১০০. স্বয়ং ভীষ্মকর্ত্তৃক ব্যূহরচনা

১০০তম অধ্যায়

স্বয়ং ভীষ্মকর্ত্তৃক ব্যূহরচনা

সঞ্জয় কহিলেন, “অনন্তর মহাবীর শান্তনুতনয় সৈন্যগণসমভিব্যাহারে যুদ্ধাৰ্থ বহির্গত হইয়া স্বয়ং সর্ব্বতোভদ্র[নানাবর্ণরঞ্জিত সুরক্ষিত বহুদ্বারবিশিষ্ট সর্ব্বতোভদ্ৰ-মণ্ডলবৎ দুষ্প্রবেশ্য]ব্যূহ নির্ম্মাণ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত কৃপ, কৃতবর্ম্মা, শৈব, শকুনি, সিন্ধুরাজ, কাম্বোজাধিপতি সুদক্ষিণ, ভীষ্ম ও ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ ঐ ব্যূহের মুখে, মহাবীর দ্রোণ, ভূরিশ্রবা, শল্য ও ভগদত্ত কবচ ধারণপূর্ব্বক ঐ ব্যূহের দক্ষিণপক্ষে, মহারথ অশ্বত্থামা, সোমদত্ত, অবন্তিদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ মহতী সেনাসমভিব্যাহারে উহার বামপক্ষে, মহারাজ দুৰ্য্যোধন ত্রিগর্ত্তগণসমভিব্যাহারে উহার মধ্যভাগে এবং রথিশ্রেষ্ঠ অলম্বুষ ও মহারথ শ্রুতায়ু কবচ পরিধানপূর্ব্বক ঐ বৃহের পৃষ্ঠদেশে অবস্থান করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! আপনার পক্ষীয় বর্ম্মধারী বীরগণ এইরূপে সেই মহাব্যূহ নির্ম্মাণ করিয়া তপনশীল হুতাশনের ন্যায় দৃষ্ট হইলেন।

“এদিকে মহারাজ যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, নকুল ও সহদেব আপনাদের মহাব্যূহস্থ সর্ব্বসৈন্যের অগ্রভাগে এবং মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, সাত্যকি, শিখণ্ডী, অর্জ্জুন, রাক্ষস ঘটোৎকচ, মহাবাহু চেকিতান, বীৰ্য্যবান কুস্তিভোজ, মহাধনুৰ্দ্ধর অভিমন্যু, মহাবল দ্রুপদ ও কেকয়দেশীয় পঞ্চভ্রাতা যুদ্ধাৰ্থ বর্ম্মপরিধানপূর্ব্বক ঐ ব্যূহের মধ্যে অবস্থান করিতে লাগিলেন। এইরূপে পাণ্ডবগণ দুৰ্জয় মহাব্যূহ নির্ম্মাণপূর্ব্বক সংগ্রামার্থ প্রস্তুত হইয়া রহিলেন।

“তখন সমরোৎসাহী কৌরবপক্ষীয় ভূপালগণ ভীষ্মকে অগ্রসর করিয়া পাণ্ডবগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। যুদ্ধাভিলাষী। ভীমসেনপ্রমুখ পাণ্ডবেরাও বিজয়াভিলাষে ভীষ্মের অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। চতুর্দ্দিকে সিংহনাদ, কিলকিলা শব্দ, করিকুলের চীৎকার এবং ক্রকচ, গোভিষাণিক, ভেরী, মৃদঙ্গ ও পণবের ধ্বনি আরম্ভ হইল। পাণ্ডবগণ সিংহনাদ, বীরনাদ এবং ভেরী, মৃদঙ্গ, শঙ্খ ও দুন্দুভিধ্বনি করিয়া যুদ্ধাৰ্থ কৌরবগণের প্রতি আগমন করিতে লাগিলেন; কৌরবগণও ক্রুদ্ধচিত্তে প্রতিদান করিয়া সহসা পাণ্ডবগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। এইরূপে উভয়পক্ষীয় সৈন্য সমবেত হইয়া পরস্পর তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ করিল।

অমঙ্গলসূচক বিবিধ উৎপাত

“হে মহারাজ! ঐ সময় মহাশব্দে মেদিনীমণ্ডল কম্পান্বিত হইল; পক্ষিগণ ঘোর নিনাদ করিয়া চতুর্দ্দিকে ভ্ৰমণ করিতে লাগিল; বিমলোদিত [মেঘাদি আবরণহীন নির্ম্মল আকাশে উদিত উজ্জ্বল] সূৰ্য্যের প্রভা তিরোহিত হইতে লাগিল; মহাভয়সূচক তুমুল বায়ু প্রবাহিত হইতে লাগিল; আশিবসূচক শিবগণ ঘোররবে চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল; চতুর্দ্দিক প্ৰজ্বলিত হইয়া উঠিল; পাংশুবৃষ্টি ও রুধিরমিশ্ৰিত অস্থি বৃষ্টি হইতে লাগিল; বাহনগণ চিন্তান্বিত মনে বাষ্পমোক্ষণ ও বারংবার মূত্র পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিল; অকস্মাৎ অন্তর্হিত পুরুষাদ [নরভোজী] রাক্ষসগণের ভীষণ ধ্বনিশ্রুত হইতে লাগিল; গোমায়ু ও কাকসকল চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইল; কুকুরগণ বিবিধ ধ্বনি করিতে আরম্ভ করিল এবং মহাভয়সূচক প্রজ্বলিত মহোল্কাসকল সূর্ঘ্যের সহিত ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল। হে মহারাজ! সেই ভয়ঙ্কর অশিবসময়ে নরেন্দ্ৰ-নাগ-অশ্ব-সমাকুল কৌরব ও পাণ্ডবসৈন্যগণ বায়ুবেগে কম্পিত বনরাজির ন্যায় শঙ্খ ও মৃদঙ্গশব্দে কম্পিত হইয়া বাতোদ্ধূত সাগরের ন্যায় তুমুল নিৰ্ঘোষ করিতে আরম্ভ করিল।”