০৮৪. ধৃতরাষ্ট্রের সখেদ সমরপ্রশ্ন

৮৪তম অধ্যায়

ধৃতরাষ্ট্রের সখেদ সমরপ্রশ্ন

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমি তোমার মুখে আমার পক্ষীয় বীরগণের সহিত পাণ্ডবদিগের বহুবিধ বিচিত্র দ্বৈরথযুদ্ধ শ্ৰবণ করিলাম, কিন্তু তুমি আমার পক্ষীয়দিগকে হৃষ্ট ও সন্তুষ্ট বলিয়া নির্দেশ করিতেছ না; কেবল পাণ্ডবদিগকেই প্রতিনিয়ত হৃষ্ট ও অপরাজিত বলিয়া কীর্ত্তন করিতেছ। যাহা হউক, এক্ষণে পরাজিত, হীনতেজঃ ও বিমনায়মান আত্মজগণের বিষয় কীর্ত্তন কর। আমি নিশ্চয় বুঝিতেছি, এ সকল অদৃষ্টের কর্ম্ম।”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আপনার পক্ষীয় বীরগণ অদ্ভুত পৌরুষ প্রদর্শনপূর্ব্বক শক্তি ও উৎসাহ অনুসারে যুদ্ধ করিতেছেন, কিন্তু যেমন সুরনদী ভাগীরথীর সুস্বাদু সলিল মহাসাগর সংসর্গে লবণতা প্রাপ্ত হয়, তদ্রূপ কৌরবগণের পৌরুষ পাণ্ডবগণকে প্রাপ্ত হইয়া নিতান্ত ব্যর্থ হইয়া থাকে। আপনি সেই সমস্ত দুষ্কর্যকর্ম্ম যত্নশীল বীরগণের প্রতি দোষারোপ করিবেন না। আপনার ও আপনার পুত্ৰগণের অপরাধেই যমরাজ্যবিবৰ্দ্ধন ও এই বসুন্ধরার ঘোরতর ক্ষয় উপস্থিত হইয়াছে। যখন আপনার অপরাধে ইহা উৎপন্ন হইতেছে, তখন এ বিষয়ে শোক করা নিতান্ত অকর্ত্তব্য। এই সংগ্রামে ভূপালগণ কোনক্রমেই প্রাণ রক্ষা করিতে পরিবেন না। তাঁহারা পুণ্যকর্ম্মদিগের সলোকতা[সালোক্য-সমানলোক]লাভে লোলুপ হইয়া প্রতিনিয়ত সৈন্যসাগরে অবগাহনপূর্ব্বক যুদ্ধ করিয়া থাকেন। হে মহারাজ! পূর্ব্বাহ্ণে যুদ্ধ উপস্থিত হইল, আপনি একমনা হইয়া সেই দেবাসুরসদৃশ সংগ্রামের বিষয় শ্রবণ করুন।

পাণ্ডবসৈন্যকর্ত্তৃক কৌরবসৈন্যনিধন

“যুদ্ধদুর্ম্মদ অবন্তিদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ মহাবীর ইরাবানের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন তাঁহাদিগের তুমুল লোমহর্ষণ সংগ্রাম উপস্থিত হইল। ইরাবান ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সেই দেবরূপী

বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। উভয়পক্ষই শত্রুবিনাশে উদ্যত ও প্রতীকারনিরত, তৎকালে তাঁহাদিগের কিছুমাত্র ইতরবিশেষ লক্ষিত হইল না। অনন্তর ইরাবান চারিশরে অনুবিন্দের চারি অশ্বকে বিনাশ করিয়া সুতীক্ষ্নভল্লদ্বারা তাহার কার্ম্মুক ও ধ্বজ ছেদন করিলেন; তখন উহা অতি অদ্ভুত বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। অনুবিন্দ স্বীয় রথ পরিত্যাগপূর্ব্বক বিন্দের রথে আরোহণ করিয়া সুদৃঢ় ভারসহ এক শরাসন গ্রহণ করিলেন এবং উভয়ে সমবেত হইয়া ইরাবানের উপর অনবরত শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। ঐ সমস্ত কাঞ্চনভূষিত মহাবেগশালী শরনিকর আকাশমণ্ডল আচ্ছন্ন করিল। তখন ইরাবান রোষাবিষ্ট হইয়া বিন্দ ও অনুবিন্দের প্রতি শরবৃষ্টি করিয়া তাঁহাদের সারথিকে নিপাতিত করিলেন। সারথি ভূতলে নিপতিত ও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইলে অশ্বসকল রথ লইয়া ইতস্ততঃ ভ্ৰমণ করিতে লাগিল। এইরূপে ইরাবান বিন্দ ও অনুবিন্দকে পরাজয় করিয়া আপনার পৌরুষ প্রকাশপূর্ব্বক কৌরবসেনাগণকে প্রহার করিতে লাগিলেন। মনুষ্য যেমন বিষপান করিয়া নানাবিধ অঙ্গবিক্ষেপ করিয়া থাকে, কৌরবসেনাসকল অস্ত্রশস্ত্রপ্রহারে জর্জ্জরিত হইয়া তাদৃশ অবস্থা প্ৰকাশ করিতে লাগিল।

ঘটোৎকচ ভগদত্ত যুদ্ধ—ঘটোৎকচের পলায়ন

“অনন্তর হিড়িম্বাতনয় ধ্বজপাটমণ্ডিত আদিত্যসঙ্কাশ রথে আরোহণ করিয়া নৃপতি ভগদত্তের প্রতিগমন করিলেন। যেমন দেবরাজ ইন্দ্র তারকাময় সংগ্রামে নাগরাজোপরি অবস্থান করিয়াছিলেন, তদ্রূপ প্ৰাগজ্যোতিষেশ্বর ভগদত্ত নাগরাজোপরি অবস্থান করিতেছিলেন। সমাগত দেবতা, ঋষি ও গন্ধর্ব্বগণ উভয়ের কিছুমাত্র ইতরবিশেষ অবগত হইতে সমর্থ হইলেন না। যেমন সুররাজ ইন্দ্ৰ ক্ৰোধে অধীর হইয়া দানবদিগকে ইতস্ততঃ বিদ্রাবিত করিয়াছিলেন, তদ্রূপ ভগদত্ত পাণ্ডবসেনাগণকে চারিদিকে বিদ্রাবিত করিলেন। তখন পাণ্ডবসৈন্যগণ আপনাদের মধ্যে কাহারও আশ্রয় লাভ করিতে অসমর্থ ও নিতান্ত বিমনায়মান হইয়া পলায়ন করিতে লাগিল। কেবল ভীমতনয় ঘটোৎকচকে রথারূঢ় নিরীক্ষণ করিলাম। কৌরবসেনাসকল পাণ্ডবসৈন্যগণকে পলায়ন করিতে দেখিয়া তুমুল কোলাহল করিতে লাগিল। পরে রাক্ষসরাজ ঘটোৎকচ ভগদত্তকে শরজালে সমাচ্ছন্ন করিলে বোধ হইল যেন, জলধারায় সুমেরুগিরিকে সমাচ্ছন্ন করিতেছে। ভূপতি ভগদত্ত সেই সমস্ত শরনিকর অপসারিত করিয়া অবিলম্বে ঘটোৎকচের মর্ম্মস্থলে প্রহার করিলেন। ঘটোৎকচ ভিদ্যমান আচলের ন্যায় শরতাড়িত হইয়াও কিছুমাত্র ব্যথিত হইলেন না। অনন্তর প্রাগজ্যোতিষেশ্বর ভগদত্ত নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া চতুর্দ্দশ তোমর প্রয়োগ করিলে ঘটোৎকচ নিশিতশরদ্বারা তদ্দণ্ডে উহা খণ্ড খণ্ড করিয়া অশনিসঙ্কাশ সপ্ততিশরে ভগদত্তকে বিদ্ধ করিলেন। অনন্তর ভগদত্ত তাঁহার চারি অশ্ব বিনষ্ট করিলেও তিনি সেই রথে অবস্থান করিয়া তাহার হস্তীর প্রতি মহাবেগে হেমদণ্ডমণ্ডিত ভীষণ শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। প্ৰাগজ্যোতিষেশ্বর তৎক্ষণাৎ উহা তিন খণ্ড করিয়া ভূতলে নিপতিত করিলেন। যেমন দানবরাজ নমুচি ইন্দ্রের ভয়ে রণস্থল হইতে পলায়ন করিয়াছিলেন, তদ্রূপ ঘটোৎকচ নিতান্ত শঙ্কিত হইয়া পলায়ন করিলেন। অনন্তর কুঞ্জরাধিষ্ঠিত ভূপতি ভগদত্ত যমরাজ ও বিরুণের অজেয়, প্রখ্যাত মহাবলপরাক্রান্ত, রাক্ষসেন্দ্র ঘটোৎকচকে এইরূপে পরাজয় করিয়া পাণ্ডবসেনা সংহার করিতে লাগিলেন, বোধ হইল যেন, অরণ্যাহস্তী পদ্মিনীকে বিমর্দ্দিত করিয়া ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতেছে।

নকুলসহদেবসহ শল্যযুদ্ধ—শল্যপরাজয়

“অনন্তর মদ্ররাজ শল্য ভাগিনেয় যমজ নকুলসহদেবের সন্নিহিত হইয়া তাঁহাদিগকে শরজালসমাচ্ছন্ন করিলেন। মেঘ যেমন দিবাকরকে আবরণ করে, তদ্রূপ সহদেব মাতুল শল্যকে সমুপস্থিত দেখিয়া শরসমূহে তাঁহাকে আবৃত করিতে লাগিলেন। মদ্ররাজ শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়াও নিতান্ত হৃষ্ট ও একান্ত সন্তুষ্ট হইলেন। তাঁহাদেরও জননী মাদ্রীর সম্পর্কনিবন্ধন মাতুলের প্রতি অতুল প্রীতি সমুৎপন্ন হইল। শল্য সহাস্যমুখে চারিশরে নকুলের চারি অশ্ব বিনষ্ট করিলে নকুল সত্বর রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া সহদেবের রথে অধিরূঢ় হইলেন এবং উভয়ে মিলিত হইয়া ক্ৰোধাভরে সুদৃঢ়শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক শল্যের প্রতি বাণবৃষ্টি করিতে লাগিলেন; কিন্তু মদ্ররাজ অচলের ন্যায় কিছুতেই বিচলিত না হইয়া অবলীলাক্রমে বাণসকল খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর সহদেব রোষকলুষিতমনে শল্যকে লক্ষ্য করিয়া শর নিক্ষেপ করিলেন। ঐ শর পক্ষিরাজ গরুড়ের ন্যায় বেগে ধাবমান হইয়া মদ্ররাজকে বিদ্ধ করিয়া ভূতলে নিপতিত হইল। তিনি তখন নিতান্ত ব্যথিত হইয়া রথোপস্থে নিষণ্ন ও মূর্চ্ছিত হইলেন। সারথি তাঁহাকে নিপতিত ও বিচেতন নিরীক্ষণ করিয়া রণস্থল হইতে অপসারিত করিল। ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ মদ্ররাজ শল্যের রথ প্রতিনিবৃত্ত অবলোকন করিয়া বিমনায়মান হইয়া তাঁহার বিনাশ আশঙ্কা করিতে লাগিলেন। এদিকে নকুল ও সহদেব মদ্ররাজকে পরাজয় করিয়া প্ৰফুল্লাননে শঙ্খধ্বনি ও সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। ইন্দ্র ও উপেন্দ্র যেমন দৈত্যসৈন্যগণকে বিদ্রাবিত করিয়াছিলেন, তদ্রূপ ইঁহারাও কৌরব সেনাদিগকে বিদ্রাবিত করিতে লাগিলেন।”