০৮৬. সুশর্ম্মার পৃষ্ঠরক্ষক বীরগণের বিনাশ

৮৬তম অধ্যায়

সুশর্ম্মার পৃষ্ঠরক্ষক বীরগণের বিনাশ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহাবীর ধনঞ্জয় শরনিকর দ্বারা ছিন্নভিন্ন হইয়া পদাহত ভুজঙ্গের ন্যায় নিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক বাণে বাণে মহারথগণের কামুক ছেদন করিলেন এবং তাহাদিগকে নিঃশেষে বিনাশ করিবার অভিলাষ করিয়া এককালে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের সর্ব্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত, বর্ম্মসকল ছিন্নভিন্ন ও মস্তকসকল ছেদিত হইল; তাঁহারা শোণিতলিপ্তকলেবরে এককালে ভূতলশায়ী হইলেন। অনন্তর ত্রিগর্ত্তরাজ সুশর্ম্মা তাঁহাদিগকে গতাসু দেখিয়া অর্জ্জুনের অভিমুখে গমন করিলেন। তাঁহাদিগের পৃষ্ঠরক্ষক দ্বাত্রিংশৎ মহাবীর অর্জ্জুনসন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক বাণবর্ষণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন শরনিকরে নিতান্ত নিপীড়িত ও ক্ৰোধে একান্ত অধীর হইয়া তৈলমাৰ্জিত [তৈলদ্বারা বিদুরিত মল-চকচকে] ষষ্টিশরে পৃষ্ঠরক্ষকদিগকে বিনাশ করিলেন। তিনি এইরূপে ষষ্টিসংখ্যক রথীদিগকে পরাজয় করিয়া ভূপালগণের বলসমুদয় বিনাশ করিয়া ভীষ্মবধার্থ প্রীতমনে সত্বর গমন করিতে লাগিলেন। ত্ৰিগৰ্তরাজ স্বীয় বন্ধুবান্ধবদিগকে নিহত দর্শন করিয়া অন্যান্য ভূপালগণকে পুরষ্কৃত করিয়া অর্জ্জুনবধার্থ ধাবমান হইলেন। তখন শিখণ্ডীপ্রভৃতি বীর সকল অর্জ্জুনকে সত্বর গমন করিতে দেখিয়া তাঁহার রথ রক্ষা করিবার নিমিত্ত শাণিত শস্ত্র গ্ৰহণ করিয়া পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। অর্জ্জুন ত্ৰিগৰ্তরাজ সুশর্ম্মার সহিত ভূপালগণকে আগমন করিতে নিরীক্ষণ করিয়া গাণ্ডীবমুক্ত নিশিতসায়কদ্বারা তাঁহাদিগকে বিনাশ করিয়া ভীষ্মের প্রতি ধাবমান হইয়া দুৰ্য্যোধন ও জয়দ্ৰথ প্রভৃতি নৃপতিগণকে নিরীক্ষণ করিলেন। তখন তিনি তাঁহাদিগকে বিদারণ পরিত্যাগপূর্ব্বক ভীষ্মসন্নিধানে উপস্থিত হইলেন। অনন্তর মহাবলপরাক্রান্ত রাজা যুধিষ্ঠীর ক্রোধাবিষ্ট হইয়া প্রতিদ্বন্দ্বী শল্যকে পরিত্যাগপূর্ব্বক ভীমসেন ও মাদ্রীতনয় নকুল ও সহদেবের সহিত ভীষ্মের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর ভীম সমস্ত পাণ্ডবগণের সহিত সমাগত ও দারুণ শরসমূহে বিদ্ধ হইয়াও ব্যথিত হইলেন না।

যুধিষ্ঠিরকর্ত্তৃক শিখণ্ডীর উত্তেজনা

“অনন্তর সত্যসন্ধ জয়দ্ৰথ তথায় আগমন করিয়া শরাসনে শরসন্ধানপূর্ব্বক সহসা পাণ্ডবগণের কামুক ছেদন করিলেন। রাজা দুর্য্যোধন ক্রোধাবিষ্ট হইয়া অনলসঙ্কাশ শরনিকরে তাঁহাদিগকে প্রহার করিতে লাগিলেন। যেমন দেবগণ সমবেত অসুরগণের শরনিকরে বিদ্ধ হইয়াছিলেন, তদ্রূপ পাণ্ডবেরা কৃপ, শল্য, শল ও চিত্ৰসেনের বিচিত্ৰ সায়কে বিদ্ধ হইয়া সাতিশয় রোষাবিষ্ট হইলেন। অজাতশত্রু রাজা যুধিষ্ঠির ভীষ্মশরে শিখণ্ডীর কামুক খণ্ড খণ্ড নিরীক্ষণ করিয়া ক্ৰোধাভরে কহিলেন, “হে বীর! তুমি তোমার পিতার অগ্রে আমার নিকট অঙ্গীকার করিয়াছিলে যে, আমি নিশ্চয়ই কহিতেছি, বিমল সূৰ্য্যসঙ্কাশ শরনিকরে মহাব্ৰত ভীষ্মকে সংহার করিব; তুমি কি নিমিত্ত আপনার প্রতিজ্ঞা সফল করিতেছ না? এক্ষণে তাঁহাকে বিনাশ করিয়া প্ৰতিজ্ঞা প্রতিপালন এবং ধর্ম্ম, কুল ও যশ রক্ষা কর। দেখ, যেমন কৃতান্ত ক্ষণকালমধ্যে জগৎ সন্তপ্ত করে, তদ্রূপ ভীষ্ম সুতীক্ষ্ন বাণসমূহে আমার সৈন্যগণকে নিরন্তর পরিতপ্ত করিতেছেন। এক্ষণে তুমি ছিন্নধনু, সমরপরাঙ্মুখ ও ভীষ্মের নিকট পরাজিত হইয়া সহোদর ও বন্ধুবান্ধবদিগকে পরিত্যাগপূর্ব্বক কোথায় গমন করিবে? ইহা তোমার নিতান্ত অকৰ্তব্য বোধহয়, তুমি অনন্তবীৰ্য্য ভীষ্ম এবং ছিন্নভিন্ন পলায়নপর সৈন্যগণকে নিরীক্ষণ করিয়া নিশ্চয়ই ভীত হইয়াছ, এই নিমিত্ত তোমার মুখমণ্ডলের প্রফুল্লতা নাই। তুমি আজি আমার আজ্ঞানুবর্ত্তী মহাবীর ধনঞ্জয়ের সহিত মিলিত ও পৃথিবীতে প্রখ্যাত হইয়া কি নিমিত্ত ভীষ্ম হইতে ভয়প্রাপ্ত হইতেছ?”

শিখণ্ডী-ভীমসেনসমরে কৌরবপলায়ন

“তখন শিখণ্ডী পাণ্ডবরাজ যুধিষ্ঠিরের অতি কঠোর বাক্য শ্রবণ করিয়া তিরস্কারবোধে ভীষ্মবধে যত্নবান হইলেন। মহাবীর শল্য তাঁহাকে ভীষ্মবিনাশার্থ ধাবমান দেখিয়া অনিবাৰ্য্য-অন্ত্রে নিবারণ করিলেন। দেবরাজসদৃশ প্রভাবশালী শিখণ্ডী সেই যুগান্তানলকল্প [প্ৰলয়বহ্নিতুল্য] শল্যাপ্রেরিত অস্ত্র নিরীক্ষণ করিয়া কিছুমাত্র বিমোহিত হইলেন না, প্ৰত্যুত শরনিকরে তাঁহার অস্ত্র নিবারণ করিয়া সেই স্থানে অবস্থানপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি নিক্ষেপ করিবার নিমিত্ত পুনরায় এক বারুণাস্ত্ৰ গ্ৰহণ করিলেন। পার্থিবগণ ও দেবলোকস্থিত দেবতাসকল অস্ত্ৰদ্বারা অস্ত্রনিবারণ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।

অনস্তর ভীষ্ম রাজা যুধিষ্ঠিরের বিচিত্র ধ্বজ ও কামুক ছেদন করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিলেন। ভীমসেন যুধিষ্ঠিরকে ভয়ে একান্ত অভিভূত দেখিয়া শর ও শরাসন পরিত্যাগ এবং গদা গ্রহণপূর্ব্বক পাদচারে জয়দ্রথের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর জয়দ্ৰথ গদাধারী ভীমকে মহাবেগে সহসা আগমন করিতে দেখিয়া ভীষণ যমদণ্ডসদৃশ শাণিত পঞ্চশতশরে তাঁহার চারিপার্শ্ব বিদ্ধ করিলেন। বৃকোদর সেইসকল শরজাল লক্ষ্য না করিয়াই রোষকষায়িতলোচনে সিন্ধুরাজ জয়দ্রথের অশ্বগণকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। অনন্তর সুররাজসদৃশ রাজকুমার চিত্রসেন ভীমসেনকে নিবারণ করিবার নিমিত্ত অস্ত্ৰ উদ্যত করিয়া তথায় আগমন করিলেন; ভীমও সহসা সিংহনাদ পরিত্যাগ ও গদা প্রদর্শনপূর্ব্বক তর্জ্জনগর্জ্জন করিয়া প্রতি গমন করিতে লাগিলেন। তখন কৌরবগণ সেই যমদণ্ডকল্প ভীষণ গদা উদ্যত অবলোকন করিয়া চিত্ৰসেনকে পরিত্যাগপূর্ব্বক গদাপাতপরিহার [গদা হইতে গাত্ররক্ষা] বাসনায় পলায়ন করিলেন। চিত্ৰসেন সেই গদাপাতের পূর্ব্বেই বিমল অসি ও চর্ম্ম গ্রহণপূর্ব্বক আচলশিখর [পর্ব্বতচূড়া] হইতে সিংহের ন্যায় নিৰ্ভয়ে রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া সমতল ভূতলে গমন করিলেন; দুৰ্য্যোধনপ্রভৃতি সকলেই চিত্রসেনের সেই বিচিত্র ব্যাপার নিরীক্ষণ করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন এবং সৈন্যগণসমভিব্যাহারে তাঁহার যথোচিত সৎকার করিলেন। ভীমনিমুক্ত গদা চিত্ৰসেনের রথ, অশ্ব ও সারথিকে বিনষ্ট করিয়া গগনমণ্ডল হইতে নিপতিত প্রজ্বলিত উল্কার ন্যায় ভূতলে পতিত হইল।”