২০০তম অধ্যায়
জপফলতুল্যতায় রাজা ও দ্বিজের দিব্যগতি
যুধিষ্ঠির কহিলেন,“পিতামহ! ঐ সময় রাজা ও ব্রাহ্মণ উভয়ে বিরূপের বাক্যে কি উত্তর প্রদান করিলেন, তৎকালে বিরূপের বাক্যে সম্মত হইয়া তাঁহারা কি মুক্তি লাভ করিয়াছিলেন? আর ঐ সময় তাঁহাদের কিরূপ কথোপকথন হইয়াছিল? তৎসমুদয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! তৎকালে সেই জাপক ব্রাহ্মণ যম, কাল, মৃত্যু, স্বর্গ এবং সমাগত ব্রাহ্মণগণকে পূজা করিয়া নরপতিকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘মহারাজ! আপনি আমার জপের ফলভাগী হইয়া শ্রেষ্ঠতালাভ করুন এবং অনুমতি করুন, আমি পুনরায় গিয়া জপকাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হই। ইতিপূৰ্ব্বে ভগবতী সাবিত্রী দেবীও আমাকে “উত্তরোত্তর তোমার জপানুষ্ঠানে শ্রদ্ধাবৃদ্ধি হউক” এই বর প্রদান করিয়াছেন।’
‘‘রাজা কহিলেন, ব্রা‘হ্মণ! যখন আপনার জপানুষ্ঠানে বিলক্ষণ শ্রদ্ধা আছে, তখন আমাকে জপের ফলপ্রদান করাতে আপনার ফলহানি হয় নাই, বরং দাননিবন্ধন উহার বৃদ্ধিই হইয়াছে। যাহা হউক, আসুন, এক্ষণে আমরা উভয়ে তুল্যরূপে ফল ভোগ করি।’
“তখন ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘মহারাজ! আপনি এই সকল মহাত্মার সমক্ষে বারংবার আমাকে আপনার তুল্যফলভাগী হইতে অনুরোধ করিতেছেন; অতএব আমি আপনার বাক্যে সম্মত হইলাম। এক্ষণে আমাদের উভয়েরই সমান গতি হউক।’
“ব্রাহ্মণ এই কথা কহিলে, ‘ভগবান্ ত্রিদশাধিপতি ইন্দ্র হার ও নরপতির অভিপ্রায় বিদিত হইয়া দেবগণ ও লোকপালগণ সমভিব্যাহারে তথায় সমুপস্থিত হইলেন। ঐ সময় দেবী সরস্বতী, নারদ, পৰ্ব্বত, বিশ্বাবসু, হাহা, হুহু, সপরিবার চিত্রসেন, দেবাদিদেব প্রজাপতি ব্রহ্মা, সহস্রশিরাঃ বিষ্ণু এবং সাধ্য, বিশ্বদেব, মরুৎ, নদী, শৈল, সমুদ্র, তীর্থ, তপস্যা, যোগ, বিধি, বেদ, স্তোত্র ও মুনিগণ তথায় আগমন করিলেন। অন্তরীক্ষে ভেরী, তূরী প্রভৃতি বিবিধ বাদ্য ও আকাশ হইতে পুষ্পবৃষ্টি নিপতিত হইতে লাগিল এবং অপ্সরাগণ নৃত্য করিতে আরম্ভ করিল। তখন স্বর্গ মূৰ্ত্তিমান্ হইয়া ব্রাহ্মণ ও নরপতিকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘হে মহাপুরুষদ্বয়! তোমরা উভয়েই সিদ্ধপুরুষ হইয়াছ।’
জাপক দ্বিজ ও ইক্ষ্বাকুর যুগপৎ ব্রহ্মপ্রাপ্তি
“অনন্তর সেই জাপক ব্রাহ্মণ ও ভূপতি উভয়ে এককালে বিষয় হইতে ইন্দ্রিয়গণকে নিবৃত্ত করিতে লাগিলেন। তাঁহারা অগ্রে প্রাণ, অপান, উদান, সমান ও ব্যান এই পঞ্চবায়ুকে হৃদয়ে সংস্থাপন করিয়া একীকৃত প্রাণ ও অপানে মনঃসমাধান করিলেন এবং পরিশেষে ঐ বায়ুদ্বয়কে উদরে সংস্থাপিত করিয়া নাসাগ্রে দৃষ্টিনিক্ষেপূৰ্ব্বক অস্পন্দশরীরে নির্নিমেষলোচনে [নিমেষশূন্য নেত্রে] মনের সহিত প্রাণ ও অপানকে ভূমধ্যে নিহিত করিলেন। এইরূপে তাঁহারা চিত্ত জয় করিলে তাঁহাদের চিত্ত মস্তকে নীত হইল। ঐ সময় এক দেদীপ্যমান জ্যোতিঃ সেই মহাত্মা দ্বিজবরের ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদপূৰ্ব্বক প্রাদুর্ভূত হইয়া স্বর্গে প্রস্থান করিল। তৎকালে চতুর্দ্দিকে মহাকোলাহলশব্দ সমুত্থিত হইল। তত্ৰত্য সকলেই ঐ তেজোরাশির স্তব আরম্ভ করিলেন। অনন্তর সেই তেজ ক্রমশঃ ব্রহ্মার সমীপে সমুপস্থিত হইলে লোকপিতামহ ব্রহ্মা তাঁহাকে স্বাগতসম্ভাষণ করিলেন। ঐ সময় এক প্রাদেশপ্রমাণ পুরুষ তথায় উপস্থিত হইয়া মধুরবচনে কহিলেন যে, ‘যোগীরা জাপকদিগের তুল্যফলই লাভ করিয়া থাকে, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। কেবল যোগিগণের যোগের সময় ব্রহ্মের সহিত সাক্ষাৎকারলাভ হয়, আর জাপকদিগের ব্রহ্মে লীন হইবার অব্যবহিত পূর্ব্বেই ব্রহ্মের সহিত আত্মার ঐক্য হইয়া থাকে।’ এই বলিয়া সেই প্রাদেশপ্রমাণ পুরুষ ব্রহ্মের সহিত ব্রাহ্মণের একাত্মতা সম্পাদন করিলেন। তখন দ্বিজবর অচিরাৎ ব্রহ্মের আস্যদেশে প্রবিষ্ট হইলেন। ঐ সময় নরপতিও ব্রাহ্মণের ন্যায় লোকপিতামহ ব্রহ্মার শরীরে প্রবেশ করিলেন।
“অনন্তর দেবগণ ভগবান্ স্বয়ম্ভুকে অভিবাদন করিয়া কহিলেন, ‘ভগবন্! আপনি জাপকদিগের নিমিত্ত অতি উৎকৃষ্ট গতি নির্দ্ধারিত করিয়াছেন। আমরা ঐ জাপক ব্রাহ্মণের সদগতিলাভার্থ সকলে সমাগত হইয়াছিলাম। এক্ষণে আপনি ঐ রাজা ও জাপক ব্রাহ্মণকে তুল্যরূপ ফলভাগী করিলেন। আজ আমরা যোগী ও জাপকের মহাফল দর্শন করিলাম। ইঁহারা সমুদয় লোক অতিক্রম ও অভিলষিত লোকে গমন করিতে সমর্থ হইলেন। তখন ভগবান্ প্রজাপতি দেবগণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হে সুরগণ! যাঁহারা মহাস্মৃতি [প্রধান স্মৃতিশাস্ত্র] বা মন্বাদি স্মৃতি [মনুপ্রণীত স্মৃতিশাস্ত্র] পাঠ করেন এবং যাঁহারা যোগে একান্ত অনুরক্ত হয়েন, তাঁহারা দেহাবসানে নিশ্চয়ই আমার সালোক্য লাভ করিয়া থাকেন। এক্ষণে আমি চলিলাম। তোমরাও স্ব স্ব কাৰ্য্যসাধনের নিমিত্ত যথাস্থানে প্রস্থান কর।
“ভগবান্ কমলযোনি দেবগণকে এইরূপ কহিয়া স্বয়ং অন্তর্হিত হইলেন; দেবগণও তাঁহাকে আমন্ত্রণ করিয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন। অন্যান্য মহাত্মারা ধর্ম্মের পূজা করিয়া পরম প্রীতমনে তাঁহার অনুসরণে প্রবৃত্ত হইলেন।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! আমি জাপকদিগের যেরূপ ফললাভ শ্রবণ করিয়াছিলাম, তাহা তোমার নিকট কীৰ্ত্তন করিলাম, অতঃপর আর কি শ্রবণ করিতে তোমার অভিলাষ হয়, তাহা ব্যক্ত কর।”