ম আছে, সেই সমুদয় সম্পাদনা করিতে সবিশেষ যত্ন করিব, আপনি আমাকে প্রতিপালন করুন।”

“মহারাজ ঋতুপর্ণ তাঁহার বাক্য শ্রবণানন্তর কহিলেন, “হে বাহুক! তুমি এই স্থানে পরমসুখে বাস কর। তুমি যাহা যাহা কহিলে, এখানে থাকিয়া তৎসমুদয়ই করিতে পরিবে, বিশেষতঃ আমার শীঘ্রগমনে অত্যন্ত অভিলাষ, অতএব তুমি অদ্যাবধি আমার আশ্বাধ্যক্ষ হইয়া যাহাতে আমার অশ্বগণ শীঘ্ৰগামী হয়, এমত উপায় স্থির কর; আমি তোমাকে মাসিক দশসহস্ৰ সুবর্ণ বেতন প্ৰদান করিব। এই বার্ষ্ণেয় ও জীবল নিত্য তোমার পরিচর্য্যা করিবে, তুমি এই দুইজনের সহিত আমোদ-প্রমোদ করিয়া স্বচ্ছন্দে আমার অধিকারে থাকিয়া কালযাপন কর।’

“নালরাজ ঋতুপর্ণের আদেশানুসারে বার্ষ্ণেয় ও জীবলসমভিব্যাহারে পরমসমাদৃত হইয়া তাঁহার নগরে বাস করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি স্বীয় প্রণয়িনী বিদৰ্ভরাজদুহিতা দময়ন্তীকে স্মরণ করিয়া প্রত্যহ সায়ংকালে এই কথা কহিতেন, ‘হায়! সেই নিরুপায়া কামিনী ক্ষুৎপিপাসায় পীড়িতা ও একান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া কোথায় শয়ান রহিয়াছে ও এই মন্দভাগ্যকে স্মরণ করিয়া জীবিকানির্ব্বাহাৰ্থ কাহার উপাসনা করিতেছে?”

“জীবল প্রতিদিন সায়ংকালে নলের মুখে এই কথা শুনিয়া একদা রজনীযোগে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “হে বাহুক! তুমি প্রত্যহ যে কামিনীর নিমিত্ত অনুশোচনা কর, সে কে? কাহার পত্নী? উহা শুনিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইয়াছে।”

“নল কহিলেন, “হে জীবল! কোন মূঢ়মতি ব্যক্তির এক বহু গুণবতী রমণী ছিল। ঐ মন্দবুদ্ধি কোন কারণবশতঃ তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া এক্ষণে তাহার শোকে নিরন্তর দগ্ধ হইতেছে ও অবিশ্রামে দিবারাত্র ভ্রমণ করিতেছে। সেই মূঢ়মতিই যামিনীযোগে আপনার প্রণয়িনীকে স্মরণ করিয়া ঐ কথা বলে। সেই হতভাগ্য নানাস্থানে ভ্রমণ করিয়া পরিশেষে কোন স্থানে কোন অনুচিত কাৰ্য্য অবলম্বন করিয়া কালযাপন করিতেছে। আহা! সেই দুঃখিনী রমণী অরণ্যমধ্যে অতিকষ্টেও স্বীয় স্বামীর অনুগামিনী ছিল; কিন্তু সেই হতভাগ্য পুরুষ তাদৃশ নির্জ্জন অরণ্যমধ্যেও উহাকে পরিত্যাগ করিয়া প্রস্থান করিয়াছে। ঐ কামিনী একে মার্গানভিজ্ঞ, তাহাতে আবার ক্ষুৎপিপাসায় একান্ত অভিভূত; এক্ষণে সেই হিংস্ৰক জন্তুপরিপূর্ণ নির্জ্জন কাননে পতিকর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া কি কষ্টেই কালব্যাপন করিতেছে! হায়! তাদৃশ দুৰ্গম স্থানে সে কি জীবিত রহিয়াছে? বলিতে পারি না।”

“এইরূপে মহারাজ নল দময়ন্তীকে স্মরণ করিয়া অজ্ঞাতরূপে মহারাজ ঋতুপর্ণের নিকেতনে বাস করিতে লাগিলেন।”