০৫৩. দ্রোণ-ধৃষ্টদ্যুম্নযুদ্ধ

৫৩তম অধ্যায়

দ্রোণ-ধৃষ্টদ্যুম্নযুদ্ধ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাধনুৰ্দ্ধর দ্রোণ ও ধৃষ্টদ্যুন্ন কিরূপে সংগ্রাম করিয়াছিলেন? আমি অদৃষ্টকে পুরুষকার অপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ জ্ঞান করি। দেখ, মহাবীর শান্তনুতনয়ও অর্জ্জুনকে সংগ্রামে পরাজিত করিতে পারিলেন না। যে ভীষ্ম ক্রুদ্ধ হইলে সমরে সমুদয় লোক বিনষ্ট করিতে পারেন, তিনিই সংগ্রামে অর্জ্জুনের নিকট পরাভূত হইলেন। অদৃষ্ট ব্যাতীত ইহার অন্য কারণ কি আছে?”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! অতি দারুণ সংগ্রামবৃত্তান্ত কীর্ত্তন করিতেছি, স্থিরচিত্তে শ্রবণ করুন। ইন্দ্ৰসমবেত সমুদয় দেবগণ একত্রিত হইলেও মহাবীর অর্জ্জুনকে পরাজিত করিতে পারেন না। যাহা হউক, এক্ষণে দ্রোণ ও ধৃষ্টদ্যুম্নের সংগ্রামবৃত্তান্ত শ্রবণ করুন। মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য বিবিধ শরদ্বারা ক্ৰোধপরায়ণ ধৃষ্টদ্যুম্নকে ও ভল্লদ্বারা তাঁহার সারথিকে রথ হইতে নিপাতিত করিয়া ক্ৰোধাভরে তাঁহার চারি অশ্বের উপর বাণ নিক্ষেপ করিলেন। তখন মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন নবতিবাণে দ্রোণাচাৰ্য্যকে বিদ্ধ করিয়া ‘থাক থাক’ বলিয়া দৰ্প করিতে লাগিলেন। অসামান্য বলবিক্রমশালী দ্রোণাচাৰ্য্য অমর্ষপরায়ণ ধৃষ্টদ্যুম্নকে পুনরায় শরনিকরে সমাচ্ছাদিত করিয়া সংহার করিবার মানসে ভীষণ অশনির ন্যায়, দ্বিতীয় যমদণ্ডের ন্যায় এক বাণ গ্ৰহণ করিলেন। অস্ত্রবিদগণের অগ্রগণ্য দ্রোণাচাৰ্য্যকে সেই শরসন্ধান করিতে দেখিয়া সমুদয় সেনাগণ উচ্চৈঃস্বরে হাহাকার করিতে লাগিল। ঐ সময় মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্নের অদ্ভূত পৌরুষ প্রকাশিত হইল, তিনি পর্ব্বতের ন্যায় অচলভাবে অবস্থানপূর্ব্বক সেই সাক্ষাৎ মৃত্যুসদৃশ দ্রোণবিমুক্ত বাণ অৰ্দ্ধপথে ছেদন করিয়া ভরদ্বাজের উপর শরবৃষ্টি করিতে আরম্ভ করিলেন। পাঞ্চাল ও পাণ্ডবগণ ধৃষ্টদ্যুম্নের সেই সুদুষ্কর কর্ম্ম দেখিয়া হৰ্ষোৎফুল্লচিত্তে আনন্দধ্বনি করিতে লাগিলেন।

“অনন্তর মহাবীর ধৃষ্টদ্যুন্ন দ্রোণবধাভিলাষে স্বর্ণ ও বৈদূৰ্য্যে খচিত মহাবেগশালিনী শক্তি নিক্ষেপ করিলে ধনুৰ্দ্ধরাগ্রগণ্য দ্রোণ হাসিতে হাসিতে তাহা অৰ্দ্ধপথেই তিন খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। প্রতাপশালী ধৃষ্টদ্যুম্ন শক্তি ব্যর্থ হইল দেখিয়া দ্রোণের উপর বাণবৃষ্টি করিতে আরম্ভ করিলে মহারথ দ্রোণ ক্ষণকালমধ্যেই সেই শরনিকর নিবারণপূর্ব্বক ধৃষ্টদ্যুম্নের শরাসন ছেদন করিলেন। মহাযশাঃ দ্রুপদতনয় কামুক ছিন্ন হওয়াতে ক্রোধান্ধ হইয়া দ্রোণের বধাভিলাষে তাঁহার উপর দৃঢ় গদা নিক্ষেপ করিলে বলবিক্রমশালী আচাৰ্য্য দ্রোণ স্বীয় পরাক্রম প্রদর্শনপূর্ব্বক তাহা নিবারণ করিয়া সুশাণিত ভল্লসকল ধৃষ্টদ্যুম্নের উপর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। ভল্লাসমুদয় দ্রুপদতনয়ের বর্ম্ম ভেদ করিয়া রুধির পান করিতে লাগিল; তখন মহামনাঃ খৃষ্টদ্যুন্ন অন্য শরাসন গ্রহণ করিয়া পরাক্রমপ্রকাশপূর্ব্বক পাঁচবাণদ্বারা দ্রোণকে বিদ্ধ করিলেন। তৎকালে তাঁহারা উভয়েই রুধিরাক্তকলেবর হইয়া বসন্তকালীন পুষ্পিত কিংশুকতরুর ন্যায় শোভমান হইলেন।

“মেঘ যেমন পর্ব্বতোপরি বারি বর্ষণ করে, তদ্রূপ মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য ক্ৰোধে অধীর হইয়া পুনরায় দ্রুপদতনয়ের শরাসন ছেদনপূর্ব্বক তাঁহার উপর সন্নতপর্ব্ব শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। পরে এক ভল্লদ্বারা তাঁহার সারথিকে ও চারিবাণে চারি-অশ্ব সংহার করিয়া সিংহনাদ করিয়া অন্য এক ভিন্নদ্বারা শরাসন ছেদন করিলেন। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন এইরূপে ছিন্নধন্বা, বিরথ, হতাশ্ব ও হতসারথি হইয়া গদা গ্রহণপূর্ব্বক আপনার পৌরুষ প্রকাশ করিয়া, রথ হইতে অবতরণ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর দ্রোণ দ্রুপদতনয় রথ হইতে অবরোহণ [অবতরণ—নীচে নামা] না করিতে করিতেই শরনিকদ্বারা তাঁহার গদা ছেদন করিয়া ফেলিলেন, তদর্শনে সকলেই আশ্চৰ্য্যান্বিত হইল। আমিষাভিলাষী [মাংসলোলুপ] সিংহ যেমন মত্তগজের প্রতি ধাবমান হয়, তদ্রূপ মহাবাহু দ্রুপদানন্দন শতচন্দ্ৰসংযুক্ত সুবিপুল চর্ম্ম ও দিব্যখড়্গ ধারণপূর্ব্বক দ্রোণবধের আকাঙক্ষায় মহাবেগে ধাবমান হইলেন। ঐ সময় মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্যের পুরুষকার, অস্ত্ৰপ্ৰয়োগলাঘব ও অসাধারণ বাহুবল প্রকাশিত হইল। ঐ মহাবীর একাকী বাণবৃষ্টি করিয়া ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। দ্রুপদতনয় অসামান্য বলশালী হইয়াও কোনক্রমে দ্রোণের সম্মুখীন হইতে পারিলেন না; কেবল চর্ম্মদ্বারা দ্রোণবিমুক্ত শরনিকর নিবারণ করিতে লাগিলেন।

“সেই সময় মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর দ্রুপদতনয়ের সাহায্যার্থে সহসা তথায় সমুপস্থিত হইয়া দ্রোণের উপর সাতবাণ নিক্ষেপপূর্ব্বক সত্বর ধৃষ্টদ্যুম্নকে অন্য রথে আরোপিত করিলেন। তখন মহারাজ দুৰ্য্যোধন দ্রোণের রক্ষার্থ প্রভুত সৈন্যসমবেত কলিঙ্গদেশাধিপতিকে প্রেরণ করিলেন। সেই সমুদয় কলিঙ্গদেশীয় সৈন্য দুৰ্য্যোধনের আদেশানুসারে ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইল। রথিশ্রেষ্ঠ দ্রোণ তখন ধৃষ্টদ্যুম্নকে পরিত্যাগপূর্ব্বক এককালে বৃদ্ধ বিরাট ও দ্রুপদী উভয়ের সহিত সংগ্রাম করিতে লাগিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নও ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সহিত মিলিত হইলেন। হে মহারাজ! কলিঙ্গদেশীয় সৈন্যগণের সহিত ভীমসেন ঘোরতর লোমহর্ষণ সংগ্রাম করিতে লাগিল; ঐ যুদ্ধ জগতের ক্ষয়কর বলিয়া প্রতীয়মান হইল।”