০৯৬. দুৰ্য্যোধনের ঘটোৎকচবিনাশের প্রার্থনা

৯৬তম অধ্যায়

দুৰ্য্যোধনের ঘটোৎকচবিনাশের প্রার্থনা

সঞ্জয় কহিলেন, “অনন্তর রাজা দুৰ্য্যোধন ভীষ্মসন্নিধানে সমুপস্থিত ও বিনয়াবনত হইয়া অভিবাদনপূর্ব্বক বারংবার দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া ঘটোৎকচের বিজয় ও আপনার পরাজয়বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত সমস্ত বৰ্ণনা করিতে লাগিলেন, “হে পিতামহ! যেমন পাণ্ডবেরা বাসুদেবের আশ্রয় লইয়াছে, তদ্রূপ আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করিয়া তাহাদিগের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছি। আমার একাদশ-অক্ষৌহিণী সেনা আমার সহিত আপনার আজ্ঞা প্রতিপালন করিতেছে; তথাচ ভীমসেনাপ্রমুখ পাণ্ডবেরা ঘটোৎকচকে আশ্রয় করিয়া আমাকে সমরে পরাজয় করিল। যেমন নীরস বৃক্ষ অনলসংযোগে দগ্ধ হয়, তদ্রূপ আমার সর্ব্বাঙ্গ ক্ৰোধে নিরন্তর দগ্ধ হইতেছে। আমি আপনার প্রসাদে ও আশ্রয়ে সেই রাক্ষসাধমকে বিনাশ করিতে অভিলাষ করি; অতএব আপনি তাঁহার উপায়বিধান করুন।”

“তখন মহাবীর ভীষ্ম দুৰ্য্যোধনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হে রাজন! আমি তোমাকে যাহা যাহা কহিব এবং তুমি যেরূপ অনুষ্ঠান করিবে, তাহা শ্রবণ কর। তুমি সকল অবস্থায় আত্মরক্ষায় সাবধান হইয়া পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ করিবে। রাজধর্ম্মানুসারে রাজার রাজার সহিতই যুদ্ধ করা কর্ত্তব্য। আমি, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, কৃতবর্ম্মা, শল্য, ভূরিশ্রবা, বিকর্ণ ও দুঃশাসন প্রভৃতি তোমার ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে তোমারই কাৰ্য্যসাধনোদ্দেশে রাক্ষস ঘটোৎকচের সহিত যুদ্ধ করিব। অথবা যদি রাক্ষস ঘটোৎকচ একান্তই তোমার হৃদয়তাপস্বরূপ হইয়া থাকে, তাহা হইলে সংগ্রামে পুরন্দরতুল্য ভূপতি ভগদত্ত তাহার সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত রণস্থলে গমন করুন।” এই বলিয়া ভীষ্ম সর্ব্বসমক্ষে মহাবীর ভগদত্তকে কহিলেন, “হে মহারাজ! পূর্ব্বে যেমন দেবরাজ তারকাসুরকে নিবারণ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তুমি শীঘ্ৰ গমন করিয়া সকল ধনুৰ্দ্ধরদিগের সমক্ষে যত্নসহকারে সেই যুদ্ধদুর্ম্মদ রাক্ষসাধমকে নিবারণ করা। তোমার অস্ত্ৰজাল দিব্য ও তোমার পরাক্রম অতি অদ্ভুত এবং পূর্ব্বে তুমি অসুরগণের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলে; সুতরাং রাক্ষস ঘটোৎকচ তোমারই প্রতিযোদ্ধা। এক্ষণে তুমি সেই বলদৃপ্ত রাক্ষসকে অবিলম্বে বিনাশ কর।”

ভীষ্মাদেশে ঘটোৎকচসহ যুদ্ধার্থ ভগদত্তের যাত্রা

“মহারাজ ভগদত্ত পৃতিন[সেনা]পতি ভীষ্মের বাক্য শ্রবণানন্তর সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক সুপ্রতীকনামে এক হন্তীর উপর আরোহণ করিয়া শক্রগণের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। ভীম, অভিমন্যু, ঘটোৎকচ, দ্ৰৌপদীর পঞ্চপুত্র, সত্যধৃতি, ক্ষত্রদেব, চেদিপতি বসুদান ও দশার্ণাধিপতি গভীরনিঃস্বন ঘনমণ্ডলের ন্যায় তাঁহাকে আগমন করিতে দেখিয়া রোষাভরে গমন করিতে লাগিলেন। অনন্তর পাণ্ডবগণের সহিত ভগদত্তের যমরাষ্ট্রবিবৰ্দ্ধন ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। রথিগণমুক্ত শরনিকর মহাবেগে হস্তী ও রথের উপর নিপতিত হইতে লাগিল। আরোহীদিগের প্রযত্নে সুশিক্ষিত করিকুল ভিন্নগাত্ৰ হইয়াও নির্ভীকের ন্যায় পরস্পরের উপর নিপতিত হইল এবং মদান্ধি ও ক্ৰোধসন্ধুক্ষিত হইয়া বিশাল দশনাগ্রদ্বারা পরস্পরকে ভেদ করিতে লাগিল। চামরে অলঙ্কৃত প্রাসধারী পুরুষে সমারূঢ় অশ্বসকল আরোহীকর্ত্তৃক চালিত হইয়া নির্ভীকের ন্যায় সত্বর সমুপস্থিত হইল; শত-শত সহস্ৰ-সহস্ৰ পদাতিসৈন্যকর্ত্তৃক শক্তি ও তোমরসমূহে আহত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল। রথিসকল কর্ণি, নালীক, সায়ক ও রথ দ্বারা বীরগণকে বিনাশ করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন।

ভীমাদি-বীরসহায় ঘটোৎকচের ভগদত্তসহ যুদ্ধ

“তখন ভগদত্ত প্রস্রবণশালী [ঝরণাযুক্ত] পর্ব্বতসদৃশ মদস্রাবী কুঞ্জরে আরোহণপূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে শরবর্ষণ করিতে করিতে ঐরাবতসমারারূঢ় দেবরাজ ইন্দ্রের ন্যায় 
ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইয়া শরধারাদ্বারা তাঁহাকে প্রহার করিতে প্ৰবৃত্ত হইলেন। তৎকালে বোধ হইল যেন, বর্ষাকালে জলদজাল প
র্ব্বতে জলধারা বর্ষণ করিতেছে। ভীমসেন রোষাপরবশ হইয়া তাঁহার শতাধিক পাদরক্ষককে সায়কদ্বারা বিনাশ করিলেন। তদ্দর্শনে ভগদত্ত ক্রুদ্ধ হইয়া ভীমের রথাভিমুখে হস্তী চালন করিলেন। করিবর ভগদত্তকর্ত্তৃক পরিচালিত হইয়া জ্যাবিনির্ম্মুক্ত সায়কের ন্যায় মহাবেগে ভীমের প্রতি ধাবমান হইল। তখন পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণ, ভীমসেনকে অগ্ৰে লইয়া মহাবেগে গমন করিতে লাগিলেন। অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, দশর্ণাধিপতি ক্ষত্রদেব, চেদিপতি চিত্ৰকেতু ও কেকয়গণ ক্রোধাবিষ্ট হইয়া দিব্যাস্ত্ৰজাল বিস্তার করিয়া সেই একমাত্র কুঞ্জরকে বেষ্টন করিলেন। তখন সেই হস্তী শরবিদ্ধ হইয়া রুধিরধারা বর্ষণ করিয়া গৈরিকচিত্ৰিত হিমাচলের ন্যায় অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিল।

“অনন্তর দশার্ণাধিপতি পর্ব্বতসদৃশ এক গজে আরোহণ করিয়া ভগদত্তের হস্তীর প্রতি ধাবমান হইলেন। যেমন তীরভূমি মহাসাগরকে [সাগরের উচ্ছলিত জলবেগ] নিবারণ করে, তদ্রূপ ভগদত্তের সুপ্ৰতীক [দিগ্‌গজ] সেই প্রতিহস্তীকে [বিপক্ষ হস্তীকে] নিবারণ করিলে দশার্ণাধিপতির হস্তীও সুপ্ৰতীককে নিবারণ করিল; তদ্দর্শনে পাণ্ডবগণ ও তাঁহাদের সৈন্যসকল সাধুবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন। অনন্তর প্রাগজ্যোতিষেশ্বর ক্রুদ্ধ হইয়া বিপক্ষ নাগের প্রতি চতুর্দ্দশ তোমর প্রয়োগ করিলে উহা তাহার সুবর্ণখচিত বর্ম্ম ভেদ করিয়া, বল্মীকিমধ্যে ভুজঙ্গের প্রবেশের ন্যায় শরীরে প্রবেশ করিল। দশার্ণাধিপতির হস্তী গাঢ়বিদ্ধ ও নিতান্ত ব্যথিত হইয়া মদরক্ষরণ ও প্রচণ্ড রব পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বীয় সৈন্যগণকে বিমর্দ্দিত করিয়া মহাবেগে ধাবমান হইল; বোধ হইল যেন, বায়ু বেগবলে পাদপদল বিমর্দ্দিত করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছে।

ভগদত্তচালিত গজভয়ে পাণ্ডববিমর্ষ

“দশার্ণাধিপতির হস্তী পরাজিত হইলে পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণ যুদ্ধের নিমিত্ত প্ৰস্তুত হইয়া ভীমসেনকে পুরস্কৃত করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ অস্ত্রশস্ত্র বর্ষণ করিতে করিতে ভগদত্তের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহারাজ ভগদত্ত সেইসকল রোষাপরবশ বীরগণের ঘোরতর সিংহনাদ শ্রবণ করিয়া অমৰ্ষভরে ভয় পরিত্যাগপূর্ব্বক সুপ্ৰতীককে প্রেরণ করিলেন। করিবর অঙ্কুশে আহত হইবামাত্র তৎক্ষণাৎ সম্বর্ত্তক অনলের ন্যায় রোষাভরে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল এবং রথ, হস্তী, অশ্ব, আরোহী ও শতসহস্ৰ। পদাতিসৈন্য বিমর্দ্দিত করিয়া ধাবমান হইল। তখন হুতাশনসন্তপ্ত । চর্ম্মের ন্যায় পাণ্ডবসৈন্য নিতান্ত সঙ্কুচিত হইয়া গেল।

ঘটোৎকচের যুদ্ধদৰ্শনে পাণ্ডবহর্ষ

“ইত্যবসরে দীপ্তান্য [নিৰ্গত শিখাসমন্বিত মুখ-নয়ন], দীপ্তলোচন, মহাবীর ঘটোৎকচ আতি বিকট আকার পরিগ্রহ করিয়া রোষাভরে প্রজ্বলিত পর্ব্বত বিদারণ স্ফুলিঙ্গমালাকরাল [অগ্নিকণা বিনির্গত হওয়ার ভীষণ দৃশ্য] এক শূল গ্রহণপূর্ব্বক ভগদত্তের প্রতি ধাবমান হইলেন এবং তাঁহার হস্তীকে সংহার করিবার নিমিত্ত শূল নিক্ষেপ করিলে ভগদত্ত অতি দারুণ সুতীক্ষ্ন অৰ্দ্ধচন্দ্ৰবাণ নিক্ষেপ করিয়া উহা ছেদন করিলেন। শূল দুই খণ্ডে ছিন্ন হইবামাত্র দেবরাজবিনির্ম্মুক্ত অশনির ন্যায় তৎক্ষণাৎ ভূতলে নিপতিত হইল। পরে তিনি অনলশিখাসদৃশ সুবর্ণদণ্ড শক্তি গ্রহণপূর্ব্বক ‘থাক থাক’ বলিয়া রাক্ষসের উপর নিক্ষেপ করিলেন। ঘটোৎকচ নভোমণ্ডলগত বজ্রেরর ন্যায় শক্তি নিরীক্ষণপূর্ব্বক তৎক্ষণাৎ উত্থিত হইয়া উহা গ্ৰহণ করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। এবং ভগদত্তের সমক্ষেই জানুদ্বারা উহা ভগ্ন করিয়া ফেলিলেন। উহা নিতান্ত অদ্ভুত বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। দেবলোকে দেবতা ও মহর্ষিগণ রাক্ষসের এই অদ্ভূত কাৰ্য্য অবলোকন করিয়া নিতান্ত বিস্মিত হইলেন। ভীমসেনপুরঃসর পাণ্ডবগণ সাধুবাদপ্রদানপূর্ব্বক সিংহনাদে রণক্ষেত্র প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিলেন। ভগদত্ত একান্ত হৃষ্ট পাণ্ডবদিগের সিংহনাদ শ্রবণ করিয়া নিতান্ত অসহিষ্ণু হইয়া উঠিলেন এবং অশনিসমপ্ৰভ শরাসন বিস্ফারণপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের মহারথদিগের প্রতি তর্জ্জনগর্জ্জন করিয়া অনলসঙ্কাশ। সুতীক্ষ শরজাল বর্ষণ করিয়া একবাণে ভীম, নয়শরে ঘটোৎকচ, তিনবাণে অভিমন্যু ও পাঁচশরে কেকয়গণকে বিদ্ধ করিলেন। পরে আকৰ্ণকৃষ্ট শরাসনবিনির্ম্মুক্ত শরে ক্ষত্রদেবের দক্ষিণবাহু ভেদ করিলে তাঁহার হস্ত হইতে তৎক্ষণাৎ শর ও কামুক নিপতিত হইল। পরিশেষে ভগদত্ত পঞ্চশরে দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রকে প্রহার করিয়া ক্ৰোধাভরে ভীমের অশ্বগণকে বিনাশপূর্ব্বক তিনবাণে তাঁহার সিংহলাঞ্ছিত ধ্বজ ছেদন ও অন্য বাণে সারথিকে বিদ্ধ করিলেন। ভীমসারথি বিশোক গাঢ়বিদ্ধ ও নিতান্ত ব্যথিত হইয়া রথোপস্থে উপবেশন করিল।

অর্জ্জুনের ভীমমুখে ইরাবানের মৃত্যুশ্রবণ

“অনন্তর মহাবীর ভীমসেন গদা গ্রহণপূর্ব্বক রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া মহাবেগে গমন করিতে লাগিলেন। তখন কৌরবগণ সশৃঙ্গ শৈলের ন্যায় তাঁহাকে আগমন করিতে নিরীক্ষণ করিয়া নিতান্ত ভীত হইলেন। যে স্থানে পিতাপুত্ৰ ভীমসেন ও ঘটোৎকচ প্ৰাগজ্যোতিষেশ্বর ভগদত্তের সহিত সমর করিতেছেন, মহাবীর অর্জ্জুন চতুর্দ্দিকে শত্ৰুগণকে বিনাশ করিতে করিতে তথায় আগমন করিলেন এবং ভ্রাতৃগণকে যুদ্ধ করিতে দেখিয়া তৎক্ষণাৎ সমরে প্ৰবৃত্ত হইয়া শরনিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে রাজা দুৰ্য্যোধন সত্বর রথমাতঙ্গ সমাকীর্ণ সৈন্যগণকে প্রেরণ করিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন সেইসকল কৌরবসৈন্যের প্রতি মহাবেগে ধাবমান হইলেন। মহারাজ ভগদত্ত স্বীয় হস্তীদ্বারা পাণ্ডবসৈন্যকে বিমর্দ্দিত করিয়া ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি গমন করিতে লাগিলেন। তখন উদ্যতায়ুধ পাঞ্চাল, সৃঞ্জয় ও কেকয়গণের সহিত ভগদত্তের ঘোরতর যুদ্ধ হইতে লাগিল। এই অবসরে ভীমসেন কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনসন্নিধানে ইরাবানের বধবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত সমস্ত বর্ণন করিলেন।”