০৬৮. নল-দময়ন্তীর অন্বেষণার্থ ভীম নৃপতির পুরস্কার ঘোষণা

৬৮তম অধ্যায়

নল-দময়ন্তীর অন্বেষণার্থ ভীম নৃপতির পুরস্কার ঘোষণা

বৃহদশ্ব কহিলেন, “হে রাজন! এইরূপে রাজ্যাপহরণান্তর মহারাজ নল ও তাঁহার পত্নী দময়ন্তী দাসভাবাপন্ন হইলে বিদৰ্ভাধিপতি ভীম জনশ্রুতিতে ঐ বৃত্তান্ত অবগত হইয়া সন্দর্শনাকাঙক্ষায় অনেকানেক ব্রাহ্মণগণকে ইতস্ততঃ প্রেরণ করিলেন। তিনি তাঁহাদিগকে বহুতর অর্থ প্ৰদানপূর্ব্বক কহিয়া দিলেন যে, “তোমরা নল ও আমার দুহিতা দময়ন্তীর অন্বেষণ কর। তোমাদের মধ্যে যে কেহ নল ও দময়ন্তীকে এস্থানে আনয়ন করিতে পরিবে, তাহাকে পুরস্কারস্বরূপ সহস্ৰসংখ্যক গো ও নগরতুল্য এক গ্রাম প্রদান করিব। যদি উহাদিগকে এখানে আনয়ন করা নিতান্ত দুষ্কর বোধ হয়, তথাপি তাহাদের সমাচার প্ৰদান করিতে পারিলেও সহস্ৰ গোধন প্ৰদান করিব।” ব্ৰাহ্মণগণ ভীম-নরপতির বাক্যশ্রবণে যৎপরোনাস্তি হৃষ্টচিত্ত হইয়া চতুর্দ্দিকে গমন করিলেন। তাঁহারা অনেকানেক নগর ও রাজ্যমধ্যে নল ও দময়ন্তীর অন্বেষণ করিতে লাগিলেন, কিন্তু কোথাও তাহাদিগের অনুসন্ধান পাইলেন না।

ভীমনৃপতি-প্রেরিত সুদেবের দময়ন্তী-সাক্ষাৎকার

“উহাদিগের মধ্যে সুদেবনামে এক ব্ৰাহ্মণ নানাদেশ পৰ্যটন করিয়া পরিশেষে সুরম্য চেদিনগরীতে সমুপস্থিত হইলেন। তথায় অন্বেষণ করিতে করিতে রাজভবনে রাজার পুণ্যাহবাদিনী, সুনন্দাসমভিব্যাহারিণী দময়ন্তীকে দেখিতে পাইলেন। অপ্রতিমরূপশালিনী ভৈমী পতিবিরহে ধূমাবলিজটিল [ধূমাবৃত] পাবকপ্রভার ন্যায় নিতান্ত মলিনা ও সাতিশয় ক্ষীণা হইয়াছিলেন। সুদেব তাঁহার লক্ষণ দর্শনে ‘এই দময়ন্তী” বলিয়া তর্ক করিয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন, “ইঁহাকে আমি পূর্ব্বে যেরূপ দেখিয়াছিলাম, সাক্ষাৎ লক্ষ্মীর ন্যায় এই কামিনীকে নিরীক্ষণ করিয়া চরিতার্থ হইলাম। এই চারুবৃত্ত-পয়োধরা, পূৰ্ণচন্দ্রসদৃশী, শ্যামা কামিনী স্বীয় রূপলাবণ্যে দশদিক আলোকময় করিতেছেন। এই পদ্মপত্ৰবিশালী সাক্ষাৎ রতিসদৃশী রমণী পূৰ্ণচন্দ্রপ্রভার ন্যায় সমস্ত লোকেরই অভীষ্ট। এই রত্নগৃহোচিতা, রূপগুণসম্পন্না, সুকুমারী নৃপকুমারী পতিবিরহে, রাহুগ্ৰস্ত সুধাকরসনাথ পৌর্ণমাসীর নিশার ন্যায়, শুষ্কতোয়া তটিনীর ন্যায় ও বিদর্ভরূপ সরোবরে করিকরপরাধ [করিশুণ্ডদ্বারা ছিন্নভিন্ন], মৃষ্টি, বিশুদ্ধপত্ৰকুসুমা, পঙ্কমলিনা স্থানভ্রষ্টা নলিনীর ন্যায় নিতান্ত কান্তিশূন্য হইয়া রহিয়াছেন। এই ঔদাৰ্য্যগুণশালিনী ভূষণবিরাহিণী কামিনী কামভোগবিবর্জ্জিতা, প্রিয়বিরহিতা ও বন্ধুজনবিহীনা হইয়া আতপতাপতাপিতা ছিন্ন কমলিনার ন্যায়, নীলাভ্ৰসংরত নবীন চন্দ্ৰলেখার ন্যায় নিতান্ত মলিন ও দিন দিন ক্ষীণ হইতেছেন; এক্ষণে কেবল ভর্তুদর্শনাকাঙ্ক্ষায় জীবনধারণ করিয়া কালযাপন করিতেছেন। পতিই নারীর প্রধান ভূষণ; এই কামিনী স্বাভাবিক রূপলাবণ্যসম্পন্না হইয়াও একমাত্র পতিবিরহে কিছুমাত্ৰ শোভা পাইতেছেন না। কি আশ্চৰ্য্য! নিলরাজ ইহার বিরহেও জীবনধারণ করিয়া আছেন, আজও শোকে প্ৰাণত্যাগ করেন নাই! এই অসিতকেশা, কমলরোচনা, নিতান্ত সুখোচিতা কামিনীকে দুঃখিত দেখিয়া আমারও হৃদয় ব্যথিত হইতেছে। হায়! এই বরবর্ণিনী কতদিনে ভর্তুসমাগম লাভ করিয়া দুস্তর দুঃখসাগরের পর-পার প্রাপ্ত হইবেন? নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, রাজ্যভ্ৰষ্ট নিষধাধিপতি নল স্বীয় রাজ্য ও এই কামিনীকে পুনঃপ্রাপ্ত হইয়া পরম পরিতুষ্ট হইবেন। মহারাজ নলই এই তুল্যশীলা, তুল্যবয়স্কা ও তুল্যাভিজনা কামিনীর উপযুক্ত পতি এবং এই সর্ব্বলোকলালামভূতা দময়ন্তীই নলরাজের উপযুক্ত পত্নী। যাহা হউক, এক্ষণে এই পতিদর্শনলালসা, অননুভূত-পূর্ব্বদুঃখা নিতান্ত দুঃখার্ত্তা, অমিতবীৰ্য্যসম্পন্ন মহারাজ নলের পত্নীকে আশ্বাস প্রদান করা আমার অবশ্য কর্ত্তব্য।’

“সুদেব মনে মনে এইরূপ বিবেচনা করিয়া পরিশেষে দময়ন্তীর নিকটে গমনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “বৈদৰ্ভি! আমি আপনার ভ্রাতার দায়িত সখা, আমার নাম সুদেব। মহারাজ ভীমের আদেশানুসারে আপনাকে অন্বেষণ করিতে এখানে আসিয়াছি। আপনার পিতা, মাতা ও ভ্রাতৃগণের সর্ব্বাঙ্গীণ মঙ্গল; আপনার আয়ুষ্মান তনয় ও তনয়া তথায় কুশলে কালযাপন করিতেছে ও সমস্ত বন্ধুবৰ্গ আপনার নিমিত্ত মৃতকল্প হইয়া রহিয়াছেন। শত শত ব্রাহ্মণগণ আপনার অন্বেষণে সমুদয় পৃথিবী পরিভ্রমণ করিতেছে।”

“দময়ন্তী সুদেবের বাক্য-শ্রবণানন্তর তাঁহাকে চিনিতে পারিয়া ক্ৰমে ক্রমে সমুদয় সুহৃদগণের সুসমাচার জিজ্ঞাসা করিলেন এবং ভ্রাতৃসখার সন্দর্শনে সাতিশয় শোকাকুলিত হইয়া করুণস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। সুনন্দা তাহাকে রোদন ও ব্রাহ্মণের সহিত একান্তে কথোপকথন করিতে দেখিয়া শোকসন্তপ্তচিত্তে স্বীয়জননীর সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, ‘মাতঃ! সৈরিন্ধ্রী এক ব্রাহ্মণের সহিত সমাগত হইয়া রোদন করিতেছে; যদি ইচ্ছা! হয়, তবে তথায় উপস্থিত হইয়া কারণ জিজ্ঞাসা করুন।”

“রাজমাতা সুনন্দার বাক্যশ্রবণানন্তর অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইয়া সুদেব-সমভিব্যাহারিণী সৈরিন্ধ্রীর সমীপে সমুপস্থিত হইলেন ও সুদেবকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে বিপ্ৰ! এই সীমন্তিনী কাহার ধর্ম্মপত্নী ও কাহার কন্যা? ইহা আমি জানিতে একান্ত অভিলাষ করি। বোধহয়, আপনি ইহার সমুদয় বৃত্তান্ত অবগত আছেন; অতএব অনুগ্রহপূর্ব্বক আমার নিকট ইহার যথার্থ পরিচয় প্ৰদান করুন।”

“দ্বিজসত্তম সুদেব রাজমাতার বাক্যশ্রবণানন্তর সুখোপবিষ্ট হইয়া তাঁহার নিকচ দময়ন্তীর সমুদয় বৃত্তান্ত কহিতে লাগিলেন।”