০৯৩. তীর্থযাত্রী যুধিষ্ঠিরাদির প্রতি ব্যাসপ্রমুখ মহর্ষির উপদেশ

৯৩তম অধ্যায়

তীর্থযাত্রী যুধিষ্ঠিরাদির প্রতি ব্যাসপ্রমুখ মহর্ষির উপদেশ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! বনবাসী ব্রাহ্মণগণ রাজা যুধিষ্ঠিরকে গমন করিতে অবলোকন করিয়া তাঁহার সমীপে আগমনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে মহারাজ! আপনি আপনি মাহাত্মা আগমনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে মহারাজ! আপনি মহাত্মা লোমশমুনি ও ভ্রাতৃগণ-সমভিব্যাহারে তীর্থ-সন্দর্শনে যাত্রা করিতেছেন, এক্ষণে আমাদিগকে সমভিব্যাহারী করা আপনার উচিত; আপনি সঙ্গে না থাকিলে আমরা অল্পসংখ্যক জনসমভিব্যাহারে শ্বাপদসেবিত বিষম দুৰ্গম দুৰ্গসকল অতিক্রম করিয়া কদাচ তীৰ্থপৰ্য্যটন করিতে সমর্থ হইব না। হে পৃথিবীপাল! আমরা আপনার শূরবর ধনুৰ্দ্ধর ভ্রাতৃগণকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া অকুতোভয়ে বন ও তীর্থ সকল পৰ্যটনপূর্ব্বক ভবদীয় প্ৰসাদেই তত্ৰত্য সুখময় ফললাভ করিব। আপনার বীৰ্য্যপ্রভাবে রক্ষিত হইয়া অক্ষত-শরীরে তীর্থ-দর্শন ও তীর্থস্নান করিয়া বিগত পাপ হইব। মহারাজ কর্ত্তবীৰ্য্য, অষ্টক, রাজর্ষি লোমপাদ ও সার্ব্বভৌম ভরত, ইহার যে-সকল লোকে গমন করিয়াছেন, আপনিও তীর্থপরিপ্লুত হইয়া সেই-সকল অসুলভ লোক লাভ করিবেন। আমরা আপনার সহিত একত্ৰ হইয়া প্ৰভাসাদি তীর্থ মহেন্দ্ৰাদি পর্ব্বত, গঙ্গাদি নদী ও প্লক্ষাদি বনস্পতিসকল সন্দর্শন করিতে অভিলাষ করি। হে জননাথ! যদি ব্রাহ্মণগণের প্রতি আপনার কিঞ্চিম্মাত্ৰ প্রীতি থাকে, তাহা হইলে আমাদিগের এই বাক্য রক্ষা করুন; ইহাতে অবশ্যই আপনার শ্রেয়োলাভ হইবে। তীর্থ সকল সর্ব্বদা অপোবিঘ্নকর নিশাচরগণে সমাকীর্ণ, আপনারা সেই সকল রাক্ষসগণ হইতে আমাদিগকে পরিত্রাণ করিবেন। ধীমান, ধৌম্য, দেবর্ষি নারদ ও মহাতপাঃ লোমশ যে-সকল তীর্থ কীর্ত্তন করিয়াছেন, আপনারা লোমশ ঋষিকর্ত্তৃক পরিরক্ষিত হইয়া আমাদিগের সহিত ঐ সকল তীর্থ পৰ্যটন করুন।”

ব্রাহ্মণদিগের মুখ হইতে এইরূপ গৌরবসূচক বাক্য-সকল শ্ৰবণ করিয়া রাজা যুধিষ্ঠিরের লোচনযুগল হইতে আনন্দসলিল বিগলিত হইতে লাগিল। তখন তিনি ভ্রাতৃগণকর্ত্তৃক পরিবৃত হইয়া লোমশ ও ধৌম্যের অনুজ্ঞা গ্রহণপূর্ব্বক সেই সকল ব্ৰাহ্মণকেও সমভিব্যাহারী করিতে অঙ্গীকার করিলেন। পরে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণ ও দ্রুপদনন্দিনীর সহিত তীর্থযাত্রায় কৃতসঙ্কল্প হইলেন।

অনন্তর মহাভাগ ব্যাস, পর্ব্বত ও নারদ ঋষি তাঁহাদিগকে দর্শন করিবার নিমিত্ত কাম্যাকবনে আগমন করিলেন। রাজা যুধিষ্ঠির তাহাদিগকে সমুচিত পূজা করিলে তাহারা পূজাগ্রহণপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “হে পাণ্ডবগণ! মনকে পরিশুদ্ধ করিয়া তীর্থযাত্ৰা করিতে হইবে, অতএব তোমরা অন্তঃকরণের সরলতাসম্পাদন কর। ব্রাহ্মণগণ শারীরিক নিয়মকে মানুষ-ব্রত ও মনোবিশুদ্ধ বুদ্ধিকে দৈব-ব্ৰত বলিয়া থাকেন। মনের নির্দেষিতাই শুচিতার পর্য্যাপ্ত কারণ। শান্তস্বভাব অবলম্বনপূর্ব্বক বিশুদ্ধ হইয়া তীর্থ-দর্শন করিতে হইবে। তোমরা মানসিক ও শারীরিক নিয়মৰ্দ্ধারা পবিত্র হইয়া দৈবব্রত অবলম্বনপূর্ব্বক যথোক্ত ফললাভ করিবে।”

পাণ্ডবগণ ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া প্রতিজ্ঞাপূর্ব্বক দিব্য ও মানুষ মুনিগণকর্ত্তৃক কৃতস্বস্ত্যয়ন হইয়া লোমশ, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, নারদ ও পর্ব্বত-ঋষির পাদবন্দনপূর্ব্বক বিদায় গ্রহণ করিলেন। অনন্তর চীরাজিনজিটাধারী হইয়া অভেদ্য কবচ পরিধানপূর্ব্বক ধৌম্য ও সেই সমস্ত বনবাসী ব্রাহ্মণগণ-সমভিব্যাহারে মৃগশিরা নক্ষত্ৰযুক্ত পৌর্ণমাসী অতীত হইলে পুষ্যানক্ষত্রে তীর্থদর্শনে নিৰ্গত হইলেন। ইন্দ্ৰসেন প্রভৃতি ভৃত্যগণ, চতুর্দ্দশ রথ, সূপকারগণ ও অন্যান্য পরিচারক-সকল তাঁহাদের সমভিব্যাহারী হইল। মহাবীর পাণ্ডবগণ এইরূপে শর, শরাসন ও অসি প্রভৃতি আয়ুধ গ্রহণপূর্ব্বক পূর্ব্বাভিমুখে প্ৰস্থান করিলেন।