০৬৯. পঞ্চম-দিবসীয় যুদ্ধ-ব্যূহরচনা

৬৯তম অধ্যায়

পঞ্চম-দিবসীয় যুদ্ধ-ব্যূহরচনা

সঞ্জয় কহিলেন, “অনন্তর শর্ব্বরী প্ৰভাত ও দিবাকর উদিত হইলে উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণ যুদ্ধার্থ সমরক্ষেত্রে সমুপস্থিত হইল। পাণ্ডব ও ধার্ত্তরাষ্ট্রেরা সমবেত, নিতান্ত ক্রুদ্ধ ও জিগীষাপরবশ হইয়া পরস্পরের মুখাবলোকনপূর্ব্বক যুদ্ধে ধাবমান হইলেন। ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ আপনার কুমন্ত্রণানুসারে মকরব্যূহ [মকরব্যূহে সৈন্যগণের অগ্র ও পশ্চাদ্ভাগ বিপুল এবং মধ্যভাগ সূক্ষ্মীরূপে রচনা করিবে। অগ্র ও পশ্চাদ্ভাগে ভয় উপস্থিত হইলে এই ব্যূহ রচনা করিতে হয়।] রচনা করিয়া প্ৰর্হষ্টমনে নানাপ্রকার অস্ত্র ও বর্ম্ম ধারণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীষ্ম সেই মকরব্যূহের চতুর্দ্দিক্‌ রক্ষা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। পাণ্ডবেরাও নিয়মানুসারে ব্যূহরচনা করিয়া রক্ষা করিতে লাগিলেন। অনন্তর রথিশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম ধ্বজসমূহে পরিবেষ্টিত হইয়া নিৰ্গত হইলে রথী, পদাতি, হস্তী ও হস্তীপকসকল যথাস্থানে অবস্থিত হইয়া তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিল। পাণ্ডবগণ তাঁহাদিগকে সংগ্রামে উদ্যত নিরীক্ষণ করিয়া নিতান্ত দুর্ভেদ্য শ্যেনব্যূহ [শ্যেন অর্থাৎ বাজপাখীর যেরূপ আকৃতি, তদনুসারে এই ব্যূহের সম্মুখভাগ সূক্ষ্ম, শেষভাগ অপেক্ষাকৃত কিছু স্থূল এবং দুই পার্শ্বদেশ বিস্তীর্ণ হইবে] রচনা করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন সেই ব্যূহের মুখে, শিখণ্ডী ও ধৃষ্টদ্যুম্ন নেত্রদ্বয়ে, সত্যবিক্রম সাত্যকি শিরোভাগে এবং পার্থ গভীর শরাসন বিকম্পিত করিয়া গ্ৰীবাদেশে অবস্থান করিতে লাগিলেন। মহাত্মা দ্রুপদ আত্মজের সহিত এবং অক্ষৌহিণীসেনাসমভিব্যাহারে উহার বামপক্ষ, কৈকেয় তাহার দক্ষিণপক্ষ এবং দ্ৰৌপদীর পঞ্চপুত্র, অভিমন্যু ও স্বয়ং ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, নকুল এবং সহদেবের সহিত, উহার পৃষ্ঠ রক্ষা করিতে লাগিলেন।

“অনন্তর মহাবীর ভীম সম্মুখ দ্বার দিয়া মকরব্যূহে প্রবেশপূর্ব্বক ভীষ্মকে প্রাপ্ত হইয়া শরজালে তাঁহাকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। ভীষ্ম পাণ্ডবগণের ব্যূহিত সৈন্য বিমোহিত করিয়া মহাস্ত্ৰজাল বিস্তার করিতে লাগিলেন। তখন অর্জ্জুন স্বীয় সৈন্যগণকে বিমোহিত দেখিয়া সত্বর শরদ্বারা ভীষ্মকে বিদ্ধ করিলেন এবং ভীষ্মপ্রযুক্ত অস্ত্র নিরস্ত করিয়া হৃষ্টচিত্তে স্বীয় সৈন্যগণের সহিত রণস্থলে অবস্থান করিতে লাগিলেন। অনন্তর মহারাজ দুৰ্য্যোধন ভয়ঙ্কর সৈন্যসংহার ও ভ্রাতৃবধ চিন্তা করিয়া অবিলম্বে দ্রোণাচাৰ্য্যকে কহিলেন, “হে আচাৰ্য্য! আপনি নিরন্তর আমার হিতাভিলাষ করিয়া থাকেন। হীনবল পাণ্ডবগণের কথা দূরে থাকুক, আমরা পিতামহ ভীষ্ম ও আপনাকে আশ্রয় করিয়া অমরগণকে পরাজয় করিতে বাসনা করি; এক্ষণে যাহাতে পাণ্ডবগণ বিনষ্ট হয়, তাহার চেষ্টা করুন; আপনার মঙ্গল হইবে।” তখন দ্রোণাচাৰ্য্য সাত্যকির সমক্ষে পাণ্ডবগণের সৈন্যসংহার করিতে লাগিলেন; সাত্যকি দ্রোণাচাৰ্য্যকে তৎক্ষণাৎ নিবারণ করিলেন। এইরূপে উভয়ের ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল; প্ৰবল প্ৰতাপশালী দ্রোণ দশটি বাণদ্বারা সাত্যকির জত্রুদেশ অনায়াসে বিদ্ধ করিলেন। ইত্যবসরে ভীমসেন ক্রোধভরে তাঁহার হস্ত হইতে সাত্যকিকে রক্ষা করিয়া শরনিকরদ্বারা তাঁহাকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন আচাৰ্য্য দ্রোণ, ভীষ্ম ও শল্য নিতান্ত ক্ৰোধাবিষ্ট হইয়া শরজালদ্বারা ভীমসেনকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। মহাবীর অভিমন্যূ ও দ্রৌপদীর আত্মজগণ নিশিতশরনিকরদ্ধারা ঐ সমস্ত উদ্যতায়ুধ বীরদিগকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। পরে শিখণ্ডী মহাবল পরাক্রান্ত ভীষ্ম ও দ্রোণাচাৰ্য্যকে রোষকষায়িতলোচনে আগমন করিতে দেখিয়া প্রত্যুদগমন করিলেন এবং জলধরের ন্যায় গভীরনিঃস্বন সুদৃঢ় শরাসন গ্ৰহণ করিয়া দিবাকরকে সমাচ্ছন্ন করিয়া অনবরত শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন ভরতপিতামহ ভীষ্ম শিখণ্ডীকে প্রাপ্ত হইয়া তাহার স্ত্রীত্ব স্মরণপূর্ব্বক তৎক্ষণাৎ তাহাকে পরিত্যাগ করিলেন। ইত্যবসরে দ্রোণাচাৰ্য্য মহারাজ দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক প্রেরিত হইয়া ভীষ্মকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত শিখণ্ডীর প্রতি ধাবমান হইলেন। শিখণ্ডী যুগান্তকালীন অনলের ন্যায় নিতান্ত সমুজ্জ্বল দ্রোণাচাৰ্য্যকে প্রাপ্ত হইয়া ভীতমনে তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে পরিত্যাগ করিলেন। তখন রাজা দুৰ্য্যোধন যশোলাভবাসনায় বিপুল বলসমূদয়ের সহিত ভীষ্মকে রক্ষা করিতে লাগিলেন, পাণ্ডবগণও জয়লাভার্থ একান্ত অধ্যবসায়ারূঢ় হইয়া ধনঞ্জয়কে পুরস্কৃত করিয়া ভীষ্মের অভিমুখে গমন করিলেন। যেমন দানবদিগের সহিত দেবগণের যুদ্ধ হইয়াছিল, তদ্রূপ অসীম যশ ও জয়লাভার্থী কৌরব এবং পাণ্ডবগণের ঘোরতর সংগ্ৰাম হইতে লাগিল।”