০৭৩. অশ্বত্থামার সহিত অর্জ্জুনের যুদ্ধ

৭৩তম অধ্যায়

অশ্বত্থামার সহিত অর্জ্জুনের যুদ্ধ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে রাজন! অনন্তর বিরাট তিনটি বাণদ্বারা ভীষ্মকে এবং আর তিনটি বাণদ্বারা তাঁহার অশ্বগণকে বিদ্ধ করিলে ক্ষিপ্ৰহস্ত মহাবলপরাক্রান্ত ভীষ্ম সুবর্ণপুঙ্খসম্পন্ন দশশরে বিরাটকে বিদ্ধ করিলেন। দৃঢ়হস্ত অশ্বত্থামা দশবাণে অর্জ্জুনের বক্ষঃস্থলে আঘাত করিলে অর্জ্জুন তাঁহার কার্ম্মুক ছেদন করিয়া সুতীক্ষ্ন পাঁচবাণে তাঁহাকে আহত করিলেন। অশ্বত্থামা অর্জ্জুনকৃত কার্ম্মুকচ্ছেদ সহ্য করিতে না পারিয়া ক্রোধভরে অন্য শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক নবতিশরে অর্জ্জুনকে ও সপ্ততিশরে বাসুদেবকে বিদ্ধ করিলে অর্জ্জুন ক্ৰোধে রক্তলোচনা হইয়া দীর্ঘ ও উষ্ণ নিশ্বাসসহকারে বারংবার চিন্তা করিয়া বামকরদ্বারা গাণ্ডীবশরাসন ধারণপূর্ব্বক শাণিত জীবান্তঃকর অতি ভয়ঙ্কর শরসমূহে অশ্বত্থামাকে অনবরত বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। অর্জ্জুনের শরজাল অশ্বত্থামার বর্ম্ম ভেদ করিয়া শোণিত পান করিল; কিন্তু তিনি কিছুমাত্র ব্যথিত বা বিহ্বল না হইয়াই অর্জ্জুনের প্রতি শর পরিত্যাগ ও ভীষ্মকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত সমরে অবস্থান করিতে লাগিলেন। তিনি যে কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, কৌরবগণ তাঁহার এই মহৎকাৰ্য্যের ভূয়সী প্রশংসা করিতে প্ৰবৃত্ত হইলেন। তিনি দ্রোণাচাৰ্য্য হইতে প্রয়োগ-সংহারের সহিত দুর্লভ অস্ত্ৰ লাভ করিয়াছিলেন; এক্ষণে লোকের অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চারপূর্ব্বক প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। ‘ইনি আমার আচাৰ্য্যের প্রিয়পুত্র ও আমার পূজনীয়, বিশেষতঃ ব্ৰাহ্মণ’, শক্ৰতাপন অর্জ্জন এইরূপ বিবেচনা করিয়া অশ্বত্থামাকে কৃপাপ্রদর্শনপূর্ব্বক পরিত্যাগ করিয়া সত্বর কৌরবসেনা সংহারে প্রবৃত্ত হইলেন।

ভীম-দুৰ্য্যোধনযুদ্ধ

“মহারাজ দুৰ্য্যোধন সুবর্ণপুঙ্খ শিলাশিত দশশরে মহাধনুৰ্দ্ধর ভীমসেনকে নিতান্ত ব্যথিত করিলেন। ভীমও ক্রোধাবিষ্ট হইয়া প্রাণান্তকর বিচিত্ৰ কামুক ও নিশিত শরসকল গ্রহণ করিলেন এবং অবিচলিতচিত্তে মহাবেগশালী ও তেজঃসম্পন্ন শরনিকরে কর্ণ পৰ্য্যন্ত আকর্ষণ করিয়া কুরুরাজ দুৰ্য্যোধনের বক্ষঃস্থলে আঘাত করিলেন। তখন তাঁহার বক্ষঃস্থলে কাঞ্চনসূত্রগ্রথিত [সরু সোণার হার] মণি শরজালে পরিবৃত হইয়া গ্ৰহগণপরিবেষ্টিত দিবাকরের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। যেমন মাতঙ্গ তলশব্দ সহ্য করিতে পারে না, তদ্রূপ দুৰ্য্যোধন মাতঙ্গের ন্যায়৷ ভীমসেনের তলশব্দ সহ্য করিতে অসমর্থ ও নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া সৈন্যগণকে পরিত্রাণ করিবার নিমিত্ত শিলাশিত শরজালদ্বারা ভীমসেনকে বিদ্ধ করিলেন। এইরূপে সেই দেবতুল্য বীরদ্বয় পরস্পর ক্ষতবিক্ষতকলেবর হইযা শোভমান হইতে লাগিলেন।

“অনন্তর দেবরাজতুল্য অভিমন্যু নিশিতশরজালে চিত্ৰসেনকে, সাতশরে পুরুমিত্ৰকে এবং অন্য সাতশরে ভীষ্মকে বিদ্ধ করিয়া যেন নৃত্য করিতে লাগিলেন। তদর্শনে আমাদের মনে সাতিশয় ক্লেশসঞ্চার হইল। পরে চিত্ৰসেন দশশরে, সত্যব্রত নয়শরে এবং পুরুমিত্র সাতশরে অভিমন্যুকে বিদ্ধ করিলে তাঁহার কলবর হইতে রুধিরাক্ষরণ হইতে লাগিল। তখন তিনি চিত্ৰসেনের শক্রবারণ বিচিত্র শরাসন ছেদন এবং তাঁহার বর্ম্ম ভেদ করিয়া বক্ষঃস্থলে প্রহার করিলেন। আপনার পক্ষীয় বীর ও মহারথ রাজকুমারসকল রোষাবিষ্ট ও সমবেত হইয়া শাণিত শরনিকরদ্ধারা অভিমন্যুকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। পরমাস্ত্রবেত্তা অভিমন্যুও তাঁহাদিগকে প্রহার করিতে প্ৰবৃত্ত হইলেন।

অভিমন্যু-লক্ষ্মণযুদ্ধ

“অনন্তর দুৰ্য্যোধনপ্রভৃতি মহাবীর সকল অভিমন্যুর এই অদ্ভুত কাৰ্য্য নিরীক্ষণ করিয়া চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিলেন। যেমন গ্ৰীষ্মকালে প্রবল হুতাশন তৃণসকল দগ্ধ করিয়া থাকে, তদ্রূপ অভিমন্যু কৌরবসেনা বিনাশ করিয়া শোভাপ্রাপ্ত হইতে লাগিলেন। হে মহারাজ! আপনার পৌত্র লক্ষ্মণ অভিমন্যুর এইরূপ কাৰ্য্য নয়নগোচর করিয়া অবিলম্বে তাঁহাকে আক্রমণ করিলেন; অভিমন্যু নিতান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ছয়বাণে শুভলক্ষণসম্পন্ন তাঁহার সারথিকে বিদ্ধ করিলেন; লক্ষ্মণও শাণিত শরনিকরদ্ধারা সৌভদ্রকে [অভিমন্যুকে] বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের যুদ্ধ অতি অদ্ভুত বলিয়া প্রতীয়মান হইতে লাগিল। অভিমন্যু লক্ষ্মণের চারি অশ্ব ও সারথিকে সংহার করিয়া তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। লক্ষ্মণ সেই হতাশ্বরথে [বিনষ্ট অশ্ব] অবস্থান করিয়াই অভিমন্যু-রথোপরি এক শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। অভিমন্যু তীক্ষ্ন শরদ্বারা সেই ঘোররূপ অজগরসদৃশ দুরাসদ শক্তি খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তখন কৃপাচাৰ্য্য সর্ব্বসৈন্যসমক্ষে লক্ষ্মণকে স্বরথে আরোপিত করিয়া রণস্থল হইতে লইয়া গেলেন। এইরূপে সেই সমর ভীষণ হইয়া উঠিলে বীরপুরুষেরা পরস্পর সংহারে উদ্যত হইয়া ধাবমান হইলেন। আপনার পক্ষীয় মহারথীসকল জীবিতাশা বিসর্জ্জন করিয়া পরস্পরের প্রাণনাশ করিতে লাগিলেন। সৃঞ্জয়গণ বিমুক্তকেশপাশা [আলুলায়িত কেশ], শূন্যকবচ, ছিন্নকার্ম্মুক [ছিন্নধনু] ও বিরথ হইয়া কৌরবদিগের সহিত বাহুযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইল। অনন্তর মহাবলপরাক্রান্ত ভীষ্ম দিব্যাস্ত্রজাল বিস্তার করিয়া ক্রোধভরে পাণ্ডবদিগের সৈন্য সংহার করিতে লাগিলেন। তখন নিহত আরোহী, গজ, অশ্ব, মনুষ্য, রথী ও সাদিসকল নিপতিত হইলে সমরভূমি সমাকীর্ণ হইয়া উঠিল।”